শেকড়হীন গাছ বেশি দিন দাঁড়াতে পারে না। অস্তিত্বের লড়াইয়ে শেকড়ের সন্ধানে অথবা শিরা উপশিরার কথা যে বা যারা ভুলে যাবে, তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কেউ কেউ কখনো কখনো শেকড়ের সঙ্গে করে বসে বেহায়া বা নির্লজ্জের কাজ। আবার কারও কারও চিন্তার খোরাক যখন বাতাসের তলদেশ বয়ে চলে যায়, তখন ভর করে বসে চিন্তার বিকাশায়ন। মানুষ তখন যথার্থ প্রাণী হিসেবে আসন করে নেয় পৃথিবীতে।
যদি হয় ভাবুক পৃথিবীর বাসিন্দার কাণ্ড, তখন ইচ্ছেরা খেলে যায় ঘুড়ি উড়ানো মহোৎসব। সুন্দরের যাঁতাকল ধরতে জানার মাঝে শিল্পিরা বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। জাগতিক জীবনে জানার মাঝেও শিল্প ও সত্য বসবাস করে।
আমি এখন বসেছি, মিথ্যা বলতে আসা এক সৃষ্টি নিয়ে। পাঠকমাত্রই ধরে নেবেন ‘এসেছি মিথ্যা বলতে’। ঠিক তাই। সাহসের একটি ব্যাকরণ ধাকা চাই। যে ব্যাকরণ বুঝবে না কোনো কারণ, বুঝবে না কোনো বারণ। সে রকম এক কবিতা বলার ব্যাকরণ নিয়ে বসেছে সময়ের এক সাহসী কবি জাব্বার আল নাঈম। তার কবিতা বলার ঢঙ একেবারে যাযাবরি স্টাইলের। তবে কবিরা সেকালে নই বলে লেবাসেও যাযাবর নেই। কিন্তু জাব্বার আল নাঈম মিথ্যার বাগানে হাত রেখে এমন সব মিথ্যা বয়ান করে গেছেন, তাতে ভেতরের শক্তিময়তাও প্রকাশ পেয়ে গেলো।
কবি তার এ গ্রন্থটির কবিতাগুলোকে উপন্যাসের চরিত্রের মতো প্যারায় বিভাজন করে পাঠককে আন্দোলিত করার প্রয়াস রাখেন। কবি মুহূর্তেই পুরো পৃথিবীর মাঝামাঝি সময়কে ধারণ করতে বসতে গিয়ে পেয়ে বসেন বিশাল শূন্যতা। তার মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক মধ্যমপন্থার বাসিন্দা হিসেবে। হয়তো নাও হতে পারে!
কবি মিথ্যা বলতে এসে পাঠককে নিয়ে গেছেন সময়ের কাছে। সময়কে ধারণ করতে পারাটাই যেমন কবিত্ব, তেমনি সময়কে অস্বীকার করাও বোকামির নামান্তর। কবি জাব্বার আল নাঈম শিরোনামীয় কবিতায় পাঠককে পৌরাণিকতার পোষাক পরাতে করেননি কোনো কার্পণ্য নেই। কবির ভাষায়—
খুঁজতেছি পানির নবি
পানিতে সুরমা নহর
আপনি মহান গুরু
পানির কারণে তৃতীয় যুদ্ধের শুরু
চমৎকার এক উপলব্ধি এ কবির। সম্ভাবনার দুয়ারে দাঁড়িয়ে ভবিতব্যের বার্তাও দিতে সাহস দেখালেন। কবিরা তো ভাঙচুরের বিশ্বাসী। বর্তমানের শাড়ি পরে কবি ভবিষ্যতের ঘুড়ি ওড়াতে পছন্দ করেন। কবির ভাষায়—
ভারত দৌড়াচ্ছে
চীন মাথা তুলছে
তির-ধনুক হাতে রাশিয়া
সরল গরল জাপান হাসছে।
এখানে এসে পাঠককে বসিয়ে দিলেন সময়ের হাত ধরে। যে সময়ে পৃথিবীর জুটঝামেলা শুরু হবেই। এরই নাম কবিতার ভবিষ্যদ্বাণী। এখানে কবি কবিতায় ঢুকে দেখাতে ছেয়েছেন আন্তর্জাতিকতার কথা। যেখানে দাঁড়িয়ে বলতে সাহস দেখিয়েছেন ‘কফিনে মোড়ানো বাংলাদেশ’ কবিতাটিতে। কবি ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ঢুকে পড়েছেন অনেকটা খেয়ালের বশে। বলছেন—
শেষতক টুপি না পেয়ে
আমরা কফিন বন্দী বাংলাদেশ মাথায় নিয়ে হাঁটতে থাকলাম
মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানের দিকে
কবিরা ভেতরের কথা এভাবে বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বলে কবি সব সাধারণ থেকে অসাধারণ। বাস্তবিক জীবনে মানুষ সৎ মা বলতে গিয়ে যে অসতের পরিচয় দেন, সেটাই পারিবারিক বাস্তবতা। তেমনই আমাদের এ কবি ঠিকই মিথ্যা বলতে এসেছেন। যে কথাটা কবি বললেই অন্যরা দাবিয়ে দেন মিথ্যার পোশাক পরিয়ে, সেখানে মিথ্যাটা অন্যের কাছে সত্যের পাতাবাহার মনে হয়।
জব্বার আল নাঈম প্রায় কবিতায় কথা বলার ঢঙে নিয়ম-অনিয়ম-প্রতিবাদের ভাষা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন।
বেহায়া শব্দের প্রতিসমাচার কবতাটিতে কবি প্রতিবাদের একটা নতুন ঢঙ দেখালেন। কুকুর পালার কিচ্ছাই আমাদের নিয়ে গেলেন মরা ময়ূরের কিচ্ছার কাছে। কবিতা বইটি প্রথম দুই পর্বের বিন্যাসে সমাজের অনাচারের বিষয় তুলে ধরতে গিয়ে ভিন্নভাবে প্রতিবাদের আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন—
এভাবেই প্রতিবেশীর প্লেটে ভাতের সঙ্গে তুলে দিচ্ছি—
ফারাক্কা, টিপাইমুখ, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অসংখ্য নমস্য!
কবি ঠিক জায়গায় ইশারা করতে পেরেছেন। কবি গুলবদন নামীয় ইতিহাসের এক রাজত্ব নিয়ে প্রেয়সীকে বসাতে চেয়েছেন। কবি বিভাজনের এ সময়ে অথবা হতচ্ছাড়া রাজনীতি পাগল মানুষগুলোকে পরাতে চেয়েছেন মিথ্যা নামের সত্য বলার কৌশল। এ জায়গায় জব্বার আল নাঈম সফলতার সঙ্গে কবিতা বুননে কারিশমা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন।
কথা থেকে যায়। আপসোসের বাতায়নে ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাহি রাজিয়ুন পড়িয়ে রাজনীতি নামক বেহায়াকাণ্ডের টনক নাড়াতে। অনেক মানুষের মনের কথা যখন একজন কবির লেখা দিয়ে প্রকাশিত হয়, তখন পাঠকমাত্রই যেমন সার্থক, তেমনই কবি হন আন্দোলিত। জব্বার আল নাঈম মিথ্যা বলতে এসে সত্যের সিন্দুকের চাবি খুলে দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, মিথ্যা এভাবেই বলতে হয়। কবি চেয়েছেন সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার, বতর্মান ও ভবিষ্যতের কথা বলতে হবে। কবি প্রায়ক্ষেত্রে সফলতার ছাপ রেখে হাঁটতে চেয়েছেন।
মিথ্যা বলতে এসেছি
কবি: জব্বার আল নাঈম
প্রকাশন: চৈতন্য প্রকাশন
দাম: ১৫০ টাকা
প্রকাশকাল: ২০১৮