প্রায় ত্রিশ বছর ধরে বাংলা কবিতার আবেগকে লালন করে আসছেন কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘মেঘশিল্পের মমিগ্রহ'(প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) মহাব্যাপ্তির প্রজ্ঞা নিয়ে মহাজীবনের প্রত্যয়ে আত্মযাপনের নিবিড় অভিব্যক্তি হয়ে উঠে এসেছে। স্বদেশভূমি ছেড়ে দীর্ঘ প্রবাস জীবনেও তিনি বাংলাদেশকে কিভাবে হৃদয়ে লালন করেছেন এবং বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন; এই কাব্যের কবিতাগুলোতে তারই পরিচয় আছে। ৫৫টি নির্মেদ কবিতার উচ্চারণে তুলে ধরেছেন নিজস্ব বোধের শব্দায়িত নিবিড় সংশ্লেষ।
কাব্যের সূচনা কবিতাতেই হাতের মুঠোয় জলের ঢেউকে ধারণ করেছেন। উত্তপ্ত চাঁদের আয়নায় নিজের মুখ দেখেছেন। দূর থেকে পাখিদের কাছে শুনতে চেয়েছেন মেঘশিল্পের গান। আর শিল্পীদের জন্য জমিয়ে রাখতে চেয়েছেন আগামীর বসন্ত। যে বসন্তের ফুল উত্তরসুরিরা কুড়িয়ে নেবে। ভাগ্য বদলের পথেই সব কিছুর মোকাবিলা করার জন্য রুখে দাঁড়াবে। সৌরলোকের আলোকিত মমিগ্রহ হয়ে মানবিকতার চূড়ান্ত সাহসে এই কাব্যক্যানভাস রচনা করতে চেয়েছেন। তাই এই আত্মবিস্তারের সম্মোহনে নিজের পরিচয়টি দিয়েছেন। কবিতায় লিখেছেন:
সকল গ্রহের উৎস হয়ে এই সৌরলোকে দীপ্তিমান
থাকে যে মমিগ্রহ;
আমি তাকেই রাখতে চেয়েছি আমার কাব্যক্যানভাসে
মানবতাকে মান্য করে,
আমি পৃথিবীর প্রতিটি পুষ্পে বিতরণ করতে চেয়েছি
মমতার বিনম্র পরাগ।
এই জীবনদর্শনের মধ্যে দিয়েই তাঁর কাব্যের প্রতিটি শব্দজাগরণ উত্থিত হয়েছে। বিশ্বময় যে অস্থিরতা, যে অমানবিকতা, যে যুদ্ধবিধ্বস্ত সভ্যতা—তার বিরুদ্ধেই শান্তি ও কল্যাণের পথে কাব্যের মরমি উত্তরণকে নিবেদন করেছেন। কবি দেখেছেন উদ্বাস্তু শিবিরের ছবি, অভিবাসন খোঁজা মানুষদের, ইউক্রেনের ধ্বংসরূপ,উদ্ধত রাশিয়ান যুদ্ধবিমান। আর তখনই কবির মনে হয়েছে, ‘সভ্যতা মুখ লুকোচ্ছে পৃথিবীর নর্দমায়-নালায়’।
তবু মানুষ থেকে যায়। মানুষের স্বপ্ন থেকে যায়। যেখানে ‘মাটিই পরম সত্য, আকাশই অগ্নিদেহ’। আলোজীবনের অভ্যাসে মানুষই শেষ পর্যন্ত জয়ের পথে এগিয়ে আসে। অস্থিরতা একদিন শান্ত হয়ে ফেরে। কবি নিজেকেই প্রশ্ন করেন,
কতজন মানুষের আশ্রয়স্থল হলে আমরা পৃথিবীকে
একটি নিরাপদ মায়াগৃহ বলতে পারি!
যেখানে মানুষের লোভ-হিংসা থাকবে না, আগ্রাসন থাকবে না। কিন্তু কবি দেখেছেন, প্রকৃতির রূপও বদলে যাচ্ছে। সোনালি ধানখেত হচ্ছে কংক্রিটময় কলোনি। বৃক্ষবিতান হচ্ছে বৃক্ষনিধনের মরুভূমি। হলুদ গোলাপের আরোগ্য নিকেতন আজ কোথায়? পাখিডাকা বৃক্ষদের, কাঠবেড়ালি খেলাকরা বৃক্ষদের কোথাও দেখা যায় না। পাখি এবং কাঠবিড়ালিরাও গৃহহারা মানুষের মতো।
গৌরব আর ইতিহাসের মধ্যে দিয়েও বর্তমান অবক্ষয়কে বারবার কবি উল্লেখ করেছেন। সারাবিশ্বের কাছে যেমন মানবিক সভ্যতার আবেদন কবিতাগুলোকে উজ্জ্বল করেছে, তেমনি জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতিও কবির পরিশুদ্ধ পবিত্র আবেগ ঘনীভূত হয়েছে।
বাংলার জীবন, বাংলার মাটি-আকাশ-প্রকৃতি সবই কবির হৃদয়ের উষ্ণতায় লেপ্টে আছে। রক্তাক্ত অধ্যায়গুলিও স্বরলিপি হয়ে বেজে উঠেছে। কবির স্বপ্ন, ‘কবিতার জন্য আমিও একটি আকাশ রেখে যেতে চাই’। সেই আকাশই তো জীবনের মহাআয়োজন নিয়ে বিরাজ করবে। ‘স্বপ্নের বাস্তবতায় আজকের বাংলাদেশ’ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না!’
মুক্তিসেনাদের ধরার জন্য একদিন গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিরীহ মানুষও একদিন হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। সেইসব দিনগুলোল স্মৃতি কবিতায় ফিরে এসেছে। কবি জানেন, আনন্দ মানুষকে আয়ু দেয়। বিজয়ের উল্লাস মানুষকে আগামীর সূর্য দেয়। মা তার ছেলের নাম ধরে ডাকতে পারে।
কবি প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষের জীবনে যুদ্ধ কি অবধারিত? অথচ সারাবিশ্ব যুদ্ধের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বময় আণবিক বোমা তৈরির হিড়িক চলছে। সব মানুষই জানে আণবিক বোমাগুলো মানুষ মারার জন্যেই তৈরি হয়েছে। কিন্তু কারোর কিছুই করার থাকে না। যদিও যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষও, পাখিও, বৃক্ষও। যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করে তা আন্তর্জাতিক বাজারে বিপণনের প্রয়োজন হয়। তাই যুদ্ধ এক কূটনৈতিক কৌশল। জাতিসংঘ যুদ্ধ থামাতে পারে না। মানুষ মানুষের হাতেই মারা পড়ে। অন্যদিকে মানুষই মানুষকে ভালবাসতে জানে। তবে কেন আনন্দ-বিষাদের বিন্দু একইভাবে ফিরে আসে? জীবনে তো জীবনই মিলে যায়!
মানুষ তবে কেন মানুষকে বোঝে না? মানুষকে কেন্দ্র করেই কত জীবনের গল্পের জন্ম হয়। পৃথিবীর ছায়াডোরে বাঁধা আছে প্রতিটি জীবন। এক একটি স্মৃতি খুঁড়ে খুঁড়ে মানুষ উজ্জীবিত হয়। ভবের নাট্যাঙ্গনে মানুষ তো অস্থায়ী। তার আসল ঠিকানা প্রত্যেকেই জানে। এখানেই কবির দার্শনিক ভাবনা জেগে উঠেছে। ‘সাক্ষাৎরের সন্ধ্যা’ নামক কবিতায় আদি উৎস জীবনের প্রান্তভূমিতে দাঁড়িয়ে কবি নদী ও অরণ্য সঞ্চারে নিজস্ব ভঙ্গিমায় নিজেকে আবিষ্কার করেছেন। সেখানে আলতা পরা পায়ের দিকে জ্যোতিষীর দৃষ্টিপাত আদিম চেতনারই পরিচয় দেয়। ‘জ্যোৎস্নার জলমন্ত্র’ কবিতায় ‘গ্রহগ্রন্থ’ পাঠের মধ্য দিয়ে প্রকৃতিজীবনের অন্বয়কে সমানুভূতির পর্যায় দান করেন।
বাংলার ইতিহাসকে নিউইয়র্কের প্রকৃতির মধ্যেও ফুটে উঠতে দেখেছেন। রোমান্টিক দৃশ্যমালায় বাংলার আবেগ-ই তাঁর অবচেতন মনে ক্রিয়া করেছে। মেক্সিকোর ক্যানকুন শহরে সড়কের দুপাশে কৃষ্ণচূড়া ফুল দেখে নিজের জন্মভূমিকেই অনুভব করেছেন। কৃষ্ণচূড়ায় ফোটে উঠেছে বাংলা ভাষার রং। ফাগুনের শোক ও সংগীতও জেগে উঠেছে। প্যারিসের ‘রেড-জেরানিয়াম’ ফুলগুলো ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিকে মনে পড়িয়েছে। লন্ডনের লাল গোলাপও কবির মনে মরমিয়া ভাব জাগ্রত করেছে, ‘ফুলে ফুলে শোভিত ভোরের আলো, দুপুরের ঝিকিমিকি রোদ।’ কবি লিখেছেন,
‘পৃথিবীর সকল দেশেই একুশ’কে আমার মনে হয়েছে
সীমান্তবিহীন। মনে হয়েছে—
মানুষের চোখের ইশারা
কান্নার বেদনা
হাসির আনন্দযজ্ঞ
প্রার্থনার নীরব চাহনি
কিংবা আঙুল দিয়ে পথ দেখিয়ে দেওয়ার যে ভাষা—
মূলত সেটাই একুশের মূল পরিচয়। পাখিরা যেমন
দেশ থেকে দেশান্তরে উড়ে যায়, সকল ভয় করে জয়!
যে ইতিহাস, যে গর্ব, যে দেশের প্রতি সমূহ ভালোবাসা নিয়ে কবির জীবনযাপন তা কতখানি হৃদয়ে আশ্রিত এখানে তারই পরিচয় আছে। জীবনানন্দের প্রকৃতির সঙ্গে কবির দেখা প্রকৃতিও মিশে গেছে। কার্তিকের রোদ্দুর ফিরে এসেছে। তেমনি ভাষাশহিদদের জীবন্ত ছায়ামূর্তি কবির সামনে দাঁড়িয়েছে: সালাম, রফিক, জব্বার, আবুল বরকত। কিন্তু তারাও ‘সিলিকন’ প্রজন্মে অচ্ছুত হয়ে যায়নি। অথচ মানুষের অভিধান থেকে ঐক্য উধাও হয়ে গেছে। রক্ত ও বারুদ মিশে নির্মাণ করছে স্বপ্নের ভস্ম।
মানুষ ক্রমশ গৃহহারা হচ্ছে। হাঙরের পুরনো দাঁত দেখা দিচ্ছে মানুষের মধ্যেও। কবি খুঁজেছেন হারিয়ে যাওয়া শস্যদুপুর আর কয়েকজন ভাষাসন্তানের কণ্ঠ। চুলে হাত রেখে প্রেম নিবেদনের আগে রোমান্টিক অনুভূতিকে কবি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘আমার চারপাশে মৃত, রক্তাক্ত হাত।’ যদিও এক ‘সেতু’ না ‘সাঁকো’ কবিকে পার করবে গন্তব্যের দিকে তা ভেবে পাননি। এক অনিশ্চয়তার ঘোরে এগিয়ে চলেছেন। ‘শোকের শোরুম’ সাজিয়ে জীবনের আয়োজনে।
গৌরব আর ইতিহাসের মধ্যে দিয়েও বর্তমান অবক্ষয়কে বারবার কবি উল্লেখ করেছেন। সারাবিশ্বের কাছে যেমন মানবিক সভ্যতার আবেদন কবিতাগুলোকে উজ্জ্বল করেছে, তেমনি জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতিও কবির পরিশুদ্ধ পবিত্র আবেগ ঘনীভূত হয়েছে। ব্যক্তিহৃদয়ের উজাড় করা স্বপ্ন ও অকুলতা শব্দগুলোতে ব্যঞ্জিত করেছেন। একান্ত মুহূর্তে আত্ম-উপলব্ধির স্বয়ংক্রিয় অভিবাসনে কবিতাগুলো তাই নিরীহ হয়েও প্রাণশক্তিতে পূর্ণতা পেয়েছে।