শোক সংবাদ? কী সেই শোক সংবাদ? সংবাদের পেছনের সংবাদ আমাদের টেনে নিয়ে যায় আরও ভেতরে। এমন ভেতরে, যেখান থেকে প্রলেপহীন আসল সংবাদটি আমাদের মনের চোখে ধরা দেয় অবলীলায়। আর যখন সত্যিকারের সংবাদটি আমাদের সামনে পরিস্ফুটিত হয়, তখন রঙচঙহীন সত্য জানার আনন্দ বিরাজ করে মনে। এমন নির্জলা সত্য আবিষ্কারেই তো শিল্পের সফলতা; যা সৃষ্টিতে শিল্পী যেমন পরিতৃপ্ত হয়, তেমনি পাঠকও পায় অপার আনন্দ।
প্রশ্ন হতে পারে—যে শিল্পীর চোখে আমরা ‘সংবাদ’-এর ভেতর দেখছি, ‘একটি শোক সংবাদ’-এর, সেই শিল্পী কতটা পেরেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য হয়তো আলোচনার শেষ পর্যন্ত থাকতে হবে। তবে এখানে যেটুকু বলা যায়, তা হলো—আধুনিকতার রূপ চকচকা লাবণ্যময় রঙচঙের ভেতরে ম্যাড়ম্যাড়া যে অবস্থা, তার কিছু চিত্র মিলবে সাব্বির জাদিদের ‘একটি শোক সংবাদ’ গল্পগ্রন্থে।
এই বইয়ে গ্রন্থিত ১০ টি গল্পই তৃতীয় পুরুষে লেখা। এসব গল্পে লেখক উপস্থিতকালকে টুকরো টুকরো করে ভাগ করে বিশ্লেষণ করেছেন। যে কারণে সমসাময়িক সমাজ পাঠকের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে। বইটির ১০ গল্পের নয়টি-ই গ্রামবাংলার মানুষ, তাদের জীবন-যাপনের চিত্র, রাজনীতি, অর্থনীতির বর্ণনা পাওয়া যায়; কেবল একটি গল্প শহুরে এক শিল্পীর জীবন নিয়ে। সেখানেও দেখি সমসাময়িক সমাজবাস্তবতার চিত্র ফুটে উঠতে।
প্রথম গল্প ‘একটি শোক সংবাদ’। সদ্যমৃত এক গ্রাম্য মাতব্বর কেরামত মণ্ডলের জীবদ্দশায় কিছু অন্যায়-অত্যাচারের বিভৎস রসের শিল্পায়ন ঘটেছে এই গল্পে। যেখানে দেখা যায়, মৃত কেরামত মণ্ডলের আত্মার বিভিন্ন রূপ মূর্ত হয়ে উঠেছে। জীবদ্দশায় তার কুকৃর্তির কারণে আত্মার অসহায়ত্ব জাগে মনে, আত্ম-ধ্বিক্কার অনুভূত হয়। পথ খোঁজে প্রায়শ্চিত্তের। হালকা কথনে গল্পের শরীর যখন দীর্ঘ হতে থাকে, তখন মৃত এই কেরামত মণ্ডল গল্পের পরিসরে হয়ে ওঠে জীবন্ত। গল্পের শরীরে প্রাণ সঞ্চার করতে পারলে এমনই তো হওয়ার কথা। গল্পের শুরুতে কেরামত মণ্ডলের সঙ্গে গল্পকার যখন আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন, সেই সময়ের আবহ বর্ণনা ঠিক এরকম—‘মরহুম কেরামত মণ্ডল নিজ বাসভবনের দক্ষিণ-দুয়ারী ঘরের শানের বারান্দায় উত্তর দিকে মাথা দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। তার শরীর রেল লাইনের পাতের মতো টান টান এবং সমান্তরাল। মসজিদের মাইকে শোক সংবাদের ঘোষণা তিনি শুনতে পেয়েছেন। এমনকি ঘোষণাকারীর কণ্ঠও তিনি চিনতে পেরেছেন।’
আমরা জানি না মৃত ব্যক্তি ঘোষণা শুনতে পেয়েছেন কি পাননি বা ঘোষণাকারীকে তিনি চিনেছেন কি না, জানি না আমরা। তবে গল্পকারের বলার ভঙ্গি আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করে।
‘কুত্তা’ গল্পে সামাজিকশ্রেণী ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ দেখি। গ্রামের প্রভাবশালী ধনী পরিবার আলম সাহেবের পরিবার। এক কুরবানির দিন গরীব-মিসকিনরা আলম সাহেবের দোতালা বাড়ির সবুজ গেটের সামনে ভিড় করতে থাকে। গ্রামের এক হতদরিদ্র নারী মরিয়ম ভাগ্যের তাড়নায় এসে দাঁড়াতে হয় সেই গেটের সম্মুখে। তার স্বামী শহরের এক গার্মেন্টেসে কাজ করতো; কিন্তু গার্মেন্টেসের অগ্নিকাণ্ডে ঝলসে যায় তার স্বামী— এমনভাবে ঝলসে যায় যে, তাকে শনাক্ত করার কোনো উপায় থাকে না। স্বামীকে এনে কবর দেওয়ার ভাগ্যটুকু জোটে না তার, অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ অন্যান্য গরিবের আত্মীয় যখন সরকারের ত্রাণ তহবিল থেকে হাজার পঞ্চাশেক টাকা নিয়ে স্বজন হারানোর কষ্ট আপাত ভুলে যায়—মরিয়মরে তাও ভাগ্য জোটে না। কারণ সে তো লাশই শনাক্ত করতে পারেনি। দুই মেয়ে নিয়ে অথৈ সাগরে ভাসতে থাকে সে। বড় মেয়েকে কোনো রকম বিয়ে দিলেও যৌতুকের জন্য স্বামী তাকে ছেড়ে দিতে চায়। ঘটনাচক্রে মেয়ে জামাই মেয়েকে নিতে আসতে চায়। নিতে এলে জামাইয়ের পাতে দুই টুকরো গোস্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করা তো চাই, সেজন্য ছোট কন্যা আসমাকে নিয়ে আলম সাহেবের গেটের সামনে যায়। অপেক্ষা করতে করতে বেলা গড়িয়ে সাঁঝ নামে। তবু বুঝি আলম সাহেবের দুই ষাড় কুরবানির কাজ শেষ হয় না। ছোট্ট আসমার মনে হয় গেটটা যেন চল্লিশ চোরের গুহা। “গুহার মুখে দাঁড়িয়ে চিচিং ফাঁক বললে খুলে যায় গুহার মুখ। ভেতরটা সোনাদানা মণিমুক্তায় ভরা। একবার ঢুকতে পারলেই জীবন ধন্য।” অপেক্ষার প্রহর হয়তো এক সময় কাটে— দেয়ালের ওপর দিয়ে ভেতরের দিক থেকে উড়ে আসতে থাকে গোস্ত। উড়ে আসা সেই গোস্ত পাওয়ার জন্য পেশীশক্তির গরিবরা হুড়োহুড়ি করে, মরিয়ম ও আসমা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে এককোণে। গল্পকারের ভাষায় “যেন একদল অশ্বারোহী মাত্রই মার্চ করতে করতে চলে গেছে এই রাস্তা দিয়ে।” মাংসা আর পাওয়া হয় না ছোট্ট আসমা ও তার মা মরিয়মের। এর পরের ঘটনা সহৃদয় পাঠককে টানটান উত্তেজনায় ধরে রাখে শেষ পর্যন্ত—আলম সাহেবের গেটের সামনে মরিয়মদের ঈদ কাটলেও তাদের ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিরা মহা হুল্লোড়ে ঈদ শেষে যে যার কর্মস্থলে চলে যায়। বাড়িতে থাকে আলম সাহেব ও তার স্ত্রী; একদিন তারাও বিশেষ দরকারে যেতে হয় বাড়ির বাইরে। কাজের লোকদের তারা বিশ্বাস করতে পারে না হয় তো। তাই সবাইকে ছুটি দিয়ে ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেয়, কিন্তু বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য থেকে যায় তাদের কুকুর। ক্ষুধায় কাতর কুকুর সারাবাড়ি খুঁজে যখন কিছু পায় না, তখন পাকের ঘরে ঢুকে সযত্নে ফ্রিজে রাখা গরুর মাংসগুলো টেনে টেনে বের করতে থাকে, কিছু কিছু খেতে থাকে কুকুরটা। এই অবস্থায় আলম সাহেবের স্ত্রী রোকসানা ঘরে ঢোকে, মনের কষ্টে তিনি কিছু বলতে পারেন না। কুকুরের জুটা তো খাওয়া যায় না; পরিশেষে সিদ্ধান্ত হলো, আশেপাশের কয়েকবাড়ির দুস্থদের ডেকে এনে তাদের মাঝে কুকুরের জুটা গোস্ত বণ্টন করা হবে। আসমা আর মরিয়ম আবারও আশায় বুক বাঁধে, এবার তারা একটুকরা দুটুকরা নয় সাত সাতটা বড়োসড়ো গোস্ত পায়। খুশি আর দেখে কে! গোস্ত নিয়ে মহা খুশিতে বাড়ি যাওয়ার পথে গোস্তের গন্ধে একটা নেড়ি কুকুর তার পিছু ধরে। আসমা একটা নিয়ত করে—সাত টুকরা গোস্তের সঙ্গে যে দুই টুকরা তা কুকুরটাকে দেবে। তাই কুকুরটাকে হুশহুশ করে তাড়ানের দরকার মনে করে না। সন্দেহ হয় এই কুকুরটাই হয়তো আলম সাহেবের বাড়ির সেই কুকুর যে খেতে পারে না বলে পিছু নিয়েছে আসমাদের। গল্পকারের ভাষায়, “আস্কারা পেয়ে কুকুর পেছন থেকে তাদের সমান্তরালে চলে আসে। তিনজন এবার একসঙ্গে হাঁটতে থাকে।” ‘তিনজন-এর একজন কুকুর! ভাবলে মোচড় দিয়ে ওঠে মনে। এই যে মানুষ ও কুকুরটা এক ‘কাতারে হাঁটা’ এ তো বিস্ময়কর! অথচ তাই হচ্ছে বর্তমান অধুনিক শ্রেণীবৈষম্য ঘনিষ্ঠ সমাজ ব্যবস্থায়। এই অবস্থার সফল চিত্রায়ণ ঘটেছে ‘কুত্তা’” গল্পে। এই গল্পে এটি মূল গল্প হলেও ফাঁক-ফোকরে রয়েছে আরও কতগুলো গল্প। গল্প তৈরির ভঙ্গি, বাক্যে রস সঞ্চার ইত্যাকার বিষয় বিবেচনায় বইয়ের সেরা গল্প দাবি করতে পারি আমরা।
‘“সূর্য না-ওঠা জনপদের গল্প’-এ একটি মতবিভক্ত জাতির চিত্র পাই। জাতীয় ঐক্যই যেখানে মূল সুর। একটি জাতিকে দুটি ফাটলরেখা কিভাবে সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে দুটি প্রান্তে, তারই গল্প এটি। পড়তে পড়তে আমাদের মনে হয়, রাজনৈতিক হীনস্বার্থবাদী বাংলাদেশের দুটি প্রধান দলের মধ্যকার বিভাজনের চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। গল্পে রস সঞ্চারের জন্য সাব্বির জাদিদ এতে সুররিয়্যালিজমের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন স্পষ্ট।
‘“একটি পুঁজিবাদী গল্প’”-এর শিরোনাম দেখে ভেতরটা আঁচ করা যায়। যৌনতার শৈল্পিক বর্ণনা বিস্মিত করে আমাদের। কিছু না বলেও যে অনেক কিছু বোঝানো যায়, এই গল্পে সাব্বির জাদিদ তেমন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এই গল্পের নায়ক ইকরামুলের বড় সখ রেলগাড়ি দেখার। হতদরিদ্র ইকরামুলের দেখার ভাগ্য হয় না রেলগাড়ি। তার হয়তো আরও অনেক লুকায়িত ইচ্ছা থাকে, সেসব নিছক কল্পনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়; কারণ সে যে দরিদ্র হয়ে জন্ম নিয়েছে। গ্রামের ধনী এক পরিবারে সে রাখাল হিসেবে কাজ করে। এক পূজার ছুটিতে বাড়িঅলার ছেলে সৌম্য বাড়ি আসে স্ত্রীসহ। তখন গরমকাল। গরমের চোটে ইকরামুলের ঘুম আসে না, গভীর রাতে সে ছাদে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে সিঁড়ির কোণ থেকে কিসের যেন আওয়াজ ভেসে আসে। তারপরের ঘটনা গল্পকারের মুখে শুনি—সৌম্য আর সৌম্যের বউ সুস্মিতা খোলা আকাশের নিচে সিঁড়ির মুখকে পেছনে রেখে দানবীয় সঙ্গমে লিপ্ত।…নতুন কলের পাইপ পোঁতার দৃশ্যই কেন জানি তার মনে পড়তে থাকে বার বার।” ইকরামুল আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। তার মনে হতে থাকে “সঙ্গমের সুখ ধনী-গরিব সবারই সমান।” সে সিদ্ধান্ত নেয় তার রেলগাড়ি বা অন্য আরও অনেক ইচ্ছা পূরণ না হোক সব সখ পূরণের জন্য একটি বউই যথেষ্ট। বিয়ে করতে চায় সে, বিয়ে করেও। দিন রাত উদ্দম আদিম খেলায় মাতে ইকরামুল। কিন্তু হায়! মাসের মাথায় ইকরামুলের শরীর ভেঙে পড়তে থাকে। দুর্বল লাগে তার, কাজে মন বসে না; কেবলই ঘুম পায়। ইকরামুল জানে না, বউয়ের সঙ্গে আদিম খেলায় মেতে নিজের জন্য বিপদ বয়ে আনছে সে। হঠাৎ বাজারে ইকরামুলের সঙ্গে তার এক বাল্যবন্ধুর দেখা হয়, সব শুনে বন্ধুটি জানায় এই আদিম খেলার সীমাবদ্ধতার কথা—অনেক ফলমূল, ভালো-মন্দ খেতে হবে তাকে। হায় নিয়তি! ইকরামুলের যে ভালো-মন্দ খাওয়ার অবস্থা নেই। সুতরাং সৌম্য ও সুস্মিতার মতো তাকে বেহিসেবি সঙ্গম মানায় না। এই গল্পে এক পুরুষের মনেবৃত্তির বয়ান দিতে দিতে গল্পকার সুনিপুনভাবে ধনী-গরিবের পার্থক্য তুলে ধরেছে। আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ক্যাপিটালিস্ট সমাজে সব ভোগের মালিক কেবল ধনী, দরিদ্র চেয়ে চেয়ে দেখতে পারে বড়োজোর।
“যখন এসেছিলে” গল্পটি এই বইয়ের একমাত্র শহুরে চরিত্রের গল্প। প্রখর কল্পনার আশ্রয়ে বুনন দিতে দিতে সাব্বির জাদিদ গল্পের শরীর বাড়িয়ে তোলেন। মেদহীন বর্ণনা। গভীর পর্যবেক্ষণ ছাড়া একজন সুন্দরীর গালের ওপর থাকা চুলের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে কি তিনি এভাবে বলতে পারেন—‘বিশেষ করে য-ফলা চিহ্নের মতো বাম গালের ওপর লুটিয়ে থাকা একগাছি চুল।’
‘দূরত্ব’ গল্পটি অগভীর হলেও সমসাময়িক সমাজের চেহারার বয়ান এটি। কেবল রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি যে খুব আপন মানুষকেও দূর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, তারই একটি চিত্র। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ভেতরকার থলের সাপ বের করে দিয়েছেন এতে সাব্বির জাদিদ। ‘জাতক ও জন্মভূমি’” গল্পটি আরেকবার ভেতরটা নাড়া দেয়। বেশ খনিকটা উদ্ধৃতি করার ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার আশঙ্কা হয় ঘটনার সংক্ষেপায়নের ফলে যদি কোনো অংশ বাদ পড়ে, তবে গল্পটির মহিমার সঙ্গে অবিচার করা হবে।
‘একটি শোক সংবাদ’ গ্রন্থে গল্পকার সময়কে দেখেছেন তীক্ষ্মভাবে, নিরীক্ষার বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে। গল্প বলার ধরন, গল্পের বুনন, ক্লাইমেক্স তৈরির দক্ষতার বিচারে বলা যায়, তিনি বড় গল্প বা উপন্যাসে হাত দিতে পারেন। এই ক্ষমতা সাব্বির জাদিদের আছে। এই গ্রন্থের অধিকাংশ গল্প পাঠককে আনন্দ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজসচেতনার পরিচয়ও স্পষ্ট করে তুলেছে। এ গল্পগুলোয় আর্থ-সামাজিক বৈষম্য চিত্রায়ণের পাশাপাশি ব্যক্তির মনোসমীক্ষণও চিত্রিত হয়েছে। বোধ করি, গল্পকার হিসেবে সাব্বির জাদিদের সাফল্য এখানেই নিহিত।
একটি শোক সংবাদ
লেখক: সাব্বির জাদিদ
প্রচ্ছদ: কাজী যুবায়ের মাহমুদ
প্রকাশক: ঐতিহ্য
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭
মূল্য: ১৫০ টাকা।