ভিন্ন ভিন্ন সময়ে খালিদ মারুফের লেখা পাঁচটি ছোটগল্প নিয়ে বইটি সংকলিত। গল্পগুলোয় সমকালীন রাজনৈতিক সহিংসতার বিভীষিকা ও মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর দোসরদের নারকীয় অত্যাচার এবং চলমান বাস্তবতায় এর কী প্রভাব ও পরিণতি তার ‘এক অবর্ণনীয়’ বিবরণ ফুটে উঠেছে এই বইয়ে। এটি লেখকের প্রথম বই। ‘জননী ও পুত্রেরা’ এ বইয়ের প্রথম আখ্যান। এতে এক পীড়াগ্রস্ত জননীকে সারিয়ে তুলতে তার জমজপুত্রদের প্রাণান্ত চেষ্টার কাহিনির মধ্যে দিয়ে সমকালীন রাজনীতির সহিংসতার নৃশংস দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে পীড়াগ্রস্ত মায়ের কলজে পচা রোগ সারিয়ে তুলতে দেশের বড় বড় চিকিৎসক যখন ব্যর্থ হয়, তখন তার ছেলেরা এক তান্ত্রিক চিকিৎসকের সন্ধান পায়, যে কিনা ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগকেও নিজের আবিষ্কৃত চিকিৎসা পদ্ধতিতে সারিয়ে তুলতে পারে। কলজে পচা রোগের দাওয়াই তৈরি করতে তার প্রধান উপাদান লাগবে জীবিত মানুষের ঝলসানো প্রত্যঙ্গ। যা জোগাড় করতে নিরুপায় হয়ে শহরের সবচেয়ে বড় লাশ কাটা ঘরের এক নামকরা ডোমের স্মরণাপন্ন হয় জমজেরা। সব শুনে জীবিত মানুষের ঝলসানো প্রত্যঙ্গ জোগাড় করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ওই ডোম। তারপর এক সন্ধায় বাসে আগুন লেগে পুড়ে যাওয়া শত শত যাত্রীর মধ্যে থেকে এক মৃতপ্রায় পরিচয়হীন নারীর দেহ থেকে একটি প্রত্যঙ্গ কেটে জমজদের কাছে বিক্রি করে দেয় মানুষের মাংসখেকো সেই ডোম। যা দিয়ে তৈরি হয় সেই মহৌষধ।
এই বইয়ে সংকলিত দ্বিতীয় আখ্যান ‘ঘর্মাক্ত সন্ধ্যায় তুমি’। এই আখ্যানটি মূলত সংক্ষিপ্ত একটি ভ্রমণ কাহিনীর মাধ্যমে হরতালের আগের সন্ধ্যায় শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় পুড়ে যাওয়া বাসের যাত্রীদের করুণ মৃত্যুর ভৌতিক একটি বর্ণনা। বইটির নাম দেওয়া হয়েছে যে আখ্যানটির নাম অনুসারে তা এই বইয়ের তৃতীয় গল্প—’ইসরাফিলের প্রস্থান’। এটা পাক শাসনামলে গ্রামের এক তেজদীপ্ত তরুণ ইসরাফিল ভূঁইয়ার পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং যুদ্ধের পরে দেশে ফিরে পরিবর্তিত স্বাধীন-সমাজব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা বিষাদময় জীবনের অবসানের একটি গল্প। গ্রামের তরুণদের সঙ্গে কুস্তি, হা-ডু-ডু খেলে সময় কাটতো ইসরাফিলের। কুস্তিতে অপরাজেয় ইসরাফিল হা-ডু-ডুতেও অপ্রতিরোধ্য। একদিন নিজ গ্রামের শীর্ণকায় অঘোর মাঝি তারই প্রতিপক্ষ হয়ে মর্যাদাপূর্ণ এক লড়াইয়ে নেমে ধরাশায়ী করে ফেলে ইসরাফিলকে। সেই পরাজয়ের বেদনা সে ভুলতে পারে না সে কিছুতেই। তাইতো দেশ স্বাধীনের পরও অঘোর মাঝিকে সামনে পেয়ে মালাউন বলে গাল দেয়, প্রতিবাদ করায় সজোরে চড় বসিয়ে দেয় অঘোরের মুখে ও কাঁধে। এমন শৌর্য—বীর্যময় ইসরাফিল যে কিনা এক সময় একাই চার ডাকাতকে শায়েস্তা করে গ্রামের মানুষের কাছে সাহসের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সে-ই বৃদ্ধ বয়সে কলপাড় থেকে ঘরে ঢুকতে গিয়ে সিঁডিতে আছড়ে পড়ে ইহকালের পাঠ চুকিয়ে পরলোক গমন করে।
বইয়ের চতুর্থ আখ্যান ‘তিব্বত ৫৭০’। এই গল্পে হেমো ফহির নামের এক ব্যক্তি যে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত এবং মৃত্যুর পর তাঁকে নিজ হাতে সাবান দিয়ে গোসল করিয়েছিলেন। সেই থেকে হেমো ফহির তিব্বত ৫৭০ সাবান ছাড়া অন্য কোনো সাবান ব্যবহার করে না। হেমো ফহিরের জবানীতে শেখ সাহেবের দাফনকার্য সম্পাদনের ঘটনাটি শুনে এহেন ভক্তি বা ভালোবাসায় আবিষ্ট হয়ে ‘গল্প কথক’ ফিরে এসে হাটের নিকটবর্তী দোকানটাতে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে ‘একটি তিব্বত ৫৭০ সাবান দেন’। এই বইয়ের পঁঞ্চম ও শেষ গল্প ‘সিঁড়ির ধাঁধায় জামালুদ্দিন’। এই গল্পে দেশ স্বাধীনের পর রাজাকার ও তাদের আত্মীয়দের সম্পদশালী হয়ে ওঠা এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারের বিত্তহীন জীবন যাপনের এক অমোঘ বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে। উপস্থাপনের মানদণ্ডে গল্পগুলো অনেকাংশেই সার্থক। এছাড়া সমাজ বাস্তবতার মধ্য থেকে এ ধরনের গল্প তুলে আনার ক্ষেত্রে লেখক গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। ঘটনার নিখুঁত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাঠকের কাছে দৃশ্যগুলো জীবন্ত করে তুলেছে। প্রকাশের ধারায় নতুন এই লেখকের বর্ণনায় একটি ভিন্ন ধারা পরিলক্ষিত হয়। ‘ঘর্মাক্ত সন্ধ্যায় তুমি’ ও ‘সিঁড়ির ধাঁধায় জামালুদ্দিন’ গল্পের বর্ণনায় লেখক অতীতের পরিবর্তে ভবিষ্যত কালের আশ্রয় নিয়েছেন এবং সার্থকভাবে একটি গল্পের চিত্ররূপ ফুটিয়ে তুলেছেন।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। সেটা হলো, অলঙ্কার প্রয়োগ। এর মাধ্যমে লেখক অনেক সাদামাটা বিষয়কেও অসাধারণ করে তুলেছেন। ‘ইসরাফিলের প্রস্থান’ গল্পের একটি জায়গায় লেখক এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘আর যে সব ফসল বর্ষার শুরুতেই রোপার কথা ছিলো, সে ক্ষেত্রেও তারা (গ্রামবাসী-কৃষক) ভূমিকে দেওয়া তাদের কথা রাখতে সক্ষম হয় না।’ আরেক জায়গায় লেখক লিখেছেন, ‘উন্মত্ত ইসরাফিল ভূঁইয়া ধৃত চার ডাকাতের ওপর লোহার রড ও বড় বড় সব গরানডালের নির্যাতন অব্যাহত রেখেছিল ততক্ষণ, যতক্ষণ না সূর্য তাঁর সর্বশক্তি নিয়ে মধ্যাকাশে উঠে এসে উত্তাপ ছড়াতে থাকে।’ বইটির ফ্ল্যাপে গল্পের সারকথা ও লেখকের রচনাশৈলীর যথাপোযুক্ত প্রসংশই করা হয়েছে। ফ্ল্যাপ থেকে দুটি অংশ উদ্ধৃত করছি। ‘এইতো কিছুকাল আগেই এখানে কি অবলীলাক্রমে বিভৎসতম নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে। ক্ষমতাগৃধ্নতা সংহারী হয়ে উঠে নির্বিচারে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নিরাপরাধ মানুষকে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মেরেছে।’ ঘটনার উন্মোচন ও বর্ণনার সৌকর্য বিবেচনায় আখ্যানগুলো যাদুবাস্তবের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে।
গল্পে মনস্তত্ত্বিক অভিঘাত ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করেছেন। বোঝা যায়, তিনি মানুষের জীবনের দিকে ঝুঁকেছিলেন তীব্র আসক্তি নিয়ে। আর তা থেকে তিনি যা পেয়েছিলেন, তা বলার সময় তিনি ছিলেন ততধিক নিরাসক্ত।