সমাজ বাস্তবতায় পুরুষের তুলনায় নারী যে অনেক পিছিয়ে আছে, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কেন তারা পিছিয়ে আছে, কাদের কারণে এই অনগ্রসরতা, তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। পার্থক্য হলো কেউ স্বীকার করেন, কেউ করেন না। অবশ্য কেউ আবার জোর করেও নিজেদের পক্ষে মতো প্রতিষ্ঠিত করতে চান। এ নিয়ে নতুন করে জাবর কাটার কোনও অর্থ নেই। স্বয়ং তলস্তয়ের মতো মানুষ বলেছেন, নারী না কি সমাজ জীবনে এক অনিবার্য নিরানন্দের উৎস। তাই কঠোর এই পেরেকঠোকা ক্রুশ কাঠের সমাজে নারী যখন তার নিজস্ব কোনো গুঢ় আনন্দ-নিরানন্দভঙ্গি প্রকাশ করেন, সেটি আমার দেখতে ভালো লাগে। দেখার বিষয় তার প্রকাশ ভঙ্গিটা কতটুকু সম্পূর্ণ আর কতটুকু অসম্পূর্ণ। এ সব ভাবতে ভাবতেই ঢাকার ‘প্রমত্ত’ জ্যাম উপেক্ষা করে সেদিন দেখে এলাম রুবাইয়াত হোসেনের ছবি আন্ডার কনস্ট্রাকসন। সত্যি কথা বলতে, খুব বেশি আশা নিয়ে সিনেমা হলে ঢুকিনি। সমকালের নতুন সিনেমা নামে বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তা আমাকে আশাবাদী করার চেয়ে অধিকাংশ সময়েই হতাশ করেছে। তারপরও বলাকা সিনেমা হলে আমিসহ জনা ২০ দর্শক নিয়ে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অজ্ঞাত কারণে ১৫ মিনিট দেরিতেই শুরু হলো ছবি।
আন্ডার কনস্ট্রাকসন ছবিটিতে অন্য সাধারণ বাংলা ছবির মতো খুব বেশি ক্লাইম্যাক্স বা উত্তেজনাকর পরিস্থিতি, দৃশ্য না থাকলেও সেটি দেখতে এতটুকু খারাপ লাগছিল না। এমনকি সিনেমা দেখতে দেখতে সেটির অভাবও বোধ করিনি। শুরুতে আর্টফিল্ম আর্টফিল্ম বলে কানাঘুষা করা একটি দম্পতি চুপ করে পুরো সিনেমাটি দেখলেন। সিনেমা সফল নাকি ব্যর্থ তার মূল নির্ধারক যদি দর্শক হয় তাহলে কোনও আলোচনা-সমালোচার আগে তাদের পর্দার কাহিনির গতি প্রকৃতিতে ধরে রাখার জন্য পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন প্রশংসা পেতেই পারেন।
আমার কাছে সিনেমাটির মূল আকর্ষণীয় চরিত্র লেগেছে ৩০ বছর বয়সী থিয়েটার কর্মী রয়া আর তার মায়ের চরিত্রটি। আধুনিক শহুরে সমাজে নারীবাদ-পুরুষবাদ-সাম্যবাদের জগাখিচুড়ি বিজ্ঞাপনে একজন নারী ভেতরে ভেতরে কখনো নারী, কখনো মা, কখনো বা শুধুই মানুষ হয়ে ওঠার অন্তর্দ্বন্দ্ব দুজনের চরিত্রটিতে অসাধারণভাবেই এসেছে। নিজের মতো করে কাজ করতে চাওয়া আর বাঁচার স্বপ্ন দেখা রয়ার ভেতর ভেতর নিয়ত ভাঙন সত্যিই সচেতন মানুষকে ভাবাবে। আর স্বামী পরিত্যক্তা রয়ার মা যখন আশাবাদী হন যে, তার স্বামী একদিন ফিরে আসবেই। কিংবা স্বামীর ছবির পাশে যখন তিনি মাথায় ঘোমটা টানেন, তখন তার চরিত্রটি রয়ার জটিল রৈখিকতার ঠিক বিপরীত অবস্থানে দাঁড়ায়। আবার সন্তানদের ছেড়ে থাকা রয়ার মাকে যখন আমরা তার একাকি জীবনে স্বাবলম্বী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে দাঁড়াতে দেখি তখন তার সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টাতে শুরু করে। তার ভেতরের শক্তিটুকু টের পাওয়া যায় একটি কথাতেই। যখন তিনি তার মেয়েকে বলেন, ‘শোন রয়া, আমি কিন্তু আমার স্বামীর টাকায় ফুটানি করি না।’
এছাড়া, সিনেমাটির একটি দুর্দান্ত আইডিয়া মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর নয়া ইন্টারপ্রিটেসনের ধারণা। থিয়েটারকর্মী রয়া রবীন্দ্রনাথের এই নাটকটিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন করে নির্মাণ করে চেষ্টা করেন নন্দিনীকে নিজের মতো আবিষ্কারের। নিজের ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা এবং লক্ষ্য পূরণের নিঃসঙ্গ যাত্রায় রয়ার উপলব্ধির চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় নন্দা বা নন্দিনী। রাজধানীর পোশাক কারখানাগুলোর আদলে তৈরি সেটে মঞ্চে রয়া নন্দিনীকে সাজায় যান্ত্রিক বন্ধনে আবদ্ধ এক মুক্তির প্রতীক হিসেবে। আর নাটকের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠায় রয়ার নিজস্ব যাত্রা একপর্যায়ে তাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় গৃহকর্মী ময়নার সামনে। যখন ভালোবেসে লিফ্টম্যানকে বিয়ে করে অন্য এক যাত্রার স্বপ্ন দেখা অন্তঃস্বত্ত্বা ময়না নিজের মধ্যে আবার নিজেকে ভাঙতে গড়তে ব্যস্ত। ময়নার যখন রয়াকে বলে—‘আফা আমার বাচ্চাটার একটা সুন্দর নাম দেবেন’। কিংবা ‘আফা, আমি কি সারাজীবন মানুষের বাসা-বাড়িতে কাম করমু?’ তখন তার কথায় যেন অন্য কিছুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আর তার এই যাত্রার স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে রয়ার দেওয়া উপহার ফিরিয়ে দিয়ে যখন ময়না বলে—‘আফা, এগুলা আফনের কাছে থাক, উনি দেখলে নিয়া যাবেন।’
প্রশ্ন হচ্ছে, চলচ্চিত্রটিতে এই তিন নারীর যে জীবন, উপলব্ধি দেখানো হয়েছে তা কি পরিচালক নির্মাণ সম্পন্ন করেছেন। দর্শক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, রুবাইয়াৎ হোসেন শুধু শহুরে তিন নারীর গল্প বললেও, পৃথিবীর প্রতিটি জায়গাতেই নারীরা নিজেদের মধ্যেই প্রত্যহ নির্মাণাধীন। দেখা যায়, যে উপলব্ধিটাকে আজ তারা আঁকড়ে ধরছেন, পরক্ষণেই তা স্ববিরোধিতায় রূপ নেয়। কখনো কখনো তারা সীমার কঠিন শৃঙ্খল ভাঙতে চান, কিন্তু সমাজ হোক বা নিয়মের ফেরে পড়ে আবারও এক এক অদ্ভূত গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকেন। এ কারণেই হয়তো বলা হয়, নারীর মন স্বয়ং ঈশ্বরও উপলগ্ধি করতে পারেন না। কারণ আমাদের প্রচলিত ঈশ্বরতো পুরুষতান্ত্রিকতারই প্রতীক। সৃষ্টির শুরু থেকে ভেতরে-বাহিরে সতত নির্মাণাধীন নারীর এই গল্প তাই কখনোই শেষ হয় না। রুয়াইয়াৎ হোসেনকে ধন্যবাদ যে, তিনি তার গল্পের ইতি টানেননি।
আন্ডার কনস্ট্রাকসন ছবিতে আরেকটি ভালো লাগার বিষয় ছিল এর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। অধিকাংশ সময়েই যান্ত্রিক ঝালাইয়ের আওয়াজ, হাঁতুড়ির ঠুকঠাক আমাদের নির্মিতব্য কোনও কিছুর কথাই মনে করিয়ে দেয়। শব্দের এই বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার জন্যও ছবিটি বেশ ভালো লাগে।
আর এর অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীরা তাদের সাধ্যের পুরোটুকু দিয়েই যে অভিনয় করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখেন না। ভাবগম্ভীর করপোরেট মানুষ হিসেবে রয়ার স্বামীর চরিত্রে সুঅভিনেতা শাহদাত হোসেন ছিলেন যথেষ্টই মানানসই। তবে রয়ার থিয়েটারের অধিকর্তা রাসেল ভাই চরিত্রে তৌফিকুল ইসলাম ইমনের অভিনয়ও চমৎকার। ইমন ভাই নিজে থিয়েটারের মানুষ। তাই আজো থিয়েটারের মানুষের মধ্যে আদি অকৃত্রিম রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে রোমান্টিসিজম কাজ করে তার রূপটি তিনি ভালোই দেখিয়েছেন। একেবারেই ভালো লাগেনি রয়ার বান্ধবীর চরিত্রটি। আর ইমতিয়াজ চরিত্রে বলিউড অভিনেতা রাহুল বোস ভালো মানানসই অভিনয় করলেও তাকে কি শুধুই সিনেমার ব্যবসার কথা মাথায় রেখে কাস্ট করা হয়েছে কি না তা পরিচালকের কাছে প্রশ্ন রইল। কারণ আমার মনে হয়েছে, ইমতিয়াজ চরিত্রটিতে অভিনয়ের জন্য আমাদের দেশেই অনেক শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন। এর জন্য বলিউডের দিকে হাত বাড়াতে হয় না।
যদিও রয়া চরিত্রটি যেন শাহানা গোস্বামীর জন্যই তৈরি হয়েছে, অসাধারণ অভিনয় করেছেন তিনি। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েই অভিনয় করেছেন আমাদের মিতা চৌধুরী। অসাধারণ দুটি চরিত্র চিত্রায়নের জন্য তারা দুজন ধন্যবাদ পেতেই পারেন।