কুকুরকে বলা হয় প্রভুভক্ত প্রাণী। কুকুর খুব সহজেই পোষ মানে। সামান্য কিছু খাবার দিলেই কুকুর পোষা হয়ে যায়। একবার পোষা হলেই সেই কুকুর আর কখনো মনিবের সঙ্গে প্রতারণা করে না, বেঈমানি করে না । কিন্তু যে কুকুর পোষা নয়, যে কুকুরকে কেউ কোনোদিন খাবার দেয় নি সেই কুকুরকি কখনো কারো পোষা হয়? কুকুরের কি ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা আছে?
এমনি একটি কুকুরের চরিত্র নিয়ে এবারের বইমেলায় বেরিয়েছে কাজী মহম্মদ আশরাফ-এর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘আকালু’। ‘আকালু’ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক হলেও এটি সম্পূর্ণরূপে একটি ভিন্নধর্মী উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একটি কুকুর। মুক্তিযোদ্ধারা কুকুরটির নাম দিয়েছিলেন ‘কালু’। তাঁরা কুকুরটিকে ডাকতেন ‘আয় কালু’ বলে। ‘আয় কালু’-ই বিবর্তিত হতে হতে ‘আকালু’ হয়ে গেল অল্প সময়ের ব্যবধানে। তবে এরও আগে কুকুরটির অন্য একটি নাম ছিল। মিন্টু।
লেখক তাঁর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ‘মিন্টু’ জন্ম বৃত্তান্ত দিতে গিয়ে বলেন, ‘মিন্টুর জন্ম মহাকালী ইউনিয়নের বাগেশ^রে। কুমার পাড়ার পাশের এক মুসলমান বাড়িতে।’ জন্ম থেকেই মিন্টু ছিল কিছুটা দূর্বল। আর সবলের দুনিয়ায় দূর্বলরা বরাবরই বঞ্চিত হয়। বঞ্চিত হয় ভাই বোন দ্বারা, পরিবার পরিজন দ্বারা, সমাজ সংসার দ্বারা। তাইতো দূর্বল মিন্টুর ভাগ্যেও অন্য ভাইবোনদের সমান খাবার জুটতো না। ‘ মায়ের স্তন্য থেকে বঞ্চিত হতো। ঝগড়া করে পারতো না ভাই- বোনদের সঙ্গে। তাকে গুঁতিয়ে দূরে সরিয়ে রাখত তারা।’ একদিন বাড়ির ছেলেরা তাকে রাস্তার একটা সাঁকোর সামনে ফেলে দেয়। সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিল আনন্দ নামের এক যুবক। এই যুবকই কুকুরটিকে উদ্ধার করে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায় এবং এর নাম দেয় মিন্টু। দূর্বল-সবলের এ যেন চিরায়ত দৃশ্য। দূর্বলরা বরাবরই অন্যের দ্বারা শাসিক, নিষ্পেষিত, নির্যাতিত। দূর্বলরা অন্যের করুণার পাত্র।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আনন্দ ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শুরু হয় মিন্টুর যাযাবর জীবন। যাযাবর জীবনের শুরুটা হয় মাস্টার সাহেবের বাড়ি দিয়েই। উপন্যাসের শুরুতে মাস্টার সাহেবের বাড়ির বর্ণনা পাওয়া যায় যার শুরুটা এমন—‘বাড়িটা ভালো লেগেছে মিন্টুর। সদর রাস্তার ধারে। রাস্তার কিনারে দেড়পুরুষ সমান উঁচু ঝুমকো-জবা ফুলের বেড়া। বাড়িটা রাস্তা থেকে একটু নিচু। দেড় হাত পরিমাণ ঢালু থেকে নামলে প্রথমেই ডানপাশে গাছপালা আর খোলা জায়গা। বামপাশে পারিবারিক কবরস্থান। …’
মিন্টু নামকরণের কি কোনো তাৎপর্য আছে?
অবশ্যই আছে। লেখক তা সচেতনভাবে প্রকাশ করেছেন মাস্টার সাহেবের জবানিতে। মাস্টার সাহেব বললেন, ‘বিলাতিরা দুইশ বছর আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছে আর তাদের নামে আজকাল আমাদের সন্তানদের নামও রাখি, তাই না? আর তুমি লাটসাহেবের নামে কুকুরের নাম রেখেছ!’
যে ব্রিটিশরা আমাদের অন্যায়ভাবে শোষণ করেছে দুই শতাধিক বছর তাদের নামেই আমরা আমাদের সন্তানদের নাম রাখি। মাস্টার সাহেবের এই স্বীকারোক্তির মধ্যে কি কোনো শ্লেষ নেই? নইলে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসে কোনো উপলক্ষ ছাড়াই ব্রিটিশ শাসনের কথা আসবে কেন?
‘যুদ্ধ আসলে সব কিছু উল্টেপাল্টে দেয়, মানুষকে নগ্ন করে দেয়, গোপনীয়তা প্রকাশ করে দেয়।’ যুদ্ধ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য এমনই। তবে একটি যুদ্ধ কেবল সৈনিক ও যোদ্ধার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনা। তা সকল মানুষের মধ্যেই এক নির্দয়, করুণ, অমানবিক এবং অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র রুমার উপলব্ধির মাধ্যমে লেখক তার যথার্থ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। রুমার স্বগতোক্তিটি এমন—‘এখন সে বুঝতে পারে যুদ্ধের ভয়াবহতা আসলে যোদ্ধা ও সৈনিকের মধ্যে থাকে না। তার মতো নিরীহ সাধারণ মানুষেরাও যে কতটা ভুক্তভোগী তা আগে ধারণাই ছিল না।’
যুদ্ধ আসলে সবার জীবনকেই লণ্ডভণ্ড করে দেয়। সবাইকেই বিপর্যস্ত করে তোলে। কেবল মানুষের জীবনই নয়, যুদ্ধ অন্য সব প্রাণীর জীবনকেও বিপর্যস্ত করে তোলে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মিন্টুর জীবনও যুদ্ধের কারণে লণ্ড ভণ্ড হয়ে গেছে। যুদ্ধের কারণেই তাকে তার প্রথম মনিব আনন্দকে হারাতে হয়েছে। নাসিরকে হারাতে হয়েছে। রুমাকে হারাতে হয়েছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত তার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বদরউদ্দিন কাজীকেও হারাতে হয়েছে। যুদ্ধ অসংখ্য মানুষের মতো, মিন্টুর জীবনকেও প্রকৃত অর্থেই যাযাবর করে তুলেছে।
উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই মিন্টুর সরব উপস্থিতি। মিন্টুই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। মিন্টুই উপন্যাসের নায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরোচিত যুদ্ধের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই যুদ্ধে একটি দুর্বল অবলা প্রাণী, যে কিনা সবার অনাদরে বড় হয়ে উঠেছে, সে-ই একজন প্রকৃত সহযোদ্ধার মতোই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল—এই কাহিনী খুব কম মানুষেরই জানা।
একটি খণ্ড যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক উপন্যাসের এক জায়গায় বলেন, ‘মিন্টু অপরিচিত লোকগুলোকে গ্রামে ঢুকতে দেখে সন্দেহ করে প্রথমে বাধা দিয়েছে। পরে তাকে গুলি করার হুমকি দেওয়ার পরে সে ঘেউ ঘেউ করকে করতে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে দ্রুত ক্যাম্পের দিকে দৌড়ে চলল। সেখানে গিয়ে সে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হলো যে, কুকুরটা নিশ্চয়ই সন্দেহজনক কিছু দেখে এসেছে। প্রায় পনেরো জনের একটি দল অস্ত্র নিয়ে রেডি হয়ে কুকুরের দেখানো পথ ধরে এগিয়ে চলল। অনেকটা দূর থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা উঁচু রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাদের দেখতে পেলেন। পথে কয়েকজন লোক জানাল, গ্রামে মেলেটারি ঢুকেছে। তারা সড়ক পথে না গিয়ে ভিটা, পানের বরজ আর ঝোপের ভেতর দিয়ে দোকানটার একটু পেছনে গিয়ে ওঁত পেতে বসে রইলেন। মোড়টা ঘুরতেই পেছনের সৈন্যটিকে করা গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মাথায় না লেগে ঘাড়ে লেগেছে।
সামনা-সামনি গোলাগুলি চলছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটা দল পেছনের দিক থেকে আক্রমণ শুরু করেছে। দুই দিকের সঙ্গে পেরে উঠল না মেলেটারি। কয়েকজন মারা গেল আর কয়েকজন আহত ও সুস্থ অবস্থায় ফিরে গেল।’
আরও একটি যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায় উপন্যাসটিতে যার প্রধান নায়ক মিন্টু।
লেখকের ভাষায়: ‘হঠাৎ ডান দিকে দেখতে পেল প্রায় দশজন মেলেটারি। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়েছে মাথা নিচু করে অস্ত্র তাক করে এগিয়ে যাচ্ছে। কালু বুঝতে পারল এরা শত্রু। কাউকে মারার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। সে বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করতে লাগল।
সামান্য দূরেই মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন খেতে বসেছিলেন। কালুর চিৎকারে খাওয়া ফেলে নিঃশব্দে অস্ত্র হাতে লাফিয়ে উঠলেন। বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেলেটারিদের কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হলো। কয়েকজন পালিয়ে গেল।’
উপন্যাসের শেষ দৃশ্যে মেলেটারিরা যখন মিন্টুর সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বদরউদ্দিন কাজীকে মেরে ফেলল তখন মিন্টু তা মেনে নিতে পারল না কোনোমতেই। লেখকের ভাষায়, ‘কালু তার চোখের সামনে মনিবকে মেরে ফেলতে দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। মনিবের মৃত্যুটা সে মেনে নিতে পারল না। প্রচণ্ড শব্দে ঘেউ ঘেউ করতে করতে মেলেটারিদের দিকে এগিয়ে গেল। একজনের হাঁটুর কাছে কামড় বসিয়ে দিল। জীবনে এই প্রথম কালু কাউকে কামড় বসাল। একজন মেলেটারি কালুকে পর পর তিনটা গুলি করল। গোঙাতে গোঙাতে কালু ভিটার কিনার থেকে ঢালু বেয়ে গড়িয়ে কিছুটা নিচে পড়ে একটা হিজলগাছে আটকে রইল।’
মিন্টুর মৃতদেহ সৎকারের কোনো ব্যবস্থা হলো না, মাটিচাপাও দেওয়া হলো না, যেমন হলো না অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবীর।
আকালু
লেখক: কাজী মহম্মদ আশরাফ
প্রকাশক: বেহুলা বাংলা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী