তরুণ কথাকার সাদাত হোসাইন ইতোমধ্যে পাঠকের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। তার ‘আরশিনগর’-পরবর্তী উপন্যাস ‘অন্দরমহল’ সেই যাত্রায় আরও সমৃদ্ধযাত্রী। দীর্ঘ নিরীক্ষা, গবেষণা, পরিশ্রমের পর একেকটি শক্তিশালী বিস্ফোরক নিয়ে হাজির হন তিনি।
সাদাত হোসাইনের তৃতীয় বা বৃহৎ কলেবরের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অন্দরমহল’। নামের সঙ্গেই যেন জুড়ে আছে একটি রাজপরিবারের গোপন ইতিহাস। যে অন্দরমহলের খবর আমরা কখনোই পাই না। এমনকি ইতিহাসেও তা থেকে যায় ধোঁয়াশার মতো। তেমনই এক মহলের অন্দরের খবর তুলে এনেছেন লেখক। তবে এ খবর একান্তই তার কল্পনার নির্যাস। বাস্তব ঘটনার সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল নেই। লেখকের সার্থকতা এখানেই—একটি কাল্পনিক কাহিনিকে বাস্তবতার আদলে সুনিপুণভাবে নির্মাণ করেছেন। যার কোথাও একটু কল্পনার ছোঁয়া নেই। নেই অবিশ্বাস বা অতিরঞ্জিত আবেগ। তার শক্তিশালী লেখনীই পেরেছে ৪৩৮ পৃষ্ঠার এমন একটি দীর্ঘ উপন্যাসকে গড়ে তুলতে।
উপন্যাসের শুরুতেই চমকে দিতে পেরেছেন তিনি। প্রথম বাক্যে চোখ পড়তেই নড়েচড়ে বসবেন পাঠক। কেননা তিনি একটি রহস্য রেখেই নির্মাণ করেছেন প্রথম বাক্য। প্রথম বাক্যেই নিহিত রয়েছে পুরো অন্দরমহলের ইতিহাস। ‘ভয়াবহ দুঃসংবাদটা এলো রাত্রির তৃতীয় প্রহরে।’ এমন একটি দুঃসংবাদের মধ্যদিয়েই কাহিনি শুরু। সে দুঃসংবাদটি একটি বসন্তআক্রান্ত শিশু বিভূঁইকে নিয়ে। সেই শিশুটি আবার এই জমিদার বংশেরই সন্তান। এভাবে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আক্রান্ত হতে থাকে অন্দরমহলও। শুধু শুরুতেই নয়, এমন ভয়াবহ দুঃসংবাদ উপন্যাসের পুরোটাজুড়েই রয়েছে। শেষাবধি মহা-পতনের মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে অন্দরমহলের গল্প।
সাদাত হোসাইনের উপন্যাস ‘অন্দরমহল’ কেবল একটি জমিদার মহলের অন্দর নয়, বিস্তৃত চোখে দেখলে এ অন্দরমহল একটি মনের অন্দরমহল, একটি পরিবারের অন্দরমহল, একটি সমাজের অন্দরমহল, একটি রাষ্ট্রের অন্দরমহল, সর্বোপরি একটি বিশ্বের অন্দরমহল। এ অন্দরমহল একজন অত্যাচারী মানুষের কু-কীর্তির, একটি দেশের ক্ষমতার দম্ভের, বিশ্ব রাজনীতির—এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতার অন্দরমহল। যে মহল কেবল ক্ষোভ, জিঘাংসা, লোভ, হঠকারিতা, প্রবঞ্চনা, চৌর্যবৃত্তি, পরকীয়া, অত্যাচার, দুঃশাসন, খামখেয়ালী, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনে ভরপুর। যাবতীয় নেতিবাচক গুণাবলী দিয়ে ভরপুর এ অন্দরমহল। সেই ‘বিষবৃক্ষ’ থেকে শুরু করে সব ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক উপন্যাসের আদলে গড়ে ওঠা এ অন্দরমহল। এ অন্দরমহলের নারী চরিত্রগুলোও বেশ সক্রিয়। জীবনবোধেও অগ্রগামী। এটি নারীপ্রধান উপন্যাস না হলেও নারীর ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে পুরুষ। কেবল জমিদারের মেজপুত্র স্বঘোষিত জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণকে বাদ দিলে অন্য পুরুষেরা স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেননি। উপন্যাসের নারী চরিত্র বাঈজী হেমাঙ্গিনী দেবী, জমিদারপত্নী বীণাবালা, জমিদারকন্যা সর্বজয়া, দাসী কমলা, অতসী বালা, তপতী- নারীদের প্রতিবাদী রূপ।
ক্ষমতালিপ্সু পুরুষকূল বার বার তাদের কাছে পরাজিত হয়েছে। পরাস্ত হয়ে নতি স্বীকার করেছে। যদিও এজন্য তাদের কাউকে-কাউকে সম্ভ্রম হারাতে হয়েছে। স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিতে হয়েছে সতীত্ব। ফলে প্রতিবাদী হয়েছে তারা। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তারা পুরুষের বিষদাঁত ভেঙে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে।
ধারণা করা যেতে পারে—নারীর কারণেই পৃথিবীর প্রথম অনাসৃষ্টি, প্রথম হত্যাকাণ্ড, প্রথম যুদ্ধ ও ধ্বংস। ঠিক সেভাবেই অন্দরমহলের পতনের বীজও বুনে দিয়েছে বাঈজী ও রক্ষিতা হেমাঙ্গিনী দেবী। জমিদারের লালসার বীর্য ধারণ করেই গঙ্গামহলের পতনঘণ্টা বাজিয়েছেন তিনি। তবে জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ নন, তার পুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণ সে বীর্যের মালিক; তা প্রকাশ্যে না আনলেও পাঠকের বুঝতে বাকি নেই। বসন্ত রোগে অন্ধ হওয়া বিভূঁই কার সন্তান? তা কেবল হেমাঙ্গিনী দেবী ও হরিহরণ জানলেও শেষাবধি রহস্য থেকে যায় দেবেন্দ্রনারায়ণের কাছে। বিষয়টি আকাঙ্ক্ষিত হলেও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন লেখক।
ক্ষমতাশীল বা শাসকদের অত্যাচার, খামখেয়ালি, নারীলিপ্সা চিরাচরিত নিয়ম। ক্ষমতার কাছে সব নারীই যৌনসঙ্গী। অন্দরমহলেও বিষয়টার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পুরুষানুক্রমিক জমিদারী প্রথা। জমিদারের একাধিক নারীগ্রহণ। যৌনতৃষ্ণা, মদপান, মানুষ হত্যাকাণ্ড সবকিছুই গতানুগতিক নিয়মে সংঘটিত হয়েছে।
পুত্রসন্তান বংশের বাতি। প্রচলিত এ ঘটনার ব্যত্যয় ঘটেনি। জমিদার যোগেন্দ্রনারায়ণ তিনটি বিয়ে করেন। তার কনিষ্ঠ স্ত্রীর গর্ভে জন্ম নেন বিষ্ণুনারায়ণ। তবে বিষ্ণুনারায়ণে এসে ঘটনা মোড় নিয়েছে অন্যদিকে। তার ঔরসে জন্মে তিনটি পুত্রসন্তান। তবু নারীলোভী জমিদাররা যৌনতায় সংযমী ছিলেন না। যোগেন্দ্রনারায়ণের দস্যুবৃত্তি মোড় ঘুরিয়ে দেয় একটি ব্যবসায়ী পরিবারের। যার পরবর্তী উত্তরসূরি হরিহরণ বণিক ও হেমাঙ্গিনী দেবী প্রতিশোধপরায়ণ হয়েই গঙ্গামহলের বিনাশ সাধন করেন। দস্যু জমিদারের মহলে বেড়ে ওঠা হেমাঙ্গিনী দেবী মধুর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন দেবেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে মুখ না খুললেও ভালোভাবে নেননি জমিদার বিষ্ণুনারায়ণ। তিনি কৌশলে হেমাঙ্গিনী দেবীকে আলাদা করেন দেবেন্দ্রর হাত থেকে। নিজেও ভোগ করেন টানা পনেরো দিন। তারপর নির্বাসনের আদলে আবাসনের ব্যবস্থা করে দেন। সেই থেকে হেমাঙ্গিনী পুরুষের খেলার সামগ্রী। পরবর্তী সময়ে সেই হেমাঙ্গিনীর হাত ধরেই ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায় অন্দরমহল।
বড় বিচিত্র এ অন্দরমহল। একই মহলে বিভিন্নজনের বিভিন্ন রূপ। একেকজনকে চেনা বড় দায়। কেননা জমিদারের বড়পুত্র অবনীন্দ্র নাপরায়ণ বাউল ও গৃহত্যাগী। মেজপুত্র দেবেন্দ্রনারায়ণ বদমেজাজের কারণে বিভিন্নভাবে চক্রান্তের শিকার। ছোট পুত্র দীপেন্দ্রনারায়ণ ধূর্ত ও মিনমিনে স্বভাবের। অবনীন্দ্রনারায়ণের একমাত্র ছেলে দ্বীজেন্দ্রনারায়ণ হিংসুটে ও অত্যাচারী।
অন্দরমহলে ঘটতে থাকে নানারকম ট্র্যাজেডি। ছেলে দেবেন্দ্রর প্রেমিকা হেমাঙ্গিনীকে কৌশলে ভোগ করেন বাবা বিষ্ণুনারায়ণ। এছাড়া তর্ক করার প্রতিশোধ নিতে দ্বীজেন্দ্রর নির্দেশে মধু কর্তৃক ধর্ষিত হয় দেবেন্দ্রনারায়ণের বড় মেয়ে সর্বজয়া।
অন্দরমহলের ঝনঝনানি কেমন যেন ক্রমান্বয়ে ধূলিসাৎ হতে থাকে। কোথাও আনন্দের রেশ মাত্র নেই। সবার মনেই হতাশা ভর করে। কারও অবস্থানেই কেউ শান্তিতে নেই। যার প্রকাশ দেখি আমরা অবনীন্দ্রনারায়ণ, রতনকান্তি ও বিভূঁইয়ের ভেতরেও। লেখক স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আনন্দ থাকে কোথায়? মানুষ সেই আনন্দের জন্যে কতকিছুর পিছু ছোটে। কিন্তু মানুষ জানে না, সেই আনন্দের উৎস তার বুকের ভেতর তার বুকের অন্দরমহল।’
বিষ্ণুনারায়ণের মৃত্যুর পর বড়ছেলে অবনীন্দ্রনারায়ণকে জমিদার বানানো হলেও তিনি নির্বিকার। মুক্তি চান এই কঠিন দায়িত্ব থেকে। তিনি আত্মভোলা গানপাগল বাউল মানুষ। তার কাছে গানই সব। তাই তার কণ্ঠে লেখক শোনান—‘মরিবার তরে বাঁচিয়া রয়েছি, বাঁচিবার তরে নহে/জনম গিয়েছে ভোগে আর ভাগে, কিছুই পড়ে না রহে।’ উপন্যাসে এমন বেশ কয়েকটি গান অবনীন্দ্রনারায়ণ ও রতনকান্তির কণ্ঠে শোনা যায়।
এখানে একটি কথা বলে নেওয়া ভালো যে, লেখক চরিত্র সৃষ্টি, সংলাপ ও কাহিনি রচনার পাশাপাশি উপন্যাসের স্থান-কাল-পাত্রের উপযোগী করে বেশ কিছু গানও রচনা করেছেন। এদিক থেকে সাদাতকে একজন গীতিকবি হিসেবেও অভিহিত করা যেতে পারে।
রতনকান্তি ও অবনীন্দ্রনারায়ণ সংগীতের সাধনা করেন। গানের ভেতরেই তারা জীবনের মানে খোঁজেন। গানের সাধনাকে তারা অন্তরের সাধনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কেননা অবনীন্দ্রনারায়ণ মনে করেন—‘নিজের অন্তর ছাড়া সাধনা করার আর কিছু জগতে নেই। মিছেমিছি আমরা আলেয়ার পিছু ছুটে মরি। এই অন্তরের সাধনার চেয়ে বড় আর কী আছে!’
এদিকে বসন্ত রোগে আক্রান্ত দেবেন্দ্র নারায়ণ জমিদারি হারিয়ে দিশেহারা। নানাবিধ চক্রান্ত তাকে যখন পরাস্ত করে, তখন তার অনুভূতি এরকম—‘জিততেই হবে। যেকোনো উপায়ে জিততে হবে। এই জেতার জন্য জীবনজুড়ে এমন কোনো কাজ নেই যা করিনি। এই যে এত জিতলাম, এর মূল্য কী? শেষ অবধি সকলই তো ওই শূন্য।’
___________________________________________________________________________________
ক্ষমতার এই এক যন্ত্রণা। ক্ষমতায় বন্ধু তৈরি হয় নকল, স্বার্থান্বেষী কিন্তু শত্রু তৈরি হয় শতভাগ খাঁটি, নির্ভেজাল।
___________________________________________________________________________
উপন্যাসে গভীর জীবনবোধ লক্ষ করা যায়। লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, ‘কী আশ্চর্য এই মানবজনম। যার পুরোটাজুড়ে এমন করেই কেবল লেখা থাকে আক্ষেপের গল্প। মানুষ আসলে রোজ রোজ জীবনের নামে যা যাপন করে তার নাম আক্ষেপ জনম। শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য তাই জীবনের অন্য নাম হয়ে থাকে কেবলই আক্ষেপ। পাতার পর পাতা জটিল সব হিসেব কষে সে জীবনের ফল পায় শেষ অবধি শূন্য।’
অন্দরমহলের পুরোটাজুড়েই যেন আক্ষেপে ভরপুর। আক্ষেপ প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে। আসলেও তো তাই। জীবনজুড়ে প্রত্যেকেই আক্ষেপ করেন। এত এত থাকতেও সন্তুষ্ট থেকেছে কতজন? অন্দরমহল সেই আক্ষেপের ছবিই এঁকেছে। যেমন—জমিদারের বড়পুত্র অবনীন্দ্রনারায়ণের স্ত্রী বীণাবালা ক্ষমতালিপ্সু ও পরকীয়ায় আসক্ত। যদিও বিভূতি নাথের সঙ্গে তার সম্পর্কটা শেষে এসে উন্মোচিত হয়। কিন্তু এর আক্ষেপ সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন অবনীন্দ্রনারায়ণ। অন্যদিকে বীণাবালার অনুভূতি এরকম, ‘ক্ষমতার এই এক যন্ত্রণা। ক্ষমতায় বন্ধু তৈরি হয় নকল, স্বার্থান্বেষী কিন্তু শত্রু তৈরি হয় শতভাগ খাঁটি, নির্ভেজাল।’
বিস্তৃত কলেবরে কাহিনি বর্ণিত হলেও মূলত গঙ্গামহল নামের জমিদার বাড়ির অন্দরমহলের ঘটনাই উপন্যাসের উপজীব্য। কাহিনিতে প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে বিরামপুর, বারোহাটি, বাগানবাড়ি, চন্দ্রদীপপুর, বিষ্ণুপুর, বজরাডুবির চর, দীঘাগড়, বেনুচন্দের বাজার প্রভৃতি স্থান। এছাড়া এ উপন্যাসে গঙ্গাবতী নদীর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। স্থানের পাশাপাশি উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে হরিহরণ বনিক, রতনকান্তি, ভূজঙ্গদেব, দাসী তপতী, দেবেন্দ্রর স্ত্রী রেণুকা, রামচরণ, অপলা, নিতাই, জগাই, সনাতন কারিগর, বিভূঁই, খগেন, কমলা দাসী প্রভৃতি।
যাকে দিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনি শুরু; সেই হেমাঙ্গিনী দেবী একসময় জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ান। তার মুখেই লেখক বলেন, ‘আমরা সকলেই পালাচ্ছি হরিকাকা। এই জগত পালানোরই জগৎ। এখানে দিনরাত লুকোচুরি খেলা চলে। এই খেলায় সকলকেই পালাতে হয়। আগে আর পরে। অন্যের কাছ থেকে হোক বা নিজের কাছ থেকে, মানুষকে তার জীবনভরই পালাতে হয়।’
অন্দরমহলকে লেখক কেবল মায়া আর দুঃখ দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। সেখানে জীবনজুড়ে মায়া, তার বিনিময়ে কেবল দুঃখ। এ প্রসঙ্গে লেখক বলেন, ‘এই জগতের সকলই মায়া। সকলই শূন্য। হঠাৎ সব মিলিয়ে যাবে। দীর্ঘ ঘুম বা মৃত্যুর শেষে সে জেগে উঠেছে অন্য এক বিভ্রমের জগতে।’ লেখক অন্যত্র বলেন, ‘দুঃখ মানব জীবনের সবচেয়ে গভীরতম অনুভূতি। মানুষ তার জীবনের সকল আনন্দময় অনুভূতির কথা অবলীলায় ভুলে যেতে পারে। কিন্তু দুঃখের কথা ভোলে না। সে দুঃখদের বুকের ভেতর পুষে রাখে সারাজনম।’
অন্দরমহলের পরিচয় দিতে গিয়ে লেখকই বলেছেন, ‘সামনে অপেক্ষা করছে নতুন এক গল্প। বিবমিষার গভীর অন্ধকার থেকে উঁকি দেওয়া নতুন এক আখ্যান। সেই আখ্যানজুড়ে অন্দরমহল। সেই অন্দরমহল শুধু বিষ্ণুপুর জমিদারির কেন্দ্রস্থল গঙ্গামহলেরই অন্দরমহল নয়, এই অন্দরমহল মন ও মানবেরও এক সুগভীর অন্দরমহল।’
উপন্যাসে বিবৃত মানবজনম নিয়ে লেখকের অনুভূতি এমন, ‘মানুষ হয়ে জন্মানোর যন্ত্রণা বড় তীব্র। জটিলতা বড় বেশি। এক জনমের পুরোটাই তার কেটে যায় কেবল নিজেকে বুঝতে। কিন্তু শেষ অবধি কতটা তার বোঝা হয়, মানুষ তা জানে না। মানুষ কেবল জানে, একটা মানবজনম তার কেটে যায় দ্বিধা, শঙ্কা আর মায়ায়।’
অন্দরমহলে মৃত্যুচিন্তাও প্রকট হয়ে ওঠে। ব্যর্থ প্রতিটি মানুষ মৃত্যুকে কামনা করে। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। আর এজন্যই হবু জমিদার অবনীন্দ্রনারায়ণ ভাবেন, ‘এই যে বেঁচে থাকা তা কি মৃত্যুর চেয়ে কিছু কম?’ তখন মনে হয়, জগতের লোভহীন মানুষও আছে। কিছু কিছু মানুষ ক্ষমতার কাঙাল নন, তারা ভালোবাসার কাঙাল। অবনীন্দ্রনারায়ণ তাদের প্রতিনিধি। কেননা অবনীন্দ্রনারায়ণ তার স্ত্রী বীণাবালাকে বলেন, ‘এ সকল কি আসলেই আমাদের? আমাদের না বীণা। আমরা কিছুটা সময় ব্যবহার করছি মাত্র। ভোগ করছি মাত্র। তো বেঁচে থাকতে কি এত কিছুর দরকার হয়, বলো? কত অল্পতেই তো মানুষ বেঁচে থাকে।’
দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার দেবেন্দ্রনারায়ণ জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে যখন বলেন, ‘একের পাপের সুফল যদি অন্যে ভোগ করতে পারে, তাহলে শাস্তি কেন ভোগ করতে পারবে না? শাস্তিও পাওয়া উচিত। এটাই ন্যায় বিচার হরিহরণ। এই যে এতটা কাল বিষ্ণুপুর জমিদারির সকল সুফল, আরাম-আয়েশ, ক্ষমতা ভোগ করলাম।… তাহলে পাপ নয় কেন? ভগবানের হিসেব বড় কড়া হরিহরণ।’ দেবেন্দ্রনারায়ণ ভাবেন, ‘জীবনজুড়েই মানুষ কেবল ‘আরো ভালো’ ‘আরো ভালো’ সময়ের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু দিনের শেষে গিয়ে সে আবিষ্কার করে। সেই ‘আরো ভালো সময়গুলো’ সে আসলে পার করে এসেছে।’
জীবন বা বেঁচে থাকা সম্পর্কে লেখকের ভাবনা ফুটে ওঠে রতনকান্তির মুখে, ‘মৃত্যুর ভেতর থেকে জীবন খুঁজে এনে বেঁচে থাকাটাই তো জীবন। সবচেয়ে বেশি আনন্দের। জীবন মানুষকে নানানভাবে পরখ করে। সেখানে দুম করে হার মানলে চলবে কেন?’ কিন্তু লেখক আবার বলেন, ‘মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় না। মানুষ ভয় পায় শূন্যতাকে।… মৃত্যু এক প্রবল শূন্যতা।’
সর্বজয়ার দৃষ্টিতেও উঠে আসে মৃত্যু। তিনি বলেন, ‘এই জগত বিভ্রমের জগত। এখানে বিভ্রমের চেয়ে সত্য কিছু নেই। এই বিভ্রমজুড়ে কেবল যন্ত্রণা। এই মায়াজুড়ে কেবল কষ্ট। আর এই সকল বিভ্রম, মায়ার শেষ হচ্ছে মৃত্যু।’ দেবেন্দ্রর মৃত্যুর পর স্ত্রী রেণুকা ভাবেন, ‘মৃত্যু বড় খেয়ালি, তার প্রয়োজন থেকে সে কাউকে অব্যাহতি দেয় না।’
এদিকে পরকীয়ায় আসক্ত বীণাবালার প্রতি অবনীন্দ্রনারায়ণের উপলব্ধি- ‘যে মনে আমার জন্য ভালোবাসা নেই, সে শরীর তো আমার কাছে মৃত। শরীরে কেবল প্রাণ থাকলেই শরীর বেঁচে থাকে না। তাতে ভালোবাসাও থাকতে হয়। প্রাণহীন শরীর আসলে মৃত শরীর নয়, মৃত শরীর মূলত ভালোবাসাহীন শরীর।’ তবে ‘বীণাবালার সেই মৃত শরীর তাহলে বিভূতিনাথের ভালোবাসায় প্রাণ পেয়েছিলো?’ অবনীন্দ্রনারায়ণ আসলে বিভূতিনাথের পরিচয়ে বেঁচে ছিলেন।
অন্দরমহলের ধ্বংসের সঙ্গে গঙ্গাবতীরও প্রবল ঘনিষ্ঠতা ছিল। পৃথিবীতে পাপ বেশি হয়ে গেলে প্রকৃতিও মানুষকে শাস্তি দেয়। অবশেষে আমরা ন্যাচারাল পানিশমেন্ট দেখেছি। দশদিন ধরে টানা বর্ষণ, বন্যা। প্রকৃতির এই সাজা অন্দরমহলকে নিমজ্জিত করেছে জলে। এত বছরের প্রভাব-প্রতিপত্তি সব কেমন নিমিষেই চুরমার হয়ে যায়। এটাই বোধহয় চিরন্তন সত্য। এই উপলব্ধিটা অবনীন্দ্রনারায়ণ ছাড়া অন্দরমহলের আর কারও মধ্যে ছিল না বলেই হয়তো গঙ্গামহল গঙ্গাবতীর জলে নিমজ্জিত হয়েছে। শেষে দেখতে পাই, অন্দরমহলের দেয়ালে লেখা ‘আমাদের কিছুই নেই, অথচ সবটা সময়জুড়ে ভাবি, এই বুঝি নিঃস্ব হলাম।’ অবনীন্দ্রনারায়ণের জীবনের এই অমোঘ সত্যটুকু নিয়ে গঙ্গামহল ডুবে গেল জলে। শেষ হয়ে গেলো একটি অন্দরমহলের ইতিহাস।
মোটকথা, অন্দরমহল পড়তে পড়তে এতটাই মগ্ন হতে হয় যে, নিজের বুকের ভেতরও কেমন যেন তোলপাড় শুরু হয়। তাই কাহিনি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। সবচেয়ে ভালো লেগেছে, কাল্পনিক হলেও এর প্রতিটি স্থানের নামকরণে যথেষ্ট জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন লেখক। এমনকি প্রত্যেকের নামের ক্ষেত্রেও সামঞ্জস্য রক্ষা করেছেন সচেতনভাবে। নামগুলো যেন জীবন্ত হয়ে আছে। আর উপন্যাসের নামকরণে যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে বাংলা সাহিত্যে নতুন একটি নাম যুক্ত হবে নিশ্চয়ই।
তবে মাঝখানে একটু হোঁচট খেতে হয়। যখন ‘দাসী কমলা দ্বিজেন্দ্রকে তার পিতা অবনীন্দ্রনারায়ণের গৃহত্যাগের পুরো ঘটনা বিস্তারিত বলল। দ্বিজেন্দ্র চুপ করে শুনলেও এ বিষয়ে তার আগ্রহ আছে বলে মনে হলো না।’ ২৬১ পৃষ্ঠায় এ লেখার পর আবার অন্যত্র লেখক শোনালেন, ‘অবনীন্দ্রনারায়ণ গঙ্গামহলে নেই, এই খবর প্রকাশিত হলো দ্বিজেন্দ্র গঙ্গামহলে ফিরে আসারও দিনকয়েক পরে।’ কথা হচ্ছে—দ্বীজেন্দ্র তো আগেই শুনেছে। নতুন করে প্রকাশ হওয়ার বিশেষ কারণ কী? না কি প্রজাদের কাছে প্রকাশের ব্যাপারটি বুঝিয়েছেন। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করলে ভালো হতো মনে হয়।
আরেকটি বিষয় মনে হয়েছে আমার যে, কোথাও কোথাও ঘটনার চেয়ে বিবরণ বেশি হয়ে গেছে। যা পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে পারে। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে বিষয়টি নজরে আনবেন।
এই সামান্য ত্রুটি বাদ দিলে নিঃসন্দেহে এ কথা বলতে পারি, অন্দরমহল যুগে যুগে ইতিহাস হয়ে থাকবে পাঠকের অন্তরে। বাস্তবিক কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা না হলেও মানবমনের ইতিহাসে ‘অন্দরমহল’ অমর হয়ে থাকবে। এমন বিশ্বাস আমি দৃঢ়ভাবে পোষণ করতেই পারি।
অন্দরমহল
লেখক: সাদাত হোসাইন
প্রকাশনী : ভাষাচিত্র
প্রচ্ছদ : হাসিবুল ইসলাম নাসিম
মূল্য : ৬৫০ টাকা