প্রচল দৈনিকের দায়সারা সাহিত্যপাতা আর বেনিয়াদের পাতানো সাহিত্য পত্রিকাকে এড়িয়ে শুদ্ধসাহিত্য চর্চার ব্রত নিয়েই কারবার ছোটকাগজের। অন্তত কিছু কিছু ছোটকাগজ দেখলে এমনটাই মনে হয়। শুদ্ধ সাহিত্য চর্চার আঁতুড়ঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেই কবি, কথাশিল্পী ও অনুবাদক রেজা নুর সম্পাদনা শুরু করেন ‘অনুরণন’। তাঁর কাগজের বিশেষত্ব হলো—এটি বছরে একবারই প্রকাশিত হয়। এতে প্রবন্ধ, গল্প, অনুবাদ, ফিকশন, সাক্ষাৎকারসহ শিল্পসাহিত্যের বিচিত্র শাখার রচনা অন্তর্ভুক্ত থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হলো কাগজটির তৃতীয় সংখ্যা। শুরু হয়েছে মহাশ্বেতা দেবীর সাক্ষাৎকার দিয়ে। গ্রহণ করেছেন স্বপ্নাগুহ ঠাকুরতা। নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকারটিতে উঠে এসেছে লেখকের ব্যক্তিগত জীবন, সাহিত্য চর্চার নানা প্রসঙ্গ। পরের সাক্ষাৎকারটি কবি জয় গোস্বামীর। এটিও নিয়েছেন স্বপ্নাগুহ ঠাকুরতা। কথা বলেছেন বেশ খোলামেলা। প্রেম-প্রকৃতি থেকে শুরু করে নানা বিষয় উঠে এসেছে জয়ের সাক্ষাৎকারে। দুটি সাক্ষাৎকারের মধ্যে মহাশ্বেতা দেবীর সাক্ষাৎকারে যেমন উঠে এসেছে জীবন দর্শন, রাষ্ট্র ও সমাজের নানা অনুষঙ্গ, তেমনি সেসবের বর্ণনায়ও লেখককে মনে হয়েছে প্রাজ্ঞ। জয়গোস্বামীকেও মনে হলো, জীবন ও শিল্প সম্পর্কে তিনি বেশ সোজাসাপ্টা কথা বলেছেন।
মহাশ্বেতা দেবী যখন বলেন, ‘বাংলা সাহিত্য অন্তহীন পথ। যদি কেউ নিষ্ঠা নিয়ে লেখেন, সে লেখকেরর স্বাদ অন্য রকম হবেই। আমার মনে হয়, ভালো লেখা এই প্রজন্মের হাত থেকে উঠে আসবে। তোমাদের সক্রিয় দেখতে চাই। তোমাদের লেখা পড়তে চাই।’ যখন পাঠকের মনে পড়ে যাবে, একজন অগ্রজ লেখক কতটা মমতা নিয়ে তরুণদের লেখা পাঠের আগ্রহ ব্যক্ত করেন। কতটা ব্যকুল হয়ে থাকেন তিনি তরুণ-অনুজদের রচনা পাঠের। এই থেকে তরুণ প্রেরণা পাবেন, নিষ্ঠার সঙ্গে সাধনার।
জয় গোস্বামী শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেছেন সাহিত্যে দশক বিভক্তি নিয়ে। বলেছেন, দশক বিভক্তি ছাত্রদের সাহিত্যের ধারাবাহিকতা বোঝাতে কাজে লাগতে পারে, কিন্তু তাতে সাহিত্যের কোনো উপকারে আসবে না।
এ সংখ্যায় গল্প রয়েছে ছয়টি। গল্পগুলোর প্লট নির্মাণ যেমন দুর্বল, তেমনি এগুলোর বর্ণনা, সংলাপও। ফলে গল্পগুলোকে মনে হয়েছে পৃষ্ঠা ভর্তি করার আয়োজন মাত্র। একটুখানি ব্যতিক্রম আশরাফ শিশিরের ‘গাধা’।
ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন শাকুর মজিদ। শিরোনাম ‘সক্রেটিসের শহর : এথেন্স’। কেবল ভ্রমণবৃত্তান্তেই এ লেখা শেষ হয়ে যায়নি এতে রয়েছে, প্রাচীন গ্রিসের শিল্পকলা থেকে শুরু করে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার নানা প্রসঙ্গ। সবচেয়ে লিখেছেন সক্রেটিসের শেষ আবাসস্থল নিয়ে। লিখেছেন, ‘আমার ডিভিক্যাম স্লোন জুম ইন করে ঢুকে যায় গরাদের ভেতর পাথরের টুকরোর ওপর। ওটা কি সক্রেটিসের আসল ছিল? শেষ বিকেলের আলো এসে পড়ছে সক্রেটিসের গুহার ভেতর। ৩৯৯ খ্রি. পূর্বের সে দিনও এই শেষ বিকেলের শেষ সূর্য অস্ত যাওয়ার বেলা ক্রিটো এসেছিলেন সক্রেটিসের কাছে। সক্রেটিসের স্ত্রী ও পুত্র-কন্যারা তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা দিয়ে গেছেন দুপুরবেলা। এথেন্সের বন্দরে সেই জাহাজ এসে পৌঁছেছে বলে খবর পেয়ে গেছেন সক্রেটিস। এই সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই তাকে পান করে ফেলতে হবে হেমলকের পেয়ালা।’
এমন স্পর্শকাতর বিষয়ের বর্ণনার পরই শাকুর মজিদ লিখলেন সবচেয়ে মোক্ষম সমালোচনামূলক মন্তব্যটি। লিখলেন, ‘সক্রেটিসের জেলখানায় আর আমাদের ভালো লাগলো না। গণতন্ত্রের বাণী যারা বিশ্বকে শিখিয়েছিল গণতন্ত্রের ভুল প্রয়োগের এই সাক্ষীস্থানটিকে বড় অপয়া মনে হলো।’ যে স্থানটি দেখার জন্য এতদূর গেলেন, দেখার পর ইতিহাস মনে পড়ে যাওয়ার পর সত্যসন্ধানীর ও স্থানটিকে আর সহ্য হলো না। অবশ্যই, সত্যের অন্বেষণে যারা জীবন বিলিয়ে দিতে চান, তাদের কাছে কোনো স্থান বা ঘটনার যতই ঐতিহাসিক মূল্য থাকুক, সত্যের অপমান, মানবতার মৃত্যুর সঙ্গে যদি ওই ঘটনা বা স্থানটির কোনো সম্পর্ক থাকে, তাহলে সেটা তাদের ভালো লাগবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাই সেখানে তারা বেশিক্ষণ থাকেন না। শাকুর মজিদের নিজের উক্তি—‘আমরা দ্রুত পাহাড় বেয়ে নিচে নামতে থাকি।’
এ সংখ্যায় রয়েছে তিনটি প্রবন্ধ। দুটি প্রবন্ধ খুবই কাচা ও অপরিশীলিত এবং অবিন্যাসিত। ব্যতিক্রম ইয়াসির আজিজের ‘বাংলাদেশের গদ্য চর্চা’। এই প্রবন্ধে লেখক তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের গদ্যচর্চার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, গতিপ্রকৃতি, ধরন ও শ্রেণী। বিষয় ধরে ধরে তিনি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, কার প্রবন্ধ কেমন, কে কোন বিষয়ে পারদর্শী। এক অর্থে বলতে গেলে, ‘অনুরণন’-এর আলোচ্য সংখ্যার সবচেয়ে ঋদ্ধ লেখা এটিই।
এই সংখ্যায় আরও রয়েছে কবিতা, অনুবাদ গল্প, অনুবাদ কবিতা, সায়েন্স ফিকশন, ব্যক্তিগত গদ্য, বিশ্বসাহিত্য। কিন্তু অধিকাংশ কবিতা-ই খুব দুর্বল এবং পাঠের অনুপযুক্ত। কবিতাগুলো পাওয়ামাত্রই প্রকাশিত হয়েছে। কোনো সম্পাদনার ছাপ পরিলক্ষিত হয়নি। ‘অনুরণন’ সম্পাদকের প্রতি অনুরোধ—ভবিষ্যতে কবিতা নির্বাচনে আরও সতর্ক এবং প্রকাশে আরও যত্নশীল হবেন।
সব মিলিয়ে ‘অনুরণন’ সংগ্রহে রাখার মতো একটি সুদৃশ্য ও পরিপূর্ণ ছোটকাগজ—এ কথা স্বীকার করতেই হয়।
অনুরণন
সম্পাদক: রেজা নুর
মূল্য: ২০০ টাকা।
প্রাপ্তিস্থান: রকমারি ডটকম