বিশিষ্ট কবি ও কথাশিল্পী রকিবুল হাসান দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য সাধনায় ব্যাপৃত রয়েছেন। বহুমাত্রিক কর্মসাধনার পরিবৃত্তে তাঁর অধিষ্ঠান ক্রমশ বলিষ্ঠ ও চেতনাদর্শী হয়ে উঠেছে। সৃজনশীল সাহিত্যের আধার হিসেবে তিনি যেমন বেছে নিয়েছেন কবিতা ও কথাসাহিত্য তেমনি গবেষণার ক্ষেত্রপরিসরে কাজ করেছেন জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা সম্পর্কে। বিশেষ করে মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন পর্যন্ত বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা নিয়ে তাঁর গবেষণা একটি প্রাতিস্বিক কাজ।
এবারে তিনি পাঠকের দরবারে হাজির হয়েছেন বৃহৎ কলেবরের একটি উপন্যাস নিয়ে যার নাম ‘অগ্নিকা আঁধার’। এর আগে কয়েকটি উপন্যাস আমরা রকিবুলের হাত থেকে পেয়েছি। ‘জীবন দিয়ে ভালোবাসি’ (১৯৯৯), একী তৃষ্ণা একী দাহ’ (২০০০), ‘নবীরন’ (২০০৩, ২য় সং. ২০১৫), ‘ভাঙন’ (২০০৬, ২য় সং. ২০১৪) ‘ছায়াবন্দি’ (২০১১), ‘অহনা বউ’ (২০১৪) প্রভৃতি। আগের উপন্যাসগুলোতে রকিবুল হাসানের প্রথম যৌবনের দীপ্তি নানাভাবে বিচ্ছুরিত হয়েছে। প্রেম, প্রত্যয়, নারীঅধিকার, সমাজ ও রাজনীতি, অবক্ষয়, ষড়যন্ত্র, রাজপথ-কানাগলি ইত্যাদি জীবনের বিচিত্র অর্কেস্ট্রার রূপরেখা এগুলোতে ছায়া বিস্তার করেছে। ‘অগ্নিকা আঁধার’ আমাদের সমকালীন জীবন ও সমাজের উদগ্র বাস্তবতাকে ধারণ করেও একটা সুষম শিল্পের বাতাবরণ গড়ে তুলেছে।
দেশ-জাতির গৌরবের প্রতীকতায় বাণিজ্যিক দৃষ্টিলোক পরিহার করাই হবে দেশপ্রেমের অপর পরাকাষ্ঠা। ‘অগ্নিকা আঁধারের’ অগ্নিসাক্ষী পাঠকের ভেতর জীবনালোকের যথার্থ সন্ধান দিক এটাই আজকের একান্ত প্রত্যাশা।
গ্রন্থের ভূমিকায় বিলু কবীর বলেছেন: ‘সমাজবাস্তবতার সত্যনিষ্ঠ নিগূঢ় এবং আড়ালের বিষয়কে প্রতিপাদ্য করে রচিত হয় যে উপন্যাস, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার মতো সাহসের। তবু তা ইতিহাস নয়, জীবন থেকে নেয়া হলেও তা প্রামাণ্য দলিল নয়।… কিন্তু তার পরেও সেই সাহিত্যোপাদানের প্রয়োগে অথবা ঘটনাগুলো উপন্যাসের মাহাত্ম্য পরিগ্রহ করার ফলেই তা হয়ে ওঠে সত্য বয়ানের গদ্যের চাইতে কম এবং নিরেট উপন্যাসের চাইতে বেশি।’
‘অগ্নিকা আঁধার’ এর ঘটনাক্রম পাঁচ পর্বে বিভক্ত। চেয়ার মধুমক্ষিকা, সাধকের সাজা, নষ্ট রাজের ফাঁদ, বিধায়কের বিধান ও তবুও আলো। বাঘা যতীন নামক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থাপনার ভেতর-বাইর, সঙ্গতি-অসঙ্গতি, শিক্ষাকার্যক্রমে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের আবহ, শিক্ষাবাণিজ্যের স্বরূপ এবং এখানে আমাদের জাতীয় গৌরবের প্রতীক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চালচিত্র দর্পণ সদৃশ হয়ে অঙ্কিত হয়েছে। বাঘা যতীন অগ্নিযুগের বিপ্লবী আদর্শপ্রাণ মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁকে নিয়েও একটি স্বনামখ্যাত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা দরকার সেটাও ড. রকিবুল হাসান সাহিত্যের ভাবসত্যে ইঙ্গিত করেছেন।
উপন্যাসের ভাবসত্যে এটাও প্রতিভাত হয়েছে যে, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম ও আত্মদানের মহিমা থেকে গড়ে উঠেছে যে শহিদ মিনার, যার মাহাত্ম্য থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পরিচর্যা ও জ্ঞানিক প্রস্রবণে আমাদের যত্ন, শ্রম ও নিষ্ঠা অক্ষুণ্ন রাখা বিধেয়।
দেশ-জাতির গৌরবের প্রতীকতায় বাণিজ্যিক দৃষ্টিলোক পরিহার করাই হবে দেশপ্রেমের অপর পরাকাষ্ঠা। ‘অগ্নিকা আঁধারের’ অগ্নিসাক্ষী পাঠকের ভেতর জীবনালোকের যথার্থ সন্ধান দিক এটাই আজকের একান্ত প্রত্যাশা।
আরও পড়ুন: অগ্নিকা আঁধার : পাঠ-প্রতিক্রিয়া ও মূল্যায়ন