উপন্যাসে ব্যক্তির জীবন থেকে শুরু করে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রেরই চিত্র তুলে ধরা যায়। এ কারণেই পাঠকেরও আগ্রহের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে সাহিত্যের এই মাধ্যমটি। রকিবুল হাসানও বিষয়টি আত্মস্থ করে উপন্যাসকেই নিজের অভিমত-চিন্তা-চেতনা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তার উপন্যাস ‘অগ্নিকা আঁধার’। এই উপন্যাসে তিনি একটি উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তুলে ধরেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের আচরণ ও অভ্যাসের বিবরণ।
সামাজিক দায়বদ্ধতাকে লেখক কখনোই অস্বীকার করতে পারেন না। তাই লেখক তার সাহিত্যকর্মে রাষ্ট্র, সমাজ, মানবসম্পর্ক এবং দেশজ প্রকৃতি বহুবিধ বিষয় উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেন। রকিবুল হাসানও ‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসে সেটিই করার প্রয়াস গ্রহণ করেছেন। কাহিনির প্রয়োজনে তুলে এনেছেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, নেতাজি, সুভাষ বসু, বিনয়-দিনেশ-বাদলদের আত্মত্যাগের কাহিনি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এ উপন্যাসে ভিন্নমাত্রিকতা যুক্ত করেছে। তুলে ধরেছেন বাউল ও লালন দর্শন। রবীন্দ্রনাথ যে এই বাউল দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হন সে-সম্পর্কেও বিভিন্ন তথ্য-তত্তে¡ও শিল্পিত উপস্থিতি রয়েছে এখানে। কাঙাল হরিনাথ, গগন হরকরা, মীর মশাররফ হোসেন, আকবর হোসেনকেও প্রাসঙ্গিকতায় এনেছেন।
এর মধ্য দিয়ে সমাজের প্রতি সুধীসমাজের যে দায়, লেখক তা এড়িয়ে যাননি। এই অনিন্দ্য অর্ঘ্যকেও নায়ক ভাবা যেতে পারে। লেখক কাল সচেতন বলে উপন্যাসে অপরিহার্যভাবে যুক্ত করেছেন চলমান বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রকোপ।
স্বদেশি আন্দোলনের বিষয়ও এসেছে। বালেশ্বরে বুড়িবালাম নদীর তীরে ব্রিটিশদের সংগে বাঘা যতীনের যুদ্ধ, সেই যুদ্ধকে নিয়ে নজরুলের ‘নবভারতের হলদিঘাট’ কবিতা রচনা, ‘কুহেলিকা’য় বাঘা যতীনের ছায়াচরিত্র নির্মাণ এ উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ দিক। উপন্যাসে যে বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে কাহিনি আবর্তিত হয়েছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে, ‘বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়’। এই নামকরণের কারণ আছে। কারণ শিল্পিত প্রকাশই সামাজিক দায়বদ্ধতার অন্য নাম।
এ উপন্যাসে অনেক চরিত্রের সমাহার ঘটেছে। তবে কোনো একটি চরিত্রকে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নায়ক বলে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে পাঠ করলে বোঝা যাবে, এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বিপ্লবী বাঘা যতীন অর্থাৎ বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়। এই নাম একটি বিপ্লবের নাম। বাঘা যতীন দেশের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে গেছেন, তেমনি উপন্যাসে বর্ণিত বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে সুস্থ একটি উচ্চশিক্ষাঙ্গন সগৌরবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। সেই আলোটা ঠিকই ছড়িয়ে পড়তে দেখি।
উপন্যাসের একেবারে শেষে এসে দেখা যায়, চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে অনিন্দ্য অর্ঘ্য বিপ্লবী বাঘা যতীনের ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এর মধ্য দিয়ে সমাজের প্রতি সুধীসমাজের যে দায়, লেখক তা এড়িয়ে যাননি। এই অনিন্দ্য অর্ঘ্যকেও নায়ক ভাবা যেতে পারে। লেখক কাল সচেতন বলে উপন্যাসে অপরিহার্যভাবে যুক্ত করেছেন চলমান বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রকোপ।
কর্মজীবী মানুষের স্বভাব ক্যারিয়ার নিয়ে প্রতিযোগিতা, প্রতিহিংসা, প্রতিদ্বন্ধিতা। আর এসবের এক বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠেছে ‘অগ্নিকা আঁধার’। আমি এই উপন্যাসের বহুল পাঠ কামনা করছি।