রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, লেখকের অভিজ্ঞতা ও আবেগ-অনুভূতির সংমিশ্রণে তৈরি হয় একেকটি উপন্যাস। এ কারণেই হয়তো সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ক্যানভাস এই উপন্যাস। সাহিত্যের এই শাখাটির উন্মেষকাল থেকেই এতে উঠে এসেছে সমাজের নানা চিত্র। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের হাতে তৈরি সাহিত্যের এই শাখাটি বর্তমান কালেও সদর্পে সমুপস্থিত। যুগের চেতনাকে ধারণ করে লেখা হচ্ছে নতুন নতুন কাহিনি, যা পাঠক সমাজকে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও কাল সম্পর্কে সচেতন করে তুলছে। কথাসাহিত্যিক রকিবুল হাসান তাঁর ‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসে বিভিন্ন বিষয়কেই পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
আলোচ্য উপন্যাসটি পাঁচটি অধ্যায়ে বিভাজিত। পর্বগুলোর নামও চমকপ্রদ। প্রথম পর্ব, ‘চেয়ার ও মধু মক্ষিকা’, দ্বিতীয় পর্ব, ‘সাধকের সাজা’, তৃতীয় পর্ব, ‘নষ্টরাজের ফাঁদ’, চতুর্থ পর্ব, ‘বিধায়কের বিধান’ ও পঞ্চম পর্ব, ‘তবুও আলো’। ‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসটির কাহিনি গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের কোনো এক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে। লেখক ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন, ‘বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়’। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি উপন্যাসটিকে গড়ে তুলতে সহয়তা করেছে। প্রতিটি চরিত্র তার নিজের অবস্থানকে টিকিয়ে রাখতে সর্বদা লড়াই করে গেছে, সে লড়াইটা বেশিরভাগই অনৈতিক পন্থাকে অবলম্বন করে। তবে এই স্খলনকে ছাপিয়ে কিছু চরিত্র সদর্পে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
উপন্যাসটির শুরু হয়েছে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগকে কেন্দ্র করে কিছু জটিলতার মধ্যে দিয়ে। যে জটিলতার সূচনা ওই বিভাগের চেয়ারপারসন সুদর্শনা ড. ফারজানা ও ট্রাস্টি বোর্ডের চিফ কো-অর্ডিনেটর আব্দুল করিমকে ঘিরে। বাংলা বিভাগের সভাপতির পদ ধরে রাখতে ফারজানা জড়িয়ে পড়ে একের পর এক সম্পর্কে। যেখানে হৃদয়ের কোনো সংযোগই নেই। ক্ষমতার দাপট তাকে এতটাই অন্ধে পরিণত করে যে, একসময় সে সিসি, ভিসি সবাইকেই তার জালে আবদ্ধ করে। এছাড়া এলিনা রহমান যিনি বিভাগের শিক্ষক হওয়ার জন্য জড়িয়েছেন অনৈতিক সম্পর্কে। যেমন, ‘আব্দুল করিম বিস্ময়ে ভাবলেন, ড. এলিনা রাজি হয়ে গেলেন এবং কী স্বতস্ফূর্তভাবে! বিস্ময়কেও হার মানায়। আচ্ছা এরা যে আমাকে এত গুরুত্ব দেয় – এটা আমাকে না আমার চেয়ারকে! (…) চাকরিটা রক্ষা করে , বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেকে প্রভাবশালী করে রাখার জন্য নিজেকে এত নিচে নামিয়ে, বাইরের বাতাসে সম্মানী মানুষ হয়ে ভেসে বেড়াই, এখন সে চাকরিটা যে কয়দিন থাকে। ’ এখানে ফারজানার অন্তর্দ্বন্দ্ব যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি এখানে ক্ষমতাকে ধরে রাখার অদম্য প্রয়াসও দেখানো হয়েছে। বর্তমান সমাজেও প্রতিটি সেক্টরে ক্ষমতার দাপট ও নিজেকে অন্যের থেকে বেশি যোগ্য প্রমাণ করার জন্য চলছে একে অন্যের প্রতি দমন-পীড়নের খেলা। যে খেলায় কেউ জেতে, কেউবা হেরে যায়। ফারজানাও একসময় হারিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু হারানোর আগে তার যে স্খলন, তা শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে না, নীতি-নৈতিকতার মৃত্যুও ঘটায়।
উপন্যাসটির প্লট বড় হতে থাকে ধীরে ধীরে। ফারজানা তার অবস্থান টিকিয়ে রাখতে যে পন্থাকে কাজে লাগিয়েছে, সেখানে যোগ হয়েছে তুষার পারভেজ নামে খ্যাতনামা একজন ব্যবসায়ীর নামও। এছাড়া ঘটনার পরিসরে আর একটি নাম বিশেষভাবে এসেছে যে বিভাগের প্রোগ্রাম অফিসার ফারিয়া। একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদ ও বাইরের ঠাট-ভাট বজায় রাখলেও নিজেকে সর্বেসর্বা করে তুলতে কিছু ব্যক্তির ভেতরে যে কত কদর্যরূপ, তার প্রতি লেখকের তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপিত হয়েছে এ উপন্যাসে। ফারজানা বলছে, ‘ক্ষমতার কত চাতুর্য, আমাকে দুজনকেই সামলিয়ে চাকরিটা বাঁচিয়ে রাখতে হয়। কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না দুজনের সাথেই আমার ঘনিষ্ঠতা , মধুর সম্পর্ক।’ এবার লেখক বলছেন, ‘আবার ভাবে এটা কী সত্যি মধুসম্পর্ক নাকি বিষ সম্পর্ক!’ এরপরই আবার ফারজানার অনুভূতি, ‘কখনো কি ভেবেছি ভেতরে এত কদর্যরূপ!’ মানুষ তার অবস্থানকে গড়ে তুলতে কত কদর্যরূপই না ধারণ করে বর্তমান সমাজে যা অহরহ চোখে পড়ছে।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে আধ্যাত্মিক আত্ম-জিজ্ঞাসার যে গভীর জীবনরহস্য উপস্থিত তার মূলে বাউল গান-ভাবনা-সুর। লালন এবং কুষ্টিয়ার বিভিন্ন সংস্কৃতির বর্ণনা উপন্যাসকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
ভিসি শাহেদ জাহান, প্রো- ভিসি নাজমুল সৈকত, সিসি আব্দুল করিম, বাংলা বিভাগের প্রধান ফারজানা, প্রোগাম অফিসার ফারিয়া ও ইংরেজি বিভাগের ওবে কোর্সের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়া ড. এলিনা রহমান যিনি বাংলা বিভাগের চেয়ারপারসন হওয়ার জন্য নিজেকে অবলীলায় বিকিয়ে দিয়েছেন এসব ব্যক্তিকে নিয়ে বিভাগীয় বিভিন্ন দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে কেন্দ্র করে প্রথম পর্বের সম্পাতি ঘটে। উপন্যাসটির গতি পরিবর্তিত হয় ভিসি সাদিক আহসানের যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। এক অর্থে মূল পটভূমির যাত্রা এই দ্বিতীয় পর্বেই ঘটেছে। যিনি বিভাগের সম্পূর্ণ কার্যক্রমেই একটা আলোড়ন ঘটিয়ে দেন। তারই হাত ধরে আসে উপন্যাসের মূল চরিত্র অনিন্দ্য অর্ঘ্য! যিনি বাংলাবিভাগের প্রধান। শুধু বাংলা বিভাগের প্রধান নন, এই উপন্যাসের নায়কও বটে। তবে নায়ক হতে হলে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরি। সে অর্থে অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবেই ধরা যায়! ঘটনা পরম্পরায় লেখক বার বার তুলে ধরেছেন বাঘা যতীনের বিপ্লবগাথাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইভা বোর্ডে অনিন্দ্য অর্ঘ্য বলে, ‘আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়। বাঘা যতীন ১৯১৫ সালে ৯ সেপ্টেম্বর বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীর তীরে চারজন সৈন্য নিয়ে সাড়ে চারহাজার বিট্রিশ সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি জানতেন আজ তার মৃত্যু অবধারিত। (…) ব্রিটিশদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, এখন থেকে এভাবেই আমরা তোমাদের সাথে লড়বো। ভারতমাতাকে স্বাধীন করবো। (…) বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়।’এই উক্তির মাধ্যমে লেখক ইতিহাসের পাশাপাশি জীবনের মূল দর্শনকেও প্রতিফলিত করেছেন।
সাদিক আহসান ও অনিন্দ্যের বিভিন্ন কল্যাণকর উদ্যোগ বিভাগসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমূল পরিবর্তন ঘটায়। কিন্তু এর মধ্যেও চলে জব পলিটিক্স! এই পলিটিক্স উপন্যাসটির পরতে পরতে রয়েছে! একজনকে টপকে অন্যজন কিভাবে নিজের অবস্থান গড়ে তুলবে এবং সেই জায়গা দখলের খেলায় শরীরকে বারংবার পুঁজি করেছে, তার প্রমাণ দেওয়া হয়েছে! উপন্যাসের গতি পরিবর্তিত হয়েছে অনিন্দ্যকে ঘিরে। তাকে উপস্থাপন করতে গিয়ে লেখক পলাশীর যুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু হত্যা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বাংলা ভাষা -সাহিত্যের প্রতি অবহেলা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, লোকসংস্কৃতি থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিকও তুলে ধরেছেন।
অনিন্দ্য অর্ঘ্য বলে, ‘বাউলের গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানববাদী জীবনচেতনার প্রেরণা অনুভব করেছিলেন। বাউলের গানের সুর, বাণী ও তত্ত্বকথা যেমন তাকে আকৃষ্ট করেছে তেমনি বাউলের বেশভূষায়ও তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। (…) গগন হরকরা ছিলেন বাউল সম্প্রদায়ের মানুষ । তাঁর গানও রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিলো। আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে (…) রবীন্দ্রনাথ মনের মানুষের খোঁজে যেন এক নতুন সন্ধান পেলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন- আমি কে তাই আমি জানলেন না, আমি আমি করি, কিন্তু আমি আবার ঠিক হইলো না।’
শুধু বাউল, লালন, গগন হরকরা নয় বরং লেখক তুলে ধরেছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের মতো ইতিহাসকে। প্রসঙ্গক্রম অনিন্দ্য বলে, ‘স্বৈরাচার এরশাদের চেয়েও কি আপনার মালিকেরা ক্ষমতাশীল? আমরা নব্বই য়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করে এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি।… বিষয়টি বাংলা-বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন। সেই আন্দোলনটা না করলে স্বাধীনতা আন্দোলনও হতো না মুক্তিযুদ্ধও হতো না! ’ উপন্যাসের বর্ণনায় ইতিহাসকে ঢুকিয়ে দেওয়ার যে নৈপুণ্য, রকিবুল হাসান বারবার করেছেন। যার মাধ্যমে লেখক তার ইতিহাস- ঐতিহ্যের প্রতি গভীর মমত্ব ও প্রেমের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। বর্তমান সমাজকে তিনি এখানে আরও একটি বার্তা দেন। লেখক জানান, মূল শেকড় কখনোই ভুলে যাওয়া চলবে না। ভাষা ও ভাষা শহিদদের প্রতি আজন্ম শ্রদ্ধায় মাথা নত করে জীবন নির্বাহ করা উচিত।
কাহিনি পরম্পরায় উঠে এসেছে ভারতবর্ষের চিরকালীন চরিত্র। উপন্যাসটির কলেবর কিছুটা বড় মনে হলেও কোথাও পড়তে গিয়ে হোঁছট খেতে হয় না। বরং কাহিনি ও চরিত্রগুলোর সঠিক দিকনির্দেশনা দিতেই লেখকের এত আয়োজন। সাবলীল বর্ণনাভঙ্গির কারণে এটি সুখপাঠ্যও বটে। অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি দেশের কলেবর ভেঙে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কিছু ঘটনারও দেখা মেলে। একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারকে কেন্দ্র করে অনিন্দ্য এবং কৃষ্ণা চক্রবর্তীর দেখা। এই একটি ঘটনার মাধ্যমে প্রথম দেখাতে সক্ষম হলেন অনিন্দ্য কোন যন্ত্রমানব নয় বরং সেও একজন মানুষ। রক্তমাংসের মানুষ। ক্ষণিকের সাক্ষাৎ এবং আলতো হৃদয়ের ছুঁয়ে যাওয়া। এই উপন্যাসের প্রথম এবং একমাত্র হৃদয়বৃত্তীয় ঘটনার স্পর্শ। যেমন, ‘অনিন্দ্য অর্ঘ্য কিছুই বললেন না। মন খারাপ করে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বাইরে তাকালেন। কৃষ্ণা চক্রবর্তী অনিন্দ্য অর্ঘ্যের হাতের ওপর নিজের দ্বিধা দ্বন্দ্ব কম্পিত হাত রেখে বললেন, অনিন্দ্য, তোমার ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে।’ হৃদয়ের আলতো ছোঁয়ায় প্রথম যে স্পর্শ, তা থেকে যায় দুজনের মনের গভীরে। রক্তমাংসের মানুষ অনিন্দ্য। জীবনকে হঠাৎ নতুনরূপে দেখেছেন অবচেতন মনে। ফলে মানুষের গভীর মনস্তত্ত্বের রূপায়ণ করেছেন লেখক। যে অনিন্দ্য এত কঠোরভাবে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে সকলের অদূরে, সেও একসময় মনের কাছে নতি স্বীকার করেছে হয়তো কতটা জানা অজানার মাঝেই। মানবমন বড় অশ্চর্যের যাকে ধরতে গেলে ধরা দেয় না! জীবনদর্শনের রূপায়ণে লেখকের অগ্রসর মনেরই প্রকাশ ঘটেছে। লেখকের জবানীতে পায়, ‘কে যে কখন কার দখলে চলে যায়।’ এই একটি বাক্যে থেকে গেছে জীবনের সমস্ত দর্শন!
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, নেতাজি সুভাষ বসু, বিনয়- দিনেশ বাদলরা আত্মাহুতি দিয়েছেন। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে দেশকে ভালোবেসে গেছে। উপন্যাসকে কেন্দ্র করে কথাসাহিত্যিক রকিবুল হাসান তুলে ধরেছেন বাউল এবং লালন দর্শন। রবীন্দ্রনাথ যে এই বাউল দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হন সে- সম্পর্কেও বিভিন্ন তথ্য-তত্ত্বের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন লেখক। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে আধ্যাত্মিক আত্ম-জিজ্ঞাসার যে গভীর জীবনরহস্য উপস্থিত তার মূলে বাউল গান-ভাবনা-সুর। লালন এবং কুষ্টিয়ার বিভিন্ন সংস্কৃতির বর্ণনা উপন্যাসকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। কাহিনি বর্ণনায় লেখক যতটা সচেতন তার থেকে বেশি সচেতন উপন্যাসে সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন মিশ্রণ ঘটাতে।
সহজ-সরল ভাষায় তুলে ধরতে গিয়ে কাহিনির প্রয়োজনে কখনো কখনো উপমা, প্রবাদের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন লেখক। আশা করি, উপন্যাসটি পাঠক সমাজে সাড়া জাগাবে।
কুষ্টিয়ার বিখ্যাত লেখক মীর মশাররফ হোসেন, আকবর হোসেনের ‘অবাঞ্ছিত’ উপন্যাস, গগন হরকরার পরিচয় এবং সর্বোপরি গগন হরকরা কে এ সব ইতিহাসেরও সাক্ষাৎ ঘটেছে। অসংখ্য চরিত্রের উপস্থিতি। প্রধান-অপ্রধান। সকল চরিত্র মোটামুটি সক্রিয়। তবে হুট করে ফারজানার হারিয়ে যাওয়া পাঠক মনকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলো! লেখক হয়তো দেখাতে চেয়েছেন ফারজানা, ফারিয়া, এলিনা রহমান এরা কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায় একসময়। হতাশকণ্ঠে ফারজানা বলে, ‘কঠিনের থেকেও কঠিন। আমার পাপের ফাইলটা অনেক বেশি ভারী হয়ে গেছে। লালনের গানটা শোনোনি, সময় গেলে সাধন হয় না।’ এভাবে সময়ের গর্ভে হারিয়ে গেলো ফারজানা। ইতোপূর্বেও আমরা দেখেছি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়য়ের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র উইল বদল করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর কৃষ্ণকান্তের ছেলে হরলাল চরিত্রের আর হদিস পাওয়া যায় না। ওই চরিত্রকে বাদ দিয়েই উপন্যাস এগিয়ে চলে। এভাবে চরিত্র হারিয়ে গেলে পাঠক হোঁচট খায়।
নিতান্ত কিছু তুচ্ছ চাহিদার কাছে নিজের আত্মমর্যাদাকে যেমন খুইয়ে দিয়েছে ঠিক তেমনি একসময় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বেও ভুগেছে। সাবিহা চরিত্রটি সৃষ্টিতে কথাসাহিত্যিক বিশেষ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। যার প্রতিবাদ সমাজের কদর্য কিছু নিয়মের বিরুদ্ধে। চরিত্রগুলোর পরতে পরতে অনিয়ম, বাংলা সাহিত্য এবং বিভাগের প্রতি অবহেলা সবই দেখিয়েছেন। উপন্যাসটিতে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, শিক্ষাব্যবস্থা এসে একীভূত হয়েছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেমন হওয়া উচিত এবং একজন নীতি নির্ধারকের কেমন হলে তার অধীন সেক্টরটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে, সে পথেরই সন্ধান দিয়েছেন লেখক। এ জন্য কয়েকটি চরিত্রের মাধ্যমে বিষয়টি দেখিয়েছেন রকিবুল হাসান, ‘ড. সাদিক আহসান বললেন, কয়টা আন্তর্জাতিক সেমিনার হয়েছে- সেটাও ডাটা দেখে বলতে হবে। এখন থেকে পরিকল্পনা তৈরি করেন- সেমিস্টারভিত্তিক। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সেমিনার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিকল্পনাভিত্তিক নিয়মিত হবে। প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে তাদের পরিকল্পনা নেন। (…) স্টুডেন্টদের সাথে কাউন্সিলিং করবেন। বিভাগের শিক্ষকরা নিজেরা মিটিং করবেন। নতুন নতুন পরিকল্পনা করবেন। সেগুলো রেজিষ্ট্রার অফসেও পাঠাবেন। পনের দিন পর পর এসব বিষয় নিয়ে ভিসি মিটিং হবে।’ কথাসাহিত্যিক তাঁর অভিজ্ঞতা এবং সমাজিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন বিষয়গুলো।
বিপ্লবী বাঘা যতীনের ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও অনিন্দ্যের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া, দুটো ঘটনার সংমিশ্রণে উপন্যাসটি শেষ হয়েছে। এর মাধ্যমে সমাজের প্রতি সুধীসমাজের যে দায়, সেটাকেও লেখক এড়িয়ে যাননি। উপন্যাসটির ভেতরে বর্ণনায় এমনকি শেষে এসেও তিনি জুড়ে দিয়ছেন বর্তমান প্রেক্ষাপটকে। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের দুশ্চিতা অনিন্দ্যকে ছাপিয়ে তার ছাত্রদের জীবনের নিরাপত্তা সম্পর্কে ভাবিয়েছে। যা বর্তমান কালের সাক্ষী হয়ে রইলো। অনিন্দ্য বলছে, ‘বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিড়ালের মতো চাকরি মানায় না স্যার। বাঘা যতীন কিন্তু বাঘ মেরেছিলেন। (…) এখন তার মাথার ভেতর- চিন্তার ভেতর- ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাসের চিন্তা। করোনা ভাইরাস পুরো পৃথিবী মৃত্যু আতঙ্কে কাঁপছে। (…) আমার সোনার টুকরো শিক্ষার্থীরা যেনো ভালো থাকে, বেঁচে থাকে।’ লেখক বর্তমান বিষয়কে টেনে এনে উপন্যাসকে আরও একধাপ সামাজিক দায়বদ্ধ জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। মানবমনকে সবার তরে নিবেদন করেছেন, এখানেই লেখকের কালচেতনার প্রকাশ ঘটেছে। সহজ-সরল ভাষায় তুলে ধরতে গিয়ে কাহিনির প্রয়োজনে কখনো কখনো উপমা, প্রবাদের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন লেখক। আশা করি, উপন্যাসটি পাঠক সমাজে সাড়া জাগাবে।
অগ্নিকা আঁধার
রকিবুল হাসান
প্রকাশক: বটেশ্বর বর্ণন
প্রচ্ছদ: এ. কে. এম খালেকুজ্জামান
মূল্য: ৭২০ টাকা