রকিবুল হাসান প্রাবন্ধিক, শিল্প-সমালোচক, গবেষক, কবি ও ঔপন্যাসিক। সাহিত্য সাধনায় তার বহুমাত্রিকতা লক্ষণীয়। বলা বাহুল্য তিনি সব ধরনের লেখালেখিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিশোর বয়স থেকে কবিতা লেখার সূচনা। তিনি বাংলা সাহিত্য নিয়ে স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে পিএইচ.ডি ডিগ্রিও অর্জন করেছেন। সাহিত্য গবেষণায় তার নিষ্ঠা ও শ্রমলব্ধতার পরিচয় ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি। প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর-বাহির, আকবর হোসেনের কথা সাহিত্য: রূপলোক ও শিল্পীসিদ্ধি, বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা, মীর মশাররফ থেকে আকবর হোসেন ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থ হলো দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত, দেবতী দেউল, ধুলোমাটির ঘ্রাণ ইত্যাদি। বেশ কিছু উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জীবন দিয়ে ভালোবাসি, একী তৃষ্ণা একী দাহ, অহনা বউ।
রকিবুল হাসানের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস অগ্নিকা আঁধার (২০২১)। উপন্যাসটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনোযোগ আকষর্ণে সমর্থ হয়েছে। ‘চেয়ার ও মধুমক্ষিকা’, ‘সাধকের সাজা’, ‘নষ্টরাজের ফাঁদ’, ‘বিধায়কের বিধান’ এবং ‘তবুও আলো’ উপশিরোনামে এর আখ্যান পাঁচটি পর্বে বিভক্ত। উপন্যাসটির পটভূমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এটির নাম বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়। ঔপন্যাসিকের জন্মগ্রাম কয়াতে বিপ্লবী বাঘা যতীনের জন্ম। বিট্রিশবিরোধী এই বিপ্লবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ থেকে মূলত তিনি বাঘা যতীনের নামে একটি কাল্পনিক বিশ্বিদ্যালয় নামকরণ করে অগ্নিকা আঁধার উপন্যাসের পটভূমি নির্মাণ করেছেন। এটি লেখকের গভীর ঐতিহ্যপ্রীতি ও ইতিহাস চেতনার পরিচায়ক।
এ উপন্যাসের মৌল আকর্ষণ তাই এর চরিত্রচিত্রণ। আখ্যান বুননেও লেখকের শিল্পসিদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। কাহিনি বিন্যাস সর্বোপরি ভাষার আড়ম্বরহীন সরল শিল্পিত প্রয়োগ পাঠককে উপন্যাসের সূচনা থেকে শেষান্ত পর্যন্ত তীব্র আকর্ষণে মুগ্ধ করে রাখে।
অগ্নিকা আঁধার উপন্যাস পাঠে উপলব্ধ হয় ঔপন্যাসিকের গভীর সমাজ ও সমকাল মনস্কতা। সত্যনিষ্ঠ সমাজবাস্তবতা এবং নাগরিক জীবনের আড়ালের সত্যকে কী করে উপন্যাসে শিল্পরূপ দেয়া যায় তা-ই এ লেখকের অভীষ্ট। এ লক্ষ্যে তিনি সাহসের সঙ্গে উন্মোচন করেছেন তথাকথিত নাগরিক উচ্চশিক্ষিত এলিট শ্রেণির শ্রেণিচরিত্র। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় সমকালের নাগরিক জীবনপ্রবাহের প্রতি লেখকের গভীর অভিনিবেশ এবং কৌতূহল।
অগ্নিকা আঁধার উপন্যাসে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ভঙ্গুরতার চালচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থেকে এবং শিক্ষাকে পণ্য গণ্য করে এ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত। উপন্যাসে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সঙ্গে জড়িত ট্রাস্টিবোর্ড এবং শিক্ষক-কর্মকর্তার চরিত্র চিত্রণের ভেতর দিয়ে নাগরিক শিক্ষিত জনের আদর্শহীনতা, ভোগবাদিতা, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা ও বিশ্বাসঘাতকতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন লেখক। আব্দুল করিম, ড. ফারজানা, ড. এলিনা রহমান, ড. শাহেদ জামান উপন্যাসের এসব উচ্চ শিক্ষিত চরিত্র; এদের প্রত্যেকের অনেকগুলো মুখোশ রয়েছে। একেকটি মুখোশ বদলে এরা কখনো পরিবারে, কখনো কর্মস্থলে, কখনো সভা-সমিতিতে উপস্থিত হয়। কিন্তু একান্তে কিংবা চরম নিঃসঙ্গতায় এদের ভেতরের আসল সত্তাটি তাদের মুখোমুখি হয়ে আত্মজিজ্ঞাসায় নিজেদেরকে দ্বিধাদীর্ণ করে।
রকিবুল হাসানের অগ্নিকা আঁধার উপন্যাসে চরিত্রগুলো নিছক একপেশে বা দ্বন্দ্বহীন চরিত্রে পরিণত হয়নি। তাদের ভেতরের দ্বিধা নিজেদের রক্তাক্ত করে বলেই চরিত্রগুলো বাস্তব ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এ উপন্যাসের মৌল আকর্ষণ তাই এর চরিত্রচিত্রণ। আখ্যান বুননেও লেখকের শিল্পসিদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। কাহিনি বিন্যাস সর্বোপরি ভাষার আড়ম্বরহীন সরল শিল্পিত প্রয়োগ পাঠককে উপন্যাসের সূচনা থেকে শেষান্ত পর্যন্ত তীব্র আকর্ষণে মুগ্ধ করে রাখে।
আরও পড়ুন: অগ্নিকা আঁধার : পাঠ-প্রতিক্রিয়া ও মূল্যায়ন