সমাজের গতিবিধি ও কর্মযজ্ঞের প্রতিচিত্র আঁকা কথা-সাহিত্যিকের ধর্ম। এই কাজে যে লেখক যত স্বচ্ছ, তিনি পাঠকহৃদয়ে তত বেশি জায়গা করে নিতে পারেন। ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে সংঘটিত ঘটনাবলির অভিঘাতে লেখক কখনো ব্যথিত হন, কখনো হন উদ্বেল। মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার মিশ্রণে তিনি তৈরি করেন উপন্যাস-ছোটগল্প। কখনো বা নাটক। কবিতা কিংবা গান। তবে, জীবনকে বড় ক্যানভাসে আঁকতে চাইলে কবিতা কিংবা ছোটগল্পে সম্ভব হয় না। এজন্য তাকে উপন্যাসের আশ্রয় নিতে হয়। লেখকের এই স্বভাবের কারণে উপন্যাস ইতোমধ্যেই জীবনের বৃহত্তর ক্যানভাস আঁকার মোক্ষম ‘মাধ্যম’ হয়ে উঠেছে।
উপন্যাস জীবন ও জগতের কথা বলে। তাই এর বিষয় যেমন রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, পরিবারির কাহিনি হতে পারে, তেমনি শিল্পকারখানা, করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ও হতে পারে এর বিষয়। তেমনই একটি উপন্যাস রকিবুল হাসান রচিত ‘অগ্নিকা আঁধার’। এই উপন্যাসে ‘বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের একটি বেসরকারি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের বাংলা বিভাগকে ঘিরে যে অনিয়ম-দুর্নীতি-অনৈতিকতার চর্চা চলছে, তার বিবরণ তুরে ধরা হয়েছে। উপন্যাসটির চরিত্রগুলো জটিল। তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক অসরল। চরিত্রগুলো একে অন্যকে ব্যবহার করে কিংবা একে অন্যের শরণাপন্ন হয় কেবলই ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হীনমানসে। এসব চরিত্রের ব্যবহারিক-পেশাগত-আচরণীয় দিককে বিদ্রূপাত্মক ভাষায় রকিবুল হাসান তুলে ধরেছেন। এখানে বলে রাখা ভালো, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি-অনিয়ম-অনৈতিকতার বিরুদ্ধে ‘অগ্নিকা আঁধার’ই প্রথম কোনো উপন্যাস নয়।
এর আগে বাংলায় আহমদ ছফা লিখেছেন ‘গাভী বিত্তান্ত’ (১৯৯৫), ইংরেজি সাহিত্যে জর্জ অরওয়েল লিখেছেন ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ (১৯৪৫) । গাভী বিত্তান্তে বর্ণনা করা হয়েছে একজন উপাচার্যের দাস-মনোবৃত্তি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক কদর্য রূপ। অন্যদিকে ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এ ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ও পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিন যুগের আবহ প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে আমরা ধরে নিতে পারি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি-অনৈতিকতার বিরুদ্ধে স্বভাষা-বিভাষায় রচিত উৎকৃষ্ট উপন্যাসগুলোর পাঠ ছিল রকিবুল হাসানের। সেই পঠন-পাঠনেরই প্রতিক্রিয়া তার আলোচ্য উপন্যাস ‘অগ্নিকা আঁধার’। তবে, জর্জ অরওয়েলের অ্যানিমেল ফার্ম ও আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্তে’ মানুষ ও পশুর মধ্যকার আচরণ-স্বভাব বর্ণনার মাধ্যমে তারা প্রাতিষ্ঠানকে অনিয়মকে বিদ্রূপ করা হয়েছে। সমাজকে সচেতন করেছেন। এদিকে, রকিবুল হাসান কোনো আভরণের আশ্রয় নেননি, তিনি সরাসরি মানবচরিত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন।
এই উপন্যাসে বেশ কয়েকটি দিক মোটা দাগে চিহ্নি করা যায়।
১। বেশিরভাগ ক্ষমতাবান চরিত্রই অনৈতিকতাপন্থী।
২। উপন্যাসে উপস্থিত চরিত্রের কোনোটিই মূল নায়ক নয়। মূল নায়ক বিপ্লবী বাঘা যতীন।
৩। বর্ণনা কম, সংলাপ বেশি।
৪। চরিত্রগুলো মধ্যে হৃদয়ের সংযোগ নেই।
৫। লেখকের পর্যবেক্ষণ গুরুত্ব পায়নি।
৬। চরিত্রগুলোর সবাই লেখকের ভাষায়ই কথা বলে, তাদের নিজস্ব ভাষা নেই।
উপন্যাসের আয়তন অনুযায়ী চরিত্র-সংখ্যা প্রচুর হলেও মাত্র কয়েকটি চরিত্রের সংলাপেই তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত পরিচয় মেলে। প্রধান চরিত্রগুলো হলো বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ কো-অর্ডিনেটর ড. আব্দুল করিম, ভিসি শাহেদ জাহান, নতুন ভিসি সাদিক আহসান, বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ফারজানা, শিক্ষক ড. এলিনা রহমান, ফারজানার ব্যবসায়ী বন্ধু তুষার পারভেজ, অফিস সহকারী ফারিয়া ও আরিফুল। ঘটনা এগিয়ে চলে বাংলা বিভাগ পুনর্গঠনের কাজকে কেন্দ্র করে সিসি আব্দুল করিম, ভিসি শাহেদ জাহান ও ব্যবসায়ী তুষার পারভেজের সঙ্গে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ফারজানার চতুর্ভূজ সম্পর্কের উত্থানপতনের ভেতর দিয়ে। এই কটি চরিত্রের মধ্যে মূলত ঘটনাপ্রবাহ ঘোরে।
উপন্যাসের শুরুতেই লেখক দেখিয়েছেন, বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ফারজানার মনে ঝড় উঠেছে। এই ঝড়ের কারণ আব্দুল করিমের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি। ফারজানার স্বগতোক্তিতেই সেই সম্পর্কের খবর জানা যায়। ফারজানা চরিত্রে লেখক হীনতা-পরনিন্দা-শঠতার মতো যত নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য আছে, সবই ঠেসে দিয়েছেন। তাই ফারজানাকে দেখা যায় ভিসি শাহেদ জাহানের বিশেষ দাবি মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাকরি নিতে। সে কেবল ভিসির সঙ্গে রোমান্সে মেতে ওঠে না, সিসি আব্দুল করিমের সঙ্গেও গড়ে তোলে প্রেমের সম্পর্ক। এখানেই শেষ নয়, ব্যবসায়ী বন্ধু তুষার পারভেজের সঙ্গেও তার একই রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এভাবে জব পলিটিক্সের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে ফারজানা। ফারজানা এই চতুর্ভূজ প্রেমের মাঝে হঠাৎ বিপত্তি ঘটে দেয় এলিনা রহমান। এই নারী চরিত্রকে দেখা মাত্রাই সিসি আব্দুল করিম মুগ্ধ হয়ে যায়। এরপর ফারজানার প্রতি আকর্ষণ কমতে থাকে সিসির। এদিকে, বাংলা বিভাগে এলিনাকে ক্লাস দেওয়ার জন্য সিসি বললেও ফারজানা দেয় না। পরন্তু ভিসিকেও সে জানায়।
কারণ সমাজের সব মানুষ একই ভাষায় কথা বলে না, একে অন্যের ষোলো আনা প্রতিরূপ কখনোই হয় না। এ কারণেই লেখকের জীবন দর্শন যেমন উহ্য থাকে, তেমনি ভাষাশৈলী প্রচ্ছন্ন থাকে।
ইতোমধ্যে ভিসি শাহেদও এলিনার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। তার কাছে ফারজানার কদর কমতে থাকে। তবু ভিসিকে সন্তুষ্ট রাখতে অভিসারে যায় ফারজানা। অভিসার থেকে ফিরতে না ফিরতেই সিসি তাকে জানায় ভিসি শাহেদের চাকরি নেই। এবার ফারজানা দিশাহারা হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে নতুন ভিসি হিসেবে যোগ দেয় ড. সাদিক আহসান। এই সাদিক আহসানকে লেখক নীতিবান, আদর্শবান ও নিষ্ঠাবান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। নতুন ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে ফারজানাকে সরিয়ে দেওয়ায়। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে। এই অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে সব ধরনের কলুষতামুক্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন লেখক। তার চরিত্রে দিয়েছে আদর্শ, নীতিজ্ঞান ও কর্মনিষ্ঠা। আর ভিসি সাদিক বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অনিন্দ্যের চেষ্টায় বাংলা বিভাগকে গড়ে তোলার বর্ণনা দেন লেখক। তবে, এতটা আদর্শবান করে চরিত্র তৈরি করার পরও তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসিসহ কয়েকজনকে দিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বোনার চিত্র আঁকেন তিনি। ষড়যন্ত্র-অভিযোগের মুখে একসময় অনিন্দ্য পদত্যাগ করে। এরআগে পদত্যাগ করে ভিসি সাদিক আহসানও।
লেখক এখানে দেখিয়েছেন, ফারজানা, আব্দুল করিম, শাহেদ জাহান অনৈকিতার পথে ছিল। ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বরখাস্ত করা হয়। বিপরীতে সাদিক আহসান ও অনিন্দ্য সৎ-নিষ্ঠাবান-পরিশ্রমী। ষড়যন্ত্রের মুখে পড়ে তারা শেষপর্যন্ত পদত্যাগ করে চলে যায়। কোনো রকম কলুষতা তাদের স্পর্শ করতে পারে না। এদিক থেকে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায়, ভিসি-সিসি-বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের মতো বড় পদে যারা রয়েছে, তাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা নেই। তারা অসততা, অনৈতিকতার পথে প্রতিনিয়ত জড়িত ছিল। তাদের মধ্যে একদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অধীনস্তদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রবণতার দেখা গেছে, অন্যদিকে অধীনস্তরাও নিজেদের মেধা-প্রতিভাকে গুরুত্ব না দিয়ে শরীরকে পুঁজি করে একাধিক ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে চাকরি টিকিয়ে রাখার চর্চার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের এই সম্পর্কের ভেতরে শরীরের বিনিময়ে পুরস্কার, গাড়ি, লোন, পদ, পদোন্নতির মতো বস্তুগত ও পার্থিব স্বার্থ জড়িত থাকলেও তাদের হৃদয়বৃত্তির লেশমাত্র নেই।
ড. আব্দুল করিম, ড. শাহেদ জাহান, ড. ফারজানা, ড. এলিনা রহমান, তুষার পারভেজ, সাদিক আহসান ও অনিন্দ্য অর্ঘ্যের মধ্যে শেষোক্ত দুজনকে সবচেয়ে যোগ্য ও সৎ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বিপরীতে সবচেয়ে ধূর্ত-শঠ-অনৈতিক হিসেবে ফারজানাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে, লেখক যতই ফারজানা কিংবা এলিনাকে স্বার্থপর, শঠ হিসেবেই দেখান, কূটনৈতিক কৌশল ও অস্তিত্ববাদী চেতনার দিক থেকে পাঠকের চোখে এই দুটি চরিত্রই সফল। এই দুটি চরিত্রের ভেতরই বর্তমান সময় ও সমাজের অবক্ষয় যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে। যে সমাজ অনৈতিকতার পথেই সিদ্ধি লাভ করতে চায়, সে সমাজের চরিত্রগুলো আদর্শবান হবে, এমনটা আশা করাই তো অমূলক। সুতরাং সমাজ-কালের নিরিখে ড. ফারজানা ও ড. এলিনা সম্পন্ন আধুনিক চরিত্র। এই উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও কৌশলী চরিত্রও এই দুটি। ফলে পাঠকের সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে এই দুটি চরিত্র অসংখ্য অনুজ্জ্বল তারকার ভিড়ে জ্বলজ্বল করা দুটি ধ্রুবতারা মতোই শোভা পায়।
সাদিক আহসান ও অনিন্দ্য অর্ঘ্য সততার পথে সংগ্রামে পরাজিত, হাল ছেড়ে দেওয়া পলায়নপর চরিত্রের প্রতিভূ মাত্র। তাদের চরিত্রে যেমন কোনো কালিমা লেখক লেপে দেননি, তেমনি পাঠকও কোনো মহত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারে না। এই দুটি চরিত্র দৃশ্যত সৎ-মহৎ হলেও কার্যত পৌরুষহীন, ভীরু। বাকি চরিত্রগুলো স্রোতে গা-ভাসানো। সমাজবাস্তবতার নিরিখে তাদের অবস্থান ও আচরণে সামঞ্জস্য রয়েছে।
এসব চরিত্র গঠন ও তাদের সংলাপ, তাদের মধ্যেকার কর্মকাণ্ডের চিত্রায়ণে লেখককে নীতিবাদী মনে হয়। লেখক এখানে নীতির চর্চা করেছেন। তিনি যতটা নীতিবাদিতার চর্চা করেছেন, ততটা বাস্তবতাকে স্বীকার করেননি। স্থান-কালের নিরিখে তিনি নিরপেক্ষ থাকতে পারেননি। অনৈতিক সম্পর্কের অজুহাত তুলে তিনি ফারজানা, শাহেদ, করিম, এলিনার প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা দেখিয়েছেন। আর নীতিবান-আদর্শবাদ-সচ্চরিত্রবান সাজিয়ে সাদিক আহসান ও অনিন্দ্য অর্ঘ্যের প্রতি ষোলো আনা পক্ষপাত দেখিয়েছেন। নীতির প্রশ্নে পরিণতি যা-ই হোক, অস্তিত্ববাদী চেতনা ও স্থান-কালের নিরিখে দেখলে লেখককে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ-নিস্পৃহ-নিরাসক্ত বলা যায় না। বরং সৎ-নিষ্ঠাবানের প্রতি তার আসক্তি, বিশেষ পক্ষপাত পরিষ্কার হয়ে ওঠে। অথচ লেখককে মনে রাখতে হয়, নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনো একটি বা দুটি চরিত্রের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত কিংবা বিরাগ প্রকাশ করা তাকে মানায় না। কিন্তু ঔপন্যাসিক রকিবুল হাসান সাহিত্যের এই কঠিন শর্ত থেকে দূরে সরে এসেছেন। কেবল দূরেই সরে আসেননি, তিনি স্রষ্টা হিসেবে সৃষ্টির প্রতি সুবিচার করেননি। ব্যক্তিগত রুচি-অভিরুচির দাসত্ব করেছেন। ফলে ব্যক্তিগত পছন্দকে ছাপিয়ে যাননি।
উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাবান চরিত্রের বেশিরভাগকেই অসৎ-অনৈতিক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এরফলে সমাজের একটি বিশেষ চিত্র পাঠকের সামনে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। মানুষ মাত্রই স্বেচ্ছাচারী। তবে কেউ সংযম রক্ষা করতে পারে, কেউ পারে না। যার আত্মনিয়্ন্ত্রণ যত কম, তার স্বৈরাচারী আচরণ তত প্রকট হয়ে ওঠে। অগ্নিকা আঁধারে উপন্যাসে এই শর্ত ফুটে উঠে সিসি আব্দুল করিম, ভিসি শাহেদ জাহান, বাংলা বিভাগের চেয়ার ফারজানার আচরণে। এই চারটি চরিত্রকে লেখক খল-ধূর্ত-অনৈক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
উপন্যাসের প্রধান অনুষঙ্গ যদি কাহিনি হয়, তাহলে নায়ক-নায়িকা এর দ্বিতীয় অনুষঙ্গ। যদি নায়ক-নায়িকা উপন্যাসের দ্বিতীয় অনুষঙ্গ হয়, তাহলে বলতে হবে, এই উপন্যাসে বর্ণিত কোনো চরিত্রই প্রধান নায়ক কিংবা নায়িকা নয়। এর নায়ক যদি কেউ থেকেও থাকে, তবে তিনি বিপ্লবী বাঘা যতীন। যদিও উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ-সংলাপ দূরে থাকুক, দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ উপন্যাসের কাহিনি উপস্থিত কালের নিরিখে বর্ণিত, আর বাঘা যতীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আত্মাহুতি দিয়েছেন ১৯১৫ সালে। উপন্যাসের সময়ের সঙ্গে বিচার করলে বাঘা যতীনের উপস্থিতকালের সঙ্গে দূরত্ব ১০৬ বছরেরও বেশি। সুতরাং বাঘা যতীন এই উপন্যাসের নায়ক, তবে প্রচ্ছন্নরূপে। বাঘা যতীন দৃশ্যত কোথাও নেই, কার্যত উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রয়েছে। কাহিনি গড়ে উঠেছে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের আচরণ-সংলাপের ভেতর দিয়ে, উপন্যাস শেষ হয়ে বাঘা যতীনের ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে। অথচ উপন্যাসের ঘটনা-প্রবাহ চলমান রাখতে ও গতি বদলে ভূমিকা রাখে নায়ক বা নায়িক। একক কোনো নায়ক-নায়িকা উপন্যাসটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত না থাকায় সেই ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। তবে, বাঘা যতীনের ছায়া উপন্যাসটির পাতায় পাতায় শাসন করেছে। এই কারণে বাঘা যতীনকেই ‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যান্তর দেখি না।
এই উপন্যাসটি প্রায় বর্ণনাহীন। সংলাপে সংলাপে এগিয়েছে পুরো কাহিনি। উপন্যাসের শুরুতে সংলাপ, শেষেও। সংলাপধর্মিতার একটি বিশেষ গুণ হলো, কাহিনি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। চরিত্রের মনোজগৎ, স্বভাব, তার সামাজিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাঠকের মনে। চরিত্রগুলোর ভেতর লেখকের চিন্তা ঢুকে পড়লেও তাকে আরোপিত মনে হয় না। কারণ লেখক সেখানে মন্তব্যহীন-নিস্পৃহ-নিরাসক্ত। লেখক সেখানে অনেকটাই দূরদর্শনের দর্শকমাত্র, চরিত্রের গঠন কিংবা কাহিনি বর্ণনায় তার প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকে না। এ কারণে সংলাপপ্রধান উপন্যাস-গল্পে লেখকের জীবনদর্শন-ভাষাশৈলী প্রায়ই উহ্য থাকে। তার জীবনদর্শন-ভাষাশৈলীকে সামনে নিয়ে আসার সুযোগ প্রায় থাকে না। কারণ, লেখকের এই দুটি গুণ চরিত্রের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করতে হলে সে চরিত্রগুলোকে লেখকের মানস-জগতের প্রতিবেশী কিংবা সমাত্মীয়ই হতে হয়। আর যদি চরিত্রকে নিজের মানসজগতের প্রতিবেশী বা সমাত্মীয় করে তৈরি করেন লেখক, তাহলে সেই উপন্যাস পাঠকের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়। কারণ সমাজের সব মানুষ একই ভাষায় কথা বলে না, একে অন্যের ষোলো আনা প্রতিরূপ কখনোই হয় না। এ কারণেই লেখকের জীবন দর্শন যেমন উহ্য থাকে, তেমনি ভাষাশৈলী প্রচ্ছন্ন থাকে।
লেখক বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় দেশের একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে জব পলিটিক্স কী পরিমাণ ভয়ানক হয়ে উঠেছে—তা চিত্রিত করেছেন। এ জন্য কাহিনি বর্ণনার পাশাপাশি চরিত্র চিত্রণ ও সংলাপও রচনা করেছেন। এসবের ভেতর দিয়ে বর্তমান সময়ের সমাজ ও মানুষের চিত্র এঁকেছেন, নিজের মতো করে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই।
উপন্যাসটি সংলাপধর্মী হলেও কিছু কিছু বর্ণনাও আছে, হোক তা কখনো এক বাক্যে, কখনো বাক্যাংশের মাধ্যমে। সংলাপধর্মী উপন্যাসেও চরিত্রের স্বভাব-পেশা অনুযায়ী ভাষা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারতো। কিন্তু এই উপন্যাসে লেখক সব চরিত্রের মুখেই একই ভাষা দিয়েছেন। একথা অনস্বীকার্য যে, প্রতিটি মানুষই আলাদা সত্তা, তার আলাদা স্বর-সুর থাকে। মানুষ কখনোই রোবট নয়, সে সপ্রাণ। তাই একই ছাদের নিচে বসবাস করেও কোনো দুজন মানুষের সুর-স্বর একই রকম হয় না। এই উপন্যাসের বর্ণনায় লেখক যে ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে, চরিত্রের সংলাপেও সেই শৈলীর প্রয়োগ রয়েছে। অর্থাৎ চরিত্রগুলোর নিজস্ব কোনো ভাষা নেই, তারাও লেখকের শেখানো ভাষায় কথা বলেছে। অথবা চরিত্রের ভাষায়ই কথা বলেছেন খোদ লেখক। ফলে সংলাপ হয়ে পড়েছে বৈচিত্রহীন, একগেয়েমি। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক:
০১.
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য
আপনার কাছে আমার নামে আরও অভিযোগ আসবে। আমাদের বিভাগে আশি-নব্বইজন শিক্ষার্থীদের জন্য আঠাশ উনত্রিশটি কোর্স অফার করা হতো। নয়জন খণ্ডকালীন শিক্ষক পড়াতেন। দীর্ঘদিন এরকম হয়ে আসছে। এক একটা কোর্সে মাত্র দুজন চারজন করে ছাত্র। সেমিস্টার শেষে শুধু তাদেরই প্রায় দশ লাখ টাকা করে বিল দিতে হয়। আমি এটা বন্ধ করে দিয়েছি। প্রত্যেক কোর্সে ন্যূনতম পনের জন করে শিক্ষার্থী থাকতে হবে। এখন খণ্ডকালীন শিক্ষক মাত্র তিন জন। আবার শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও একশ বিশ ত্রিশ জন হয়ে গেছে। সামনে এক দু সেমিস্টার পরে আর একজন ফ্যাকাল্টি নিলে খণ্ডকালীন শিক্ষকের কোনো প্রয়োজন পড়বে না। বিভাগের ভাবমূর্তিও বাড়বে। ব্যয়ও কমে আসবে।০২.
ড. সাদিক আহসান
ড. ফারজানা, আমি এখানে এসেছি এক বছরের বেশি। আপনাকে কিছু কাজ দিয়েছিলাম। ডিন আব্দুল হামিদকেও আমি বলেছি আপনাকে সহযোগিতা করার কথা। উনি অনেকবার আপনাদের সাথে বসেছেন। প্রোভিসি, সিসি সাহেবরাও আপনাকে, আপনার টিচারদের ডেকে অনেকবার মিটিং করেছেন। এমনকি আপনি নিজে যে পরিকল্পনা দিয়েছেন, তার একটাও কার্যকরি করতে পারেননি। বলুন তো মূল সমস্যা কোথায়?০৩.
ড. এলিনা রহমান
আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ড. সায়ন্তির পিএস ছিল। এখন অবশ্য নেই। ও একটু আড়াল থেকে এসব মোবাইলে ভিডিও করেছিল। আমাকে দেখিয়েছে। আমি নিতে চেয়েছিলাম। দেবো দেবো করে আর দেয়নি। পরে ও নিজেও বিদেশ চলে গেছে। আগের মতো যোগাযোগও নেই। দেখি, আবার কখনো কথা হলে, ভিডিওটা চাইবো। পেলে, আপনাকে দেখাবো।০৪.
আব্দুল করিম
বাংলা বিভাগে অনেক কাজ করতে হবে স্যার। এটা সবচেয়ে বেশি লোকসানের ডিপার্টমেন্ট। এতদিন জোড়াতালি দিয়ে ডিপার্টমেন্ট চলে আসছে। এভাবে চালানো যাবে না। বোর্ড তো বাংলা বিভাগকে কোনো গুরুত্বই দিতে চায় না। জার্নাল করলে এর জন্য তো বাজেট লাগবে। চেয়ারম্যান স্যারকে বললেই তো রেগেমেগে আগুন হয়ে যাবেন।০৫.
ড. ফারজানা
কোনদিনে আবার আমার বিদায়পত্র লিখে না ফেলেন! কে কোথায় কী বলে বসে, কে কোথায় কী রটিয়ে দেয়! আমার অনেক ভয় করে। আচ্ছা আপনাকে একটা কথা বলবো, আপনি আমাকে এত পছন্দ করেন, ভালোবাসেন, প্রতিদিন প্রায় সারা দিন একসঙ্গে এভাবে থাকি, ভাবি এসব জানেন?০৬.
লেখকের কথা
মাসখানেকের মধ্যেই বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য হিসেবে প্রফেসর ড. সাদিক আহসান যোগ দিলেন। সবার মনে একটাই আশঙ্কা নতুন ভিসি কেমন হবেন! আগের ভিসির মতোই হবেন কি না! সবার ভেতরেই একটা ভয়, একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছে। সবচেয়ে বেশি ভয় কাজ করছে ড. ফারজানার ভেতর, আব্দুল করিমের সঙ্গে তার একটা দূরত্ব যে তৈরি হয়ে যাচ্ছে; ড. এলিনা রহমান যে এটা করাচ্ছেন, তা তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন।
ওপরের উদাহরণের প্রথম ৫টি সংলাপ ৫ চরিত্রের। ৬ নম্বরটি লেখকের বর্ণনা থেকে নেওয়া। গভীর মনোযোগের প্রয়োজন নেই, সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে, ৫ চরিত্রের সবার সংলাপের ভাষা একই। একই সুরের। চরিত্রগুলোর নাম মুছে দিলে কোন সংলাপ কার, তা নির্ণয় করা সুকঠিন হবে। এসব সংলাপ স্বাতন্ত্র্যহীন, একই সুরের। একই ধরনের শব্দসহযোগে রচিত। এমনকি ৬ নম্বর উদাহরণে থাকা লেখকের যে ভাষা রয়েছে, তার সঙ্গে প্রথম ৫ জনের ভাষারও কোনো পার্থক্য নির্ণয় করা যায় না। এই প্রবণতা লেখকের জন্য যতই সুবিধাজনক হোক, সাহিত্যের জন্য অস্বস্তির। এরই প্রভাব পড়েছে উপন্যাসে লেখকের পর্যবেক্ষণ প্রকাশের ক্ষেত্রেও। সংলাপের ভেতর দিয়ে দীর্ঘ কাহিনি এগিয়ে নেওয়ায় সেখানে লেখকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের স্বাক্ষর পাওয়া যায় না। লেখকও নিজেকে পর্যবেক্ষক-দ্রষ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তিনি কেবলই ধারাভাষ্য দিয়েছেন, সেই বর্ণনার সঙ্গে তার মন ও মননের সংযোগ কতটুকু, সেই খবর পাঠককে তিনি দেননি।
তবে, একথা বলা অসঙ্গত হবে না যে—শেষোক্ত ত্রুটিকে বড় করে না দেখে বিষয়ের দিকে তাকালে লেখকের কৃতিত্ব কোথায়, তা পরিষ্কার হবে। লেখক বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় দেশের একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে জব পলিটিক্স কী পরিমাণ ভয়ানক হয়ে উঠেছে—তা চিত্রিত করেছেন। এ জন্য কাহিনি বর্ণনার পাশাপাশি চরিত্র চিত্রণ ও সংলাপও রচনা করেছেন। এসবের ভেতর দিয়ে বর্তমান সময়ের সমাজ ও মানুষের চিত্র এঁকেছেন, নিজের মতো করে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই। এখানেই লেখকের স্বকীয়তা, এখানেই তার সততা।
আরও পড়ুন: অগ্নিকা আঁধার : পাঠ-প্রতিক্রিয়া ও মূল্যায়ন