বিবস্ত্র বাস্তবতার এক মহাকাব্যিক আত্মহুতি ‘অগ্নিকা আঁধার’ যেখানে একটি জাতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিত নিকষ কালো অন্ধকারে ডুব সাঁতাররত অবস্থায় আন্দোলিত করেছে পারিপার্শ্বিক আলো আঁধারের নানান ভাঁজকে। বিষয়গত জায়গা থেকে স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক রকিবুল হাসানের ( ৩১ মে, ১৯৬৮) ‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসটি বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গণ কেন্দ্রিক কাহিনি নিয়ে নির্মিত হলেও এটি প্রাসঙ্গিকতাকে সমন্নুত রাখা পূর্বক উপন্যাসের গঠনগত কাঠামোকে অক্ষুন্ন রেখে অত্যন্ত সুকৌশলে আপন সীমানায় ঢেলে সাজিয়েছে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গকে যেগুলো একটি জাতির ভিত্তিপ্রস্তর। উপন্যাসটিতে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, মনোগত প্রবৃত্তিসহ ইতিহাস-ঐতিহ্য, লোকায়ত বিশ্বাস, দর্শন, সাংস্কৃতিক দর্পণ ইত্যাদি সকল মূলগত ভিত্তিপ্রস্তরকে ঔপন্যাসিক উপস্থাপন করেছেন ক্ষয়িষ্ণু বাস্তবতার টালমাটাল চেতনাপ্রবাহের জায়গায় রেখে। উপন্যাসটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রকৃত শিক্ষিত সত্তার অনড় অবস্থান।
ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে বৃহত্তর জীবনের শৈল্পিক ও সামগ্রিক প্রকাশ মাধ্যমহল উপন্যাস। উপন্যাসের উপন্যাস হয়ে উঠা বা সার্থকতা সবই নির্ভর করে তাতে শিল্পিত জীবনের বহুমাত্রিকতা ও প্রস্ফুটিত জীবনাদর্শের গ্রহণযোগ্যতার উপর। উপন্যাসে একজন ঔপন্যাসিক সময়-কাল-পাত্র অনুযায়ী প্রতিপাদ্য বিষয়কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও জীবনাদর্শের নিরীখে পাঠকের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যা অন্যের চিন্তার ও আদর্শের জায়গাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। উপন্যাসেরপ্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু, কাহিনি, ঘটনা, চরিত্র , ভাষা, গঠন কৌশল , নামকরণ, জীবনাদর্শ ইত্যাদি যখন ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন ও সমষ্টিগত জীবনকে বৃহত্তর অবস্থান থেকে নাড়া দিতে সক্ষম হয় তখন তা হয়ে উঠে একটি সার্থক শিল্প। সমাজ-রাজনীতি সচেতন ঔপন্যাসিক রকিবুল হাসান অগ্নিকা আঁধার নির্মাণে দিয়েছেন সাহস, মেধা ও মননশীলতার পরিচয়। সাহস শব্দটি উপন্যাসটির বিষয়বস্তুকে নির্দেশ করে আক্ষরিক অর্থে, যদিও একজন শিল্পির পক্ষে সাহসী হওয়াই সময়ের দাবী। কিন্তু উপন্যাসটির সার্থকতারমূল জায়গাটি এর বিষয় বিন্যাস। বলা যায়, উপন্যাসের বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক সুবিচার করার জায়গায়, বিষয়বস্তুকে কৌশলে বহুমাত্রিকতা দান করার জায়গায় লেখক অসামান্য পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন যা সময়কে অতিক্রম করে কালের সাক্ষী হওয়ার অপেক্ষায়।তবে পাঠক চাহিদা যে দু-একটি অপূর্ণতার জন্ম দেয় তা ব্যক্তির মনোজাগতিক অবস্থানভেদে স্বাভাবিক যা লেখকের দায়কে বাড়িয়ে দেয়।
‘অগ্নিকা আঁধার’উপন্যাসের প্রেক্ষপট করোনাপূর্ববর্তী সময়ের শিক্ষাঙ্গনকেন্দ্রিক অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শিক্ষিতজনের চারিত্রিক অসংলগ্ন আচরণ ও ক্ষুদ্র স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত অন্যায় শোষণে বিপর্যস্ত শুভবোধের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়ন। উপন্যাসটিতে ব্যক্তি চরিত্রের পদস্খলন ও অন্তঃসারশূন্য সন্মান প্রাপ্তির লোভ উপন্যাসটির অসংখ্য চরিত্রকে অবাধ যৌন আকাঙ্ক্ষা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পুতুল সর্বস্ব মুখোশধারীতে পরিনত করেছে। নারী পুরুষের সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা সম্পর্কে সমাজের এক শ্রেণির মানুষ অবগতই নন, অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য তারা নিজেদের ক্ষমতালব্ধ অবস্থান, জায়গা গত পবিত্রতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে নিজের বিকৃত রুচিকে খোড়াক জোগান দিতে থাকেন। অন্যপাশে এই নেতিবাচক পরিচালনা কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হয়ে ভুক্তভুগী হন কিছু সুন্দর প্রাণ, স্বচ্ছ শিক্ষিত মানুষ। এদের মধ্যে কথিত ক্ষমতা ও সন্মান এর লোভে কিছু মানুষ অস্তিত্ববাদী সত্তার নিন্মগামী ধারায় প্রবাহিত হয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হন, কেউ আবার সকল কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মাথা উঁচু করে বাঁচার শপথে হন চির সংশপ্তক। এ আলো-আঁধারের খেলার প্রান্তরেই লিখিত প্রজ্ঞাবান ঔপন্যাসিক রকিবুল হাসানের মননশীল উপন্যাস ‘অগ্নিকা আধার’।
‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসের কাহিনি নির্মিত হয়েছে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যলয় নামক বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে যেখানে বাংলা বিভাগকে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী ও কর্মকর্তারা নিজেদের অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিচালনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ কো-অর্ডিনেটর আব্দুল করিম থেকে শুরু করে ভিসি ডক্টর শাহেদ জাহান, উপদেষ্টা এম জামাল খান পর্যন্ত অবৈধ সম্পর্কের অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ দ্বারা পরিচালিত। নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সব সুবিধা দেওয়া থেকে শুরু করে, যাকে প্রয়োজন নেই তাকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা বা বিপদে ফেলা সবই এদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডক্টর ফারজানা, শিক্ষক ডক্টর এলিনা রহমান থেকে শুরু করে ডক্টর সেলিনা পর্যন্ত ক্ষমতা, চাকরি ও মিথ্যে সম্মানের জন্য ততধিক বার একাধিক স্থানে, পাত্রে জল ঘোলা করে নিজেদের শিক্ষাকে কলুষিত করেছে। শুধু তাই নয়, বিভাগের প্রোগ্রাম অফিসার ফারিয়া, পিউন আরিফুল পর্যন্ত ওই একই চারিত্র্যিক ত্রুটির বৃত্তে আবর্তিত। যেন পুরো ব্যবস্থাটা অসুস্থ, অন্যায্যতার অন্ধকারে পথ হারাচ্ছে। এ বিপদ্গামী মানুষ গুলোর পথ সাপের গতির মতোই আঁকাবাঁকা, পিচ্ছিল আর ছিল বহুগামী—কখনো ডক্টর ফারজানা, কখনো ডক্টর এলিনা। সবাই শিকার, সবাই শিকারি, টিকে থাকার মিথ্যে লড়াই পরিচালিত হত মেধা দিয়ে নয়, নিষিদ্ধতা দিয়ে—‘ভগবান কার পূজো নেবে আর কার পূজো না-নেবে/ এ তো এখন নতুন করে অগ্নিখেলা শুরু হয়ে গেল।’
বাউল সম্রাট লালন সাঁইজির ‘মনের মানুষ’তত্ত্ব প্রভাবিত দর্শন হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবন দেবতা’র দর্শন। রবি ঠাকুর গোরা উপন্যাস, জীবনস্মৃতি গ্রন্থ, নাটক, প্রবন্ধে বাউল তত্ত্বের কথা বলেছেন যা বাংলার লোকায়ত মানুষের ধর্ম।
কাহিনির এক প্রান্ত এ ধরনের নেতিবাচক চরিত্রে জরাজীর্ণ। তবে এ উপন্যাসে কিছু আলোক বর্তিকা রয়েছে যার কিরণ অবদমিত থেকেও আলো ছড়িয়েছে অনন্য উপায়ে। নেতিবাচক চরিত্রের কারণে চাকুরি হারানো উপাচার্যের স্থলে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হন প্রফেসর ডক্টর সাদিক আহসান। ন্যায়-নিষ্ঠার মূর্তপ্রতীক এই মেধাবী আদর্শ স্বচ্ছতার জায়গা থেকে বাংলার গর্ব বিপ্লবী বাঘা যতীনের আদর্শে সবার মিলিত প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন ও কাজ করেছিলেন। রিসার্চ, সেমিনার, জার্নালের ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বের ব্যাপকতার ধারণার বীজ বোপন করেন। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প- সংস্কৃতি সাহিত্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্চার একটি অন্যতম বিষয় তা উঠে আসে এখানে, ‘ড.আহসান বললেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী—এ সব বিপ্লবীদের সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।…আচ্ছা, মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ দাশ-জসীম উদ্দীনসহ আমাদের যেসব প্রধান কবি সাহিত্যিক আছেন তাদের নিয়ে আপনি এ পর্যন্ত কয়টা সেমিনার করেছেন?’
কাহিনির আদি পর্বের পরিশেষে ডক্টর সাদিক আহসানের প্রচেষ্টাতেই ‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসে অনুপ্রবেশ ঘটে উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ্যের। বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে ডক্টর ফারজানার পরে সততা ও মেধার পরিচয় দিয়ে নিরপেক্ষভাবে ঘটনার নায়ক হয়ে আসেন অনিন্দ্য। তার আদর্শ, কর্মপন্থা, পরিশ্রম, ব্যক্তিত্ব আর কর্মস্পৃহা উপন্যাসটির বিষয়বস্তুকেন্দ্রিক ভয়ানক বাস্তবতার জায়গায় পাঠকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। বৃহৎ কল্যাণের পক্ষে শুভশক্তির বিন্যাস ঘটে এই চরিত্রে। কিন্তু তার সততা তাকে বারবার নানান ধরনের বিপদের সম্মুখীন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা এম জামাল খানের কালো ছায়া ও সর্বগ্রাসী চক্রান্তে বাধাগ্রস্ত ও অবমাননার শিকার হতে হয় আদর্শ ও শুভবোধের আলোকবর্তিকাকে। একে একে স্বার্থ ও ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ববাদী লড়াইয়ে জয়ী হয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে নেতিবাচকতার পরাজয় ঘোষণাপূর্বক পদকে ত্যাগ করেন ডক্টর সাদিক আহসান ও ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ্য। অর্থ বা বিজয়ী পদোন্নতি কোনোটিই এই আদর্শকে আটকায়নি, আসন্ন মহামারীতে প্রিয় শিক্ষার্থীদের সৃষ্টির শুভবোধের কাছে সমর্পণ করে গেছেন তিনি—‘মহান বিপ্লবী বাঘা যতীন, তোমাকে স্যালুট। তোমার আলোটা বুকে নিয়েই পথ চলি।’
অগ্নিকা আঁধার উপন্যাসে ঘটনার প্রতিস্থাপনে রকিবুল হাসান বিষয়গত প্রত্যয়ে যে বিশালতার পরিচয় দিয়েছেন, তা অভূতপূর্ব একটি সংযোজন। উপন্যাসটিতে বাংলা সাহিত্যের অতীত-বর্তমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, ব্রিটিশ বিরোধী অবস্থান, ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, মুক্তিযুদ্ধ,ইতিহাসে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ভূমিকা, বাংলা ভূমির বিভিন্ন তত্ত্ব, ছাত্র রাজনীতি, বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থান ইত্যাদি অসংখ্য বিষয় অত্যন্ত সচেতনার সঙ্গে উঠে এসেছে। বিষয়গত এই বৈচিত্র্যের জন্য উপন্যাসটি বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরার একটি অনন্য সাধারণ মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়েছে পাঠকের সামনে।
উপন্যাসের শুরুতেই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের অর্থাৎ কাব্য সাহিত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়—‘দবসহি বহুড়ী কাউহি ভঅই/ রাতি ভইলে কামরু জাই।’
উপন্যাসের মধ্য পর্বে গদ্য সাহিত্যের উল্লেখও এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ সাহিত্যের সঙ্গে মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনের সুর-তালের সংযোগকে জীবন্ত করে তোলে। এ ছাড়া অনিন্দ্য অর্ঘ্য ও কৃষ্ণা চক্রবর্তীর কথোপকথনে উঠে এসেছে বাংলাদেশের আধুনিক কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সৃষ্টির কথা। শুধু তাই নয় বাংলা সাহিত্যের সমকালীন লেখক বর্গের পরিচয়ও ঔপন্যাসিক রকিবুল হাসান চমৎকার কৌশলে উপস্থাপন করেছেন—‘আমাদের ওখানে আরও অনেকেই ভালো উপন্যাস লিখেছেন। সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, সেলিনা খাতুন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, রাবেয়া খাতুন, রাজিয়া বেগম, শহিদুল জহির সবাই বিখ্যাত ঔপন্যাসিক। …আনিসুল হক, আতা সরকার, মঈনুল আহসান সাবের, নাসরীন জাহান, রেজানুর রহমান, জাকির তালুকদার, রফিকুর রশীদ, মঈনুদ্দীনকাজল, মোহিত কামালসহ আরো অনেকেই আছেন—ভালো লিখছেন।’
উপন্যাসটির একটি বিশেষত্ব হলো এটি দুই বাংলার শিল্প সাহিত্যের মেলবন্ধনকেও উপস্থাপন করেছে যা বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের একটি অত্যন্ত আবেগের জায়গা।
‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসে ব্রিটিশবিরোধী অবস্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে। বিপ্লবী বাঘা যতীন কিভাবে ব্রিটিশবিরোধী চেতনায় দণ্ডায়মান থেকে বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীতীরে ১৯১৫ সালে কিশোরদের নিয়ে সম্মুখে প্রতিবাদ যুদ্ধ করে নতুন চেতনায় বাংলার মানুষকে জাগরিত করেছেন এবং বাংলার শব্দ সৈনিকেরা কিভাবে সাহিত্যে তাদের আদর্শের বীজ বোপন করেছেন তা এসেছে কাজী নজরুল ইসলামের ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের বিশ্লেষণে, ‘নব-ভারতের হলদিঘাট’ কবিতার নিবেদনে। বিপ্লব, স্বাধীনতা আর শিল্প সাহিত্য যে একই অভিপ্রায়ের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ তা উপস্থাপনেও রকিবুল হাসান সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন বলতেই হয়।
বাংলা সাহিত্যে যে বাউল তত্ত্বের ছায়াপাত ঘটেছে তা মূলগত সাদৃশ্যের জায়গা বিশ্লেষণপূর্বক উপন্যাসে বলা হয়েছে যা শিল্প সাহিত্যের একটি শাখার সঙ্গে আরেকটি শাখার পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়া দেখিয়ে একটি’ জাতির সংস্কৃতির প্রবহমান ধারার গতিপথকে চিহ্নিত করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউল তত্ত্ব দ্বারা কীরকম ভাবে প্রভাবিত ছিলেন তা উপন্যাসে প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে লালন সাঁইজির ভাবশিষ্য গগন হরকরা’র সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ভাব বিনিময়ে বিষয়টিতে—‘‘গগন হরকরা মনে মনে গান তৈরি করে…। আমাদের জাতীয় সংগীত—‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’—এই গানটির সুর কিন্তু গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে/ আমার মনে মানুষ যে রে’ গানের সুর থেকে নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও গানের কথাতেও মিল রয়েছে।’’
বাউল সম্রাট লালন সাঁইজির ‘মনের মানুষ’তত্ত্ব প্রভাবিত দর্শন হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবন দেবতা’র দর্শন। রবি ঠাকুর গোরা উপন্যাস, জীবনস্মৃতি গ্রন্থ, নাটক, প্রবন্ধে বাউল তত্ত্বের কথা বলেছেন যা বাংলার লোকায়ত মানুষের ধর্ম। রবীন্দ্র সংগীতের অনেক গান যে বাউল তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত তার পরিচয় পাওয়া গেছে এই উপন্যাসে।
উপন্যাসটির বিষয়বস্তুতে বেসরকারি বিশ্ববিধ্যালয়ের নানান প্রশাসনিক জটিলতা, কূটকৌশল ও চক্রান্তের অলক্ষে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষকদের মতামত বিনিময়ের বিষয়টিও প্রকাশ পায়। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাস সচেতন লেখক রকিবুল হাসান মুক্তিযুদ্ধে করা বিদেশি সহমর্মিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তকেও ঘটনার ঘনঘাটায় উপন্যাসে স্থান দিয়েছেন। এখানে অ্যালেন গিন্সবার্গের বিখ্যাত সৃষ্টি ‘দ্য সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ আবৃত্তির মাধ্যমে এক তরুণের মধ্যে স্থিত দেশপ্রেমের বোধ প্রকাশ পেয়েছে যা মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের সজীব দেশপ্রেম ও চেতনার শুভ্রতার চিত্র অঙ্কন করে—‘গাড়িতে বসেই ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য চমৎকার করে The September on Jessore Road কবিতাটি কৃষ্ণা চক্রবর্তীকে শোনাতে থাকেন-
Millions of babies watching the skies
Bellies swollen, with big round eyes
On Jessore Road-long bamboo huts
No place to shit but sand channel ruts.
মুক্তিযুদ্ধেরআরেকটি অনন্যসাধারণ প্রসঙ্গ এসেছে উপন্যাসটিতে। সেটি হল বীরাঙ্গনাদের সন্তান, যাদের অনেককে বিদেশিরা দত্তক নিয়েছেন। একটা স্বাধীনতা বিরোধী কুচক্রীমহল তাদের অস্তিত্বকে মেনে নিতে চায়নি। অগ্নিকা আঁধার উপন্যাস দেখিয়েছে যে সেই অশুভ শক্তি যেন এখনো অপশোষণের অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখছে বাংলার সূর্যকে। তাদের প্রতি যথার্থ জবাবও রয়েছে উপন্যাসটিতে—‘সে সব যুদ্ধশিশুদের বাবা-মায়ের নাম কি জানেন স্যার? / না, তুমি বলো।/ বাংলাদেশ।’
বিষয়গত জায়গা থেকে উপন্যাসটির কাহিনি শিক্ষাঙ্গনকেন্দ্রিক পরিচালিত ক্ষমতা ও চারিত্র্যিক দুর্বলতাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। একটি ইন্দ্রিয়গত দুর্বলতা সর্বশক্তিশালী হয়ে উপন্যাসটির আদি-মধ্য-অন্তের চরিত্রগুলোকে পুতুলের মতো নাচিয়েছে, যেখানে ডক্টর সাদিক আহসান, ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ্যের মতো দু’চার জন আদর্শবান ব্যক্তি ছাড়া কারোরই ব্যক্তিত্ব, আদর্শ বা শিক্ষার ধার ছিল না। সবাই যেন আত্ম-নিয়ন্ত্রণহীন প্রতিবন্ধি ছিল। যে নেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্জ, উপদেষ্টা শরীরী সংস্রবের জন্য নিজের সম্মান, আদর্শ ও ন্যায়নীতিবোধকে অধীনস্তের পায়ে ঢেলে দিয়েছে সেই একই নেশায় প্রোগ্রাম অফিসার ফারিয়াও বিভাগীয় প্রধান অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে এবং পিউন আরিফুলের সংস্রবে গেছে। চরিত্রের নিন্মগামীতার দিক থেকে ডক্টর ফারজানা, ডক্টর এলিনা, ডক্টর সেলিনা খাতুন, শাহিদা ম্যাডাম, আইভি আইরিন, ডক্টর সায়ন্তিরা সবাই সমান, শিক্ষক হয়েও কুরুচিসম্পন্ন কেবল রক্ত মাংসের শরীর, ফারিয়ার সঙ্গে এদের কোনো পার্থক্য নেই। শিক্ষা এদের শুধু ডিগ্রি দিয়েছে, শিক্ষিত করেনি। আর কামনার কাছে নিজের সর্বস্ব লুটিয়ে দেওয়া কো-অর্ডিনেটর আব্দুল করিম, সালেহ সালেহীন, ভিসি ডক্টর শাহেদ জাহান,উপদেষ্টা এম জামাল খান আর প্রেমাসক্ত পিয়ন আরিফুলের সঙ্গে চারিত্রিক দিক থেকে কোনো পার্থক্যই নেই। বরং আরিফুল সময়ের ফেরে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে যে, সে ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ্যের বিরুদ্ধে অপবাদ দেওয়াতে ফারিয়াকে সাহায্য করে অপরাধ করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ও সমাজের উঁচু স্তরের মানুষগুলো আয়নায় একবার নিজেদের কুৎসিত প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাননি পর্যন্ত। তবে ডক্টর ফারজানা ও সেলিনা’র ভেতর গ্লানিটুকু উদিত হতো ভোররাতের আলোর মতন। কিন্তু অন্য নারী চরিত্রগুলোর প্রায় প্রত্যেকেরই শরীরসর্বস্ব ক্ষমতা ও যোগ্যতাহীনতা পাঠক মনে প্রশ্ন তুলবে।
বিশেষ করে তখন যখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা আজকের বাজার অর্থনীতির সামনে মূল্যহীনতায় বার বার অবমাননার শিকার হওয়ার পরও উপন্যাসটিতে উচ্চারিত হয়েছে, যেখানে বাংলা বিভাগ থাকে না সে-টি কোনোবিশ্ববিদ্যালয়ই নয়।
অপরাজিত একটি নারী চরিত্রের অভাব যদিও বিনা অপরাধে চাকরি হারানো শিক্ষিকার মাধ্যমে কিছুটা পূরণ হয়, তবু তা পাঠকের মনের সম্পূর্ণ আশাকে পরিতৃপ্ত করে না। প্রতিটা আলোক বাতি যেন নিম্নগামী অন্ধকারের দিকে ধাবিত ছিল, যেখানে নিজের কামনাজনিত লোভ খোলা চোখের অন্ধত্বের কারণে অন্যায় ও ন্যায়ের পার্থক্য করতে পারেনি। শিক্ষাঙ্গনের পবিত্র আলোর সিংহাসনে বসে রাজারূপে প্রতিষ্ঠা করেছে অন্ধকারের রাজত্ব। আর এখানেই উপন্যাসটির নামকরণের সার্থকতা নিহিত।
উপন্যাসটির বিষয় আলোচনায় বলতেই হয়, এতে একদিকে সমাজের পূজনীয় ব্যক্তিদের মুখোশ পরা চেহারা ধরা পড়েছে, অন্যদিকে শুভ্র প্রেমের নির্মল ছবিও চিত্রিত হয়েছে। প্রেম ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ্য ও কৃষ্ণা চক্রবর্তীর, প্রেম দুটো শুদ্ধ আত্মার। পারস্পরিক চাওয়া-পাওয়াহীন এই স্বপ্নের বুনন উপন্যাসটিকে সুস্থ প্রেমের অলঙ্কার পরিয়েছে, যা ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ্যের মানবীয় চরিত্র হয়ে ওঠার জন্য অনিবার্য ছিল। তবে এখানে কৃষ্ণার নিবেদন বেশি ছিল, যা অনিন্দ্যের প্রতি লেখকের বিশেষ সাবধানতার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে।
শিক্ষিতা রুচিশীল কৃষ্ণা চক্রবর্তী’র রূপে অনিন্দ্য মুগ্ধ ঠিকই তবু প্রতিটি নিবেদন যেন কৃষ্ণাকে ক্ষণিকের হলেও বাঁধহীন প্রেমের জোয়ার করে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অনিন্দ্যের দিকে—‘কাল দুপুরেই তোমাকে আমি হারিয়ে ফেলবো। তবুও মনে হচ্ছে যতক্ষণ আছ, তোমার সাথেই প্রতিটা নিঃশ্বাস থাকি।’
মুগ্ধতা রেশ ও অপ্রাপ্তির শূন্যতা কৃষ্ণাকে পরিচালিত করলেও অনিন্দ্যের কদম এখানেও হিসাব করেই পড়েছে, ভালো লাগার সুন্দর অনুভবের পরেও। অনিন্দ্য যেন কোনো অভাব বা অপরিপূর্ণতার দ্বারা মনের অজান্তেও পীড়িত নয়, যা রক্ত-মাংসে গড়া মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তার সাবধানী আচরণ তাকে এই একটি জায়গায় কিছুটাকৃত্রিম করে তোলে যা পাঠকের মনকে অতৃপ্ত রাখে—‘কৃষ্ণা চক্রবর্তীর বিশেষ আন্তরিকতা তাকে মুগ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু তিনি মুখ ফুটে প্রকাশ করলেন না। যতোটা মানায় ততোটাই করছেন।’
উপন্যাসটির গঠন কাঠামো ও গদ্যরীতি দৃষ্টিআকর্ষক। অলংকারের ব্যবহারে শিল্পী রকিবুল হাসান যে খুব হিসেবী বা সচেতন ছিলেন, তা নয়। যা কিছু উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, চিত্রকল্প উপন্যাসটিতে অত্যন্ত সাবলীলভাবে লেখকের সহজাত রচনার অংশ হিসেবেই এসেছে। প্রায় চার শত পৃষ্ঠার মহাকাব্যিক এই উপন্যাসটি মোট পাঁচটি পর্বে বিভাজিত। প্রতিটি পর্বের নামকরণ করা হয়েছে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত জায়গা থেকে। প্রথম পর্ব চেয়ার ও মধুমক্ষিকাতে মূলত ক্ষমতাবানের ক্ষমতার অপব্যবহার ও সুবিধাভোগী চরিত্র গুলোর নেতিবাচকতার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে যার যথাযথ পতন উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ সাধকের সাজা পর্বে কার্যকারণসূত্রে দেখানো হয়েছে। উপন্যাসের তৃতীয় পর্ব নষ্টরাজের ফাঁদ-এ মূলত ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থিত বিধ্বংসী শক্তিকে সর্বভুক অবস্থায় দেখা গেছে, যেখানে শুভ শক্তি বারবার অশুভ শক্তির দ্বারা প্রবঞ্চনার শিকার হয়েছে। এ পর্বে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আবতারণ ঘটানো হয়েছে এবং কাহিনির প্লটকে নানান দিকে ধাবিত করার মধ্য দিয়ে ইতিহাস ঐতিহ্য ও শিল্প সংস্কৃতির স্বরূপ বিশ্লেষণের প্রয়াস চালানো হয়েছে। চতুর্থ পর্বে অর্থাৎ বিধায়কের বিধান পর্বে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া অঞ্চলভিত্তিক ইতিহ্যের প্রতি প্রজ্ঞার ও জ্ঞানের পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
এখানে লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মশাররফ হোসেন, সৌমিত্র চট্ট্যোপাধ্যায়, আকবর হোসেন প্রমুখের অস্তিত্ব, চিন্তন ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আলোপাত করা হয়েছে। তবে পাঠক মনে অন্যান্য অঞ্চলভিত্তিক লেখকদের জানার একটি চাহিদা তৈরি হয়েছে এখানে। দুই বাংলার পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়া, প্রণয়, সাহিত্যের প্রবহমান ধারাও এসেছে এ পর্বে। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক জটিলতা, শিক্ষকদের অবমাননা, তাদের হয়ে ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদি উপন্যাসের প্লটকে এ পর্বে ক্লাইম্যাক্সের দিকে নিয়ে গেছে। আর উপন্যাসের শেষ পর্ব তবু আলোতে বাঘা যতীন এর আদর্শে পথ চলা ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে নানা অপবাদে স্থানচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করা হয় যা শেষ পর্যন্ত মিথ্যে প্রমাণিত হওয়ার সত্যের জয় হয়। তারপর পরই অনিন্দ্য অর্ঘ্য স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর পথে অনিশ্চিত এক যাত্রায় হাঁটা শুরু করে, শুভ কামনা রাখে শিক্ষার্থীদের জন্য।
উপন্যাসটিতে অলঙ্কারে ব্যবহার হয়েছে সাবলীল অবয়বে। সমাসোক্তির স্নিগ্ধ রূপায়ণ পাওয়া যায় এভাবে:
১। একঅদ্ভুত ভূতুড়ে অন্ধকার চেপে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড়ে (তেইশ নম্বর পরিচ্ছেদ)
রূপকের ব্যবহার উপন্যাসটিতে সবচেয়ে বেশি:
১। এখানে ইঁদুরের অনেক গর্ত-সব গর্তে বিষধর সাপ (ঊনত্রিশ নম্বর পরিচ্ছেদ)
উপমা’র পরিমিত ব্যবহার বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে অনেক জায়গায়:
১। তুমি আমার কাছে একেবারেই শিশির ফোঁটার মতো-খুবই ক্ষণিকের (আটাশ নম্বর পরিচ্ছেদ)
২। এক সময় এমনিই শামুকের মতো নিজের ভেতরে চুপ হয়ে যাবে (চব্বিশ নম্বর পরিচ্ছেদ)
কল্পনা ও বাস্তবের নির্ভুল রূপায়নে কথা সাহিত্যিক রকিবুল হাসানের মুন্সিয়ানার পরিচয় স্পষ্ট। চিত্রকল্প অঙ্কনে তিনি দিয়েছেন সাবলীলতার সহজ পরিচয়:
১। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য স্যুট টাই পরে যখন লবিতে এসে দাঁড়ালেন, তখন সাদা শাড়ি আর লাল ব্লাউজে দেবীমূর্তি হয়ে পুষ্পতোড়া হাতে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণা চক্রবর্তী। (আটাশ নম্বর পরিচ্ছেদ)
ভাষার ব্যবহারে ঔপন্যাসিক রকিবুল হাসান সাবধানতার পরিচয় দিয়েছেন। শহরের উঁচু শিক্ষিত মহলের মুখের ভাষা রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। তবে ঘটনা ও চরিত্রানুগ ভাষা বিরচন করতে গিয়ে তিনি প্রসঙ্গ ক্রমে ইংরেজি শব্দের অধিক ব্যবহার করেছেন। তবে লৌকিক শব্দ ও বাগধারার ব্যবহার উপন্যাসটিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। নাগর, বেশ্যা, বাংলা পাঁচ, ভাগাড়, পচা শামুকে পা কাটা, জিয়েলা, ভেজা বিড়াল, বাড়া ভাতে ছাই, ওঁৎপাতা ইত্যাদির ব্যবহার ছিল নজর কাড়ার মতো। গ্রামীণ প্রবাদ-প্রবচনও প্রসঙ্গ অনুযায়ী এসেছে উপন্যাসটিতে।
১। এ কথা ও কথা
দে লো বু একটু আলাপাতা (পঁচিশ নম্বর পরিচ্ছেদ)২। ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয়না (চব্বিশ নম্বর অনুচ্ছেদ)
বিষয়, জীবনবোধ, আদর্শ ও শিক্ষিত আলোর ঝলকানি উপন্যাসটির আদি-মধ্য- অন্তে সংশপ্তক অবস্থান সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে তখন যখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা আজকের বাজার অর্থনীতির সামনে মূল্যহীনতায় বার বার অবমাননার শিকার হওয়ার পরও উপন্যাসটিতে উচ্চারিত হয়েছে, যেখানে বাংলা বিভাগ থাকে না সে-টি কোনোবিশ্ববিদ্যালয়ই নয়। সময়ের পরে আগ্নিকা আঁধার উপন্যাসটি সময়ের হয়ে কথা বলবে, নীতির হয়ে কথা বলবে সমস্ত দুর্নীতি, শোষণের বিরুদ্ধে।