উপক্রমণিকা
করোনা আক্রান্ত হয়ে মিরপুর সেনানিবাসের নিজ বাসস্থানে সঙ্গ নিরোধ পালন করছিলাম। করোনা পজিটিভ রিপোর্ট প্রাপ্তির আগেই পড়তে নিয়েছিলাম আলভী আহমেদের অনুবাদের হারুকি মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’। পড়তে পড়তে একদিন মুখবইয়ে পোস্ট দেখি; কবি, কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক রকিবুল হাসানের উপন্যাস ‘অগ্নিকা আঁধার’ নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় আলোচনা লিখেছেন কবি, প্রাবন্ধিক ও নাট্যকার লিটন আব্বাস। অই আলোচনা পড়েই আগ্রহী হয়ে উঠি ‘অগ্নিকা আঁধার’ উপন্যাসটি পড়তে। সংগ্রহ করি ‘অগ্নিকা আঁধার’। উপন্যাস আমাকে কাহিনি, আঙ্গিক ও চরিত্রের গভীরে টেনে নিয়ে যায় প্রবাহমান নদীর স্রোতের মতোই।
কাহিনি সংক্ষেপ ও আখ্যানভাগ
উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায়, বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের চিফ কো-অর্ডিনেটর আব্দুল করিম হুট করেই বাংলা বিভাগের সুন্দরী চেয়ারম্যান ড. ফারজানার সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলছেন। ফারজানা কিছুতেই বুঝতে পারে না হঠাৎ করে সিসি স্যারের হল কী? এতটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরে এই আচরণ! না কি সবকিছু পেয়ে তার সমস্ত আগ্রহ মিইয়ে গেছে!
এর আগে আব্দুল করিম অনিন্দ্যর পেছনে লেগেছিল এলিনা রহমানকে ক্লাস দেওয়ার জন্য আর এখন জামাল খান প্রতিনিয়ত অনিন্দ্যকে ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করছে কারণ তিনি তার পছন্দের প্রার্থী সেলিনা খাতুনকে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করতে চান।
ফারজানা বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান। কিন্তু বিভাগের কাজ করার তার একেবারেই সময় নেই। কারণ ভিসি শাহেদ জাহানের কাছে বিশেষ দাবি মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েই তার বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের চাকরিটা হয়েছে। আর চাকরি রক্ষা করার জন্য দরকার চিফ কো-অর্ডিনেটর আব্দুল করিমের বিশেষ দৃষ্টি। চাকরি পাওয়া আর চাকরি রক্ষা করা এই দুই প্রয়োজনে ফারজানা ভিসি আর সিসির বাহুলগ্ন হয়ে প্রেমের অভিনয় চালিয়ে যায় দিনের পর দিন। ভিসি আর সিসি একে অন্যের অনুপস্থিতিতে অবগাহন করে ফারজানার দেহজ নদীতে। এভাবেই ফারজানা বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে।
সিসি তাকে অফিসে আটকে রাখতে চায় সারাদিন আর ভিসি তাকে নিয়ে প্রায়শই অভিসারে যায় হোটেল ব্লুমুনে। ফারজানা অন্ধকারে যখন নিজের সঙ্গে বসে তখন মাঝে মাঝেই তার নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। সে ভাবে, সবাই আমাকে জানে আমি পিএইচডি ডিগ্রিধারী একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান। কত সম্মান করে মানুষ আমাকে! আসলে তো আমি একজন পতিতার চেয়েও খারাপ!
ফারজানার ইচ্ছে হয় নিজের শরীরকে নিজের থেকে খুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে। হয়তো নষ্ট পুরুষগুলো অই ডাস্টবিনেই নেমে যাবে! কিন্তু বিবেক ক্ষমতার লোভ আর চাকরির অনিশ্চয়তার কাছে হেরে যায় বারবার।
ফারজানা ভাবতে থাকে ভিসি আর সিসিকে তার শরীরী উষ্ণতার উত্তাপে বেঁধে রেখে চাকরি চালিয়ে যাবে নিশ্চিন্তে। বেশ চলছিল ফারজানার দিন। নষ্ট নদীতে ফারজানা ডুবেছিল আকণ্ঠ। প্রজাপতির ডানার মতো ছড়াচ্ছিল নষ্ট যৌবনের চোখ ধাঁধানো রঙ।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে যায় যখন সিসি আব্দুল করিমের কাছে বাংলা বিভাগের ক্লাস চাইতে আসে তার দুবছরের সিনিয়র মেজর আকিজ রহমানের স্ত্রী এলিনা রহমান। শুরুতেই এলিনা রহমানের রূপে মুগ্ধ হয়ে যায় আব্দুল করিম। এলিনাকে দেখে আব্দুল করিম ভাবে, এত সুন্দর কোনো নারী হয়! বিধাতা তাকে একদম নিজ হাতে বানিয়েছে। আব্দুল করিম ফারজানাকে বলে, বাংলা বিভাগে তাকে ক্লাস দিতে। কিন্তু ফারজানা গ্রাজুয়েশন ডিসিপ্লিন ঠিক নেই এই অযুহাতে এলিনাকে ক্লাস দিতে চায় না। এই না চাওয়ার ওজর আপত্তি ফারজানা ভিসি শাহেদ জাহানকেও জানায়। শাহেদ জাহান বলে, সে ব্যাপারটা দেখবে।
এলিনা রহমানকে ইংরেজি বিভাগে জিডি কোর্স দেওয়া হয়। কিন্তু এলিনা রহমানের চূড়ান্ত লক্ষ্য বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হওয়া। ঘটনা প্রবাহে দেখা যায় একদিন খুব সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ফারজানা সিসি আব্দুল করিমকে বলে, স্যার একটু বাইরে চলেন। আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। সিসি গিয়ে দেখে ফারজানা লাল রঙের প্রিমিও গাড়ি কিনে নিয়ে এসেছে। আর তখনই সিসিকে উপহার দেয় ষাট হাজার টাকা দামের ঘড়ি। আবার সিসিকে চমকে দিতে চকিতে চুমু দেয় সিসির ঠোঁটে।
ফারজানা মনে মনে নিশ্চিত হয় যাক সিসি স্যার ম্যানেজ। কিন্তু রয়ে গেছে আরেক প্রণয় পাখি ভিসি শাহেদ জাহান। ইদানীং ফারজানাকে এড়িয়ে চলছে। ফারজানা গিয়ে ধরনা দেয় শাহেদ জাহানের রুমে। শাহেদ জাহান তখন ফারজানার কথাই ভাবছিল। সিসির সঙ্গে ফারজানাকে জড়িয়ে বিভিন্ন কথা আসছে ভিসির কানে। ভিসি ভাবে ফারজানার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। ফারজানা প্রবেশ করতেই ভিসি বলে, ফারজানা তোমার কথাই ভাবছিলাম। ফারজানা উত্তর দেয়, আমি ছাড়া আর কার কথা ভাববেন? আর কে আছে? ভিসি বলে ফারজানা তুমি সিসির রুমে বেশি যাবে না। লোকটা নারীখেকো। ফারজানা বলে, না স্যার অফিসের প্রয়োজন ছাড়া যাই না। ফারজানা আহ্লাদিত হয়ে বলে, স্যার কতদিন ব্লুমুন যাই না! ভিসি বলে, কারা যেন কম্পলেইন করেছে বোর্ড অব ট্রাস্টির কাছে আমি ওখানে নারী নিয়ে যাই। আজ বিকেলে তৈরি থেকো অন্য হোটেলে যাবো। সেদিন সিসি ফারজানার সঙ্গে ডিনারের অফার দিলে ফারজানা জানায় তার বাচ্চা অসুস্থ। সেদিন ভিসির সাথে শরীরী আনন্দ যাপন করে ফারজানা বাসায় ফেরে রাত বারোটায়।
পরেরদিন সকাল এগারোটায় ঘুম থেকে উঠে দেখে সিসি আব্দুল করিম এগারো বার ফোন দিয়েছে ফারজানার মোবাইলে। ফারজানা তড়িঘড়ি করে কল ব্যাক করে আব্দুল করিমকে। আব্দুল করিম হাসতে হাসতে বলে আপনি ঘুমাচ্ছেন? আপনার ভিসি তো নাই! মেয়ে মানুষ নিয়ে হোটেলে গিয়ে নষ্টামি করে, সেমিনারের নাম করেও মেয়ে মানুষ নিয়ে বিদেশে যায়!
আমি এসব বিওটিকে জানিয়েছি। বিওটি ব্যবস্থা নিয়েছে! ফারজানা ভাবে, ভিসি স্যারের নামে অভিযোগ গেছে তাহলে আমার নামে যায়নি! এই চাকরির জন্য বেশ্যাবৃত্তি করলাম, সেই চাকরিই তো শেষ হয়ে যাবে! দ্রুত আসে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসে সিসির সঙ্গে দেখা করে। সিসি বলে ভালোভাবে কাজ করুন। শিগগিরই নতুন ভিসি আসবে। আব্দুল করিম এভাবেই বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলকাঠি নাড়ে বিওটি (বোর্ড অব ট্রাস্টি)-কে বিভিন্ন সত্য-অর্ধসত্য-মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়ে। এর আগের ভিসিকেও আব্দুল করিম এভাবেই হঠাৎ করে বিদায় করে দিয়েছে।
দুই মাসের ভেতর ভিসি হিসেবে যোগদান করে ড. সাদিক আহসান। সাদিক আহসান নীতি, আদর্শ ও নিষ্ঠা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরেন। তিনি এসেই ডিন এবং বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে মিটিং করে বলেন, প্রত্যেক বিভাগকে গবেষণা করতে হবে, পিআর রিভিউ জার্নাল বের করতে হবে, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, নিয়মিত রুটিন অনুযায়ী ক্লাস নিতে হবে। অনেক শিক্ষক খুশি হয়ে যায় কিন্তু প্রোভিসি নাজমুল সৈকত বিরক্ত হয়। আব্দুল করিম আগের মতো একচ্ছত্র আধিপত্য খাটাতে পারে না। এলিনা রহমান আব্দুল করিমের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান পদের জন্য। ফারজানাকে সাদিক আহসান অনেকগুলো কাজ দিয়েছিলেন। ফারজানা কোনো কাজই এগুতে পারে না। আর আব্দুল করিম ফারজানাকে আর চিনতেই পারে না। এর ভেতরেই ঘটে এক বিদঘুটে ঘটনা। বিজনেস অনুষদের ডিন গোলাম রসুলের সঙ্গে সহকারী অধ্যাপককে তৌহিদা আমিনকে জড়িয়ে আব্দুল করিম চাকরিচ্যুত করে দুজনকেই। ভিসি সাদিক আহসান খুব অবাক হয় এভাবে ভিসিকে না জানিয়ে কিভাবে একজন ডিন ও ফ্যাকাল্টির চাকরি চলে যায়! তিনি বিওটির চেয়ারম্যান চৌধুরীকে ফোন করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান। তৌফিক চৌধুরী ভিসির এই দাবীর প্রশংসা করেন। তদন্তে বেরিয়ে আসে গোলাম রসুল ও তৌহিদা আমিন দুজনেই নির্দোষ। এবার চাকরি চলে যায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিসি আব্দুল করিমের।
তৌফিক চৌধুরী বিওটির মেম্বার জামাল খানকে। সাদিক আহসান ভাবে, ভিসির ওপরে এরকম একজন ডিগ্রি পাস প্রতিনিধি বসে থাকলে কিভাবে কাজ করা সম্ভব! সাদিক আহসান নিজের সাথেই কথা বলে, আমি তো এখানে চাকরি করতে আসিনি। এটা আমার চ্যালেঞ্জ। সবাইকে নিয়ে কাজ করে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম দুই-তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সারিতে দেখতে চেয়েছিলাম। তা কি আদৌ সম্ভব!
ফারজানার ব্যর্থতার পর বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেছে অনিন্দ্য অর্ঘ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সবচেয়ে অবহেলিত বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয় বারবার বাংলা বন্ধ করে দিতে চায়। অনিন্দ্য জয়েন করেই কঠিন পরিশ্রম, সততা আর মেধা দিয়ে বিভাগের অবস্থা পালটে দিতে থাকে। তাতে প্রোগ্রাম অফিসার ফারিয়ার মতো অসৎ চাকুরেদের খুব সমস্যা হয়ে যায়।অনিন্দ্য নিয়মিত ফ্যাকাল্টিদের মিটিং করে, ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকদেরকে মোটিভেট করে। বিভাগে আয়োজন করে সেমিনার। সেমিনারে উপস্থিত হয় সব বিখ্যাত কবি লেখকরা। এর আগে আব্দুল করিম অনিন্দ্যর পেছনে লেগেছিল এলিনা রহমানকে ক্লাস দেওয়ার জন্য আর এখন জামাল খান প্রতিনিয়ত অনিন্দ্যকে ফাঁদে ফেলতে চেষ্টা করছে কারণ তিনি তার পছন্দের প্রার্থী সেলিনা খাতুনকে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করতে চান। এই পঁচাত্তর বছর বয়সের বুড়ো শরীরকে সেলিনা খাতুনই উত্তাপ দেন। সেই অনার্স থেকে শরীর বিলিয়ে সেলিনা খাতুন পি.এইচ.ডি অব্দি এসেছেন। যদিও থিসিস তার স্বামীই লিখে দিয়েছেন।
জামাল খান ল’ বিভাগেরকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় যে, অনিন্দ্য সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। রেজিস্ট্রার অফিস থেকে অনিন্দ্যকে প্রমোশন ও ইনিক্রিমেন্ট দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় একটা ওয়ার্নিং লেটার।
সাদিক আহসান কঠোর পরিশ্রম আর সাধনায় বিশ্ববিদ্যালয়কে একটা অবস্থনে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু জামাল আহমেদের বিশৃঙ্খলায় তা চুরচুর করে ভেঙে যায়। যখন তখন ভিসি ও অন্যান্য সবাইকে ডেকে পাঠায়। সুন্দরী মেয়েদের অযথা অফিসে এনে বসিয়ে রাখে। সব বিভাগের সবার প্রমোশন দিলেও বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অনিন্দ্য ও অন্য ফ্যাকাল্টিদের প্রমোশন আটকে রাখেন। আবার ফ্যাকাল্টি ও অফিসারদের যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে বলেন। জামাল খান বলেন সব বিভাগকে কলেজ ভিজিট করতে হবে। ভিসি এর তীব্র বিরোধিতা করেন।
কলেজ ভিজিট করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান-মর্যাদা ধুলোয় মিশে যাবে। শিক্ষার মান বাড়ালে এমনিই ছাত্র ভর্তি হবে। ভিসির অভিমত উপেক্ষা করে জামাল খান ব্যবস্থা করেন কলেজ ভিজিটের। তাতে প্রধান করা হয় অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে।
বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ ভিজিট টিম কুষ্টিয়ায় যায় করলে ভিজিট করতে। কুষ্টিয়া গিয়ে অই টিম এক অনিন্দ্যকে খুঁজে পায়। সবাই অনিন্দ্যকে খুব সম্মান করে। অনিন্দ্যর আছে পারিবারিক ব্যবসা। চাকরিটা সে বাংলা ভাষা আর সাহিত্য-সংস্কৃতিকে ভালোবেসেই করে। টাকার প্রয়োজনে করে না। অনিন্দ্য যখন কলেজ ভিজিটে তখন সেলিনা খাতুন ও আইভি আইরিন নামে দুজন ফ্যাকাল্টিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। যারা এর আগে দুইবার লিখিত পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এই ঘটনার পর সাদিক আহসান ভিসির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি অনিন্দ্যকে ফোন করে বলে যান, তিনি দেশকে ভালোবেসে বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি অস্ট্রেলিয়া চলে যাবেন সেখানে তার ওয়াইফ সেটেল্ড।
কলেজ ভিজিট থেকে ফিরলে অনিন্দ্যর নামে টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু দুই দুটি তদন্ত করেও অনিন্দ্যর নামে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয় না। অনিন্দ্য বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করে। সাহিত্য পুরস্কারের সব কাজ করে অনিন্দ্য কিন্তু জামাল খানের কাছে মিথ্যা কৃতিত্ব নেয় সেলিনা খাতুন। পুরস্কার প্রদানের দিন কিছুতেই অনিন্দ্যকে স্টেজে উঠতে দেয় না জামাল খান। সাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে জামিল জামান বক্তৃতায় বলেন, অনিন্দ্য কোথায়? ওকে দেখছি না পুরস্কার প্রদানের সব কাজ ও আর আমি একসঙ্গে করেছি। ও স্টেজে নেই কেন? আনন্দে অনিন্দ্য কেঁদে ফেলে।
সাদিক আহসান চলে যাবার পর প্রোভিসি নাজমুল সৈকত নিয়ে আসে প্রফেসর জাফর হায়দারকে। কিছুদিন পর জাফর হায়দারই নাজমুল সৈকতকে। অনিন্দ্যকে কোনোভাবেই ফাঁসাতে না পেরে বাংলা বিভাগের প্রোগ্রাম অফিসার ফারিয়াকে দিয়ে ফাসাতে চায় জামাল খান। এই ফারিয়া অনিন্দ্যর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক এমন কোনো চেষ্টা নেই যা করেনি। কিন্তু ফারিয়া বলে না স্যার খুব ভালো মানুষ। কিন্তু ফারিয়া একদিন আইভী আর সিসি সালেহউদ্দীনকে বাংলা বিভাগে দেখে ফেলে। তখন থেকে আইভী সিসিকে কড়া কথা শুনিয়ে বলে যদি সম্পর্কের মধু খেতে হয় তাহলে ফারিয়া আর অনিন্দ্য দুজনকেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাড়াতে হবে। সালেহউদ্দীন জানে জামাল খান সেলিনা খাতুনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিতে চায়। সালেহউদ্দীন জামাল খানের কান ভারী করতে থাকে অনিন্দ্য আর ফারিয়ার বিরুদ্ধে। জামাল খান ফারিয়াকে চাকরি চলে যাবার নোটিশ দেয়। সালেহউদ্দীন ফারিয়াকে বলে অনিন্দ্য তার বিরুদ্ধে জামাল খানের কাছে নালিশ করেছে। ফারিয়া তার পদত্যাগপত্রে অনিন্দ্যর বিরুদ্ধে এক সমুদ্র মিথ্যে নোংরা অভিযোগ করে যায়।
আবার তদন্ত বোর্ড করে জামাল খান। কিন্তু এবারেও কিছুই প্রমাণ হয় না কোনো অপরাধ। জামাল খান ল’ বিভাগেরকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় যে, অনিন্দ্য সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। রেজিস্ট্রার অফিস থেকে অনিন্দ্যকে প্রমোশন ও ইনিক্রিমেন্ট দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সঙ্গে দেওয়া হয় একটা ওয়ার্নিং লেটার।
বাংলা সাহিত্যের সব অতীত-বর্তমান লেখকদের তিনি সম্মান জানিয়েছেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তিনি অনেক উঁচু আসনে স্থান দিয়েছেন।
যে জাফর হায়দার অনিন্দ্যকে প্রশংসা আর স্নেহে ভাসিয়ে দেয় মুখোমুখি সেই জাফর হায়দারই অনিন্দ্যর ফাইল আটকে রাখে তিনমাস। তিন মাস পর অনিন্দ্য বিভাগের সবার সঙ্গে চা খেয়ে, অর্কিড উপহার দিয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।
চরিত্র চিত্রায়ণ
মানবসমাজের সৃষ্টি লগ্ন থেকেই আধো-অন্ধকারের দ্বন্দ্ব চিরন্তন। সমাজে ভালো মনের মানুষ যেমন আছে তেমনি খারাপ চিন্তা আর হীনন্মন্য মানুষও আছে। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে আলো, অন্ধকার ও আলোরূপী অন্ধকারকে এঁকেছেন। শাহেদ জাহান, আব্দুল করিম, জামাল খানযেমন নারীলিপ্সুক দুজন মানুষ। বিভিন্ন নারী শরীর ভোগ করাই তাদের আনন্দ।
একেবারে অন্ধকারের সাক্ষাৎ রূপ। তেমনি ভিসি সাদিক আহসান এবং অনিন্দ্য অর্ঘ্য শত প্রলোভনকে উপেক্ষা করে সততা, নিষ্ঠা এবং ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সবাইকে নিয়ে কাজ করে এগিয়ে নিতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা বিভাগ। এরাই প্রকৃত আলো। এদের আলোয় আলোকিত হয় সমাজ দেশ এবং প্রজন্ম। আবার কিছু মানুষ আলোর সঙ্গে, ভালোর সঙ্গে আছেন এমন রূপ ধরলেও তারা মূলত অন্ধকারের সহচর। যেমন জাফর হায়দার সামনাসামনি অনিন্দ্যর প্রশংসা করলেও মনে মনে অপেক্ষা করেছে অনিন্দ্যর চাকরি চলে গেলেই তার প্রার্থীকে নিয়োগ দেবেন। একেবারে যেন খন্দকার মোশতাক! আবার ফারজানা, সেলিনা খাতুন ও আইভী এরা যেমন যোগ্যতা অর্জন না করে দেহ বিক্রি করেই ক্যারিয়ার টিকিয়ে রাখতে চায় তেমনি তার বিপরীতে আছে নদী নাহিদ, নাবিলা হায়দার যারা যোগ্যতা দিয়েই টিকে থাকতে চায়।
যে কারণে অগ্নিকা আঁধার সফল উপন্যাস
কবি বা লেখককে হয়ে উঠতে হয় মহাকালের কণ্ঠস্বর। চারিদিকে যেন অন্ধকারের হোলিখেলা চলছে। ‘অগ্নিকা আঁধার’ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। দেখিয়ে দেয় নষ্টদের ক্ষমতার আস্ফালন।
এই উপন্যাসের আখ্যান ভাগে আছে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জব পলিটিক্স। লেখক বিপ্লবী বাঘা যতীনকে সম্মান জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করেছেন বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়। এই উপন্যাসে তিনি বিশদভাবে দেখিয়েছেন নজরুল সাহিত্যে বাঘা যতীনের প্রভাব, রবীন্দ্র সাহিত্যের সঙ্গে লালন আর গগন হরকরারর নিবিড় যোগাযোগ। বাংলা সাহিত্যের সব অতীত-বর্তমান লেখকদের তিনি সম্মান জানিয়েছেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে তিনি অনেক উঁচু আসনে স্থান দিয়েছেন। এসব বিষয় গভীরভাবে পর্যালোচনা করে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, ‘অগ্নিকা আঁধার’ একটি সফল উপন্যাস।
উপসংহার
পরিশেষে বলতে চাই ৩৮৩ পৃষ্ঠার উপন্যাসের আলোচনা এত স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। আপনিও পড়ুন চমৎকার এই উপন্যাসটি। আবিষ্কার করুন বিস্ময়কর এক আখ্যানভাগ।
অগ্নিকা আঁধার
লেখক: রকিবুল হাসান
প্রকাশক: বটেশ্বর বর্নন
প্রচ্ছদ: এ.কে. এম খালেকুজ্জামান
মূল্য: ৭২০ টাকা