নারান্দির নূরী পাগলি
নারান্দির নূরী পাগলি রাতদিন চষে ফেরে সমস্ত শহর,
পথের সম্রাজ্ঞী যেন, বহুকাল পথই তার ঘর।
সে এখন বৃন্তচ্যুত পাপড়ি-ছেঁড়া অবিন্যস্ত ফুল:
পাথুরে ভাস্কর্যে কারা পরিয়েছে ছিঁড়া-তেনা, এলোমেলো চুল।
ক্লেদে ও চন্দনে মাখা পুরুষ্ট উরুতে, অবারিত পিঠে
নিশ্চিত দোররার ঘায়ে চিত্রাঙ্কিত বাদামী কালশিটে।
একদা রমণী ছিলো, হয়তো ছিলো স্বামী ও সন্তান,
‘ভাবী’ ডেকে তৃপ্তি পেতো মুদি ও বেপারী থেকে পাড়ার মস্তান;
অথবা হয়নি বিয়ে, ছিলো কোনো বা-বাবার উছল কুমারী,
নয়তো সে অন্ধকারে বেড়ে-ওঠা অন্য কোনো নারী।
কী হবে এসব জেনে, এখন অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি মিছে—
প্রায়ই দেখি শূন্যমুঠো আগলে রেখে নিতম্বের পিছে
কী এক সম্পদ যেন লুকোতে লুকোতে বলে “দিমু না দিমু না!
চা’য়া কী দেহস বেডা, দোজহের লাকড়ি আমি, দেহা বড় গুণাহ!
তোগোর মতলব জানি: হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ হিঃ হিঃ. . .
আচ্ছা তবে ক’ তো দেহি এই হাতে কী?
কখনো উৎসুক হয়ে কেউ যদি বলে দেখি কী এমন ধন!
হাত খুলে নূরী বলে:
ক্যান্ তোর চক্ষু নাই? এই দ্যাখ, আমার যৈবন. . .
গুমট হাওয়ায় বর্ষামঙ্গল
উষ্ণায়নে দ্বিধান্বিত বাতাসে জলকণা,
কখন কবে বৃষ্টি হবে জানে না কোনো খনা।
আকাশ তবু গুমরামুখো–বসন ছেঁড়া-ছেঁড়া,
অচল মেঘে পত্র লেখে বিরহী যক্ষেরা।
রামগিরিতে ব্যাকুল হিয়া অলকা নয় জ্ঞাত;
গোপন কোনো বৃষ্টিপাতে কুবেরেরাই স্নাত।
যক্ষবধূ ভালোই আছে, মরে না আক্ষেপে
(হয়তো ভাবে নির্বাসিত মিনসে গেছে ক্ষেপে!)
সে-কোন কালে বৃষ্টি ছিলো, জলের নামও বারি,
নীবিবন্ধ ভিজিয়ে-নামা নিঙাড়ি নীল শাড়ি
তেমন কোনো বধূয়া নেই দাঁড়িয়ে আঙিনায়–
কেউ জানে না এমন দিনে কারে কী বলা যায়!
যা তুই ফিরে যা পাখি
আমার ডাকনাম ধরে ডেকে ওঠে সুদূরের পাখি
অমর্ত্য যমজ ভগ্নি সে আমার কালো সহোদরা
জন্মলগ্নে এই হাতে বেঁধে দিয়ে রাখী
অচেনা সুদূর কোন্ মায়ালোকে উড়ে গেছে অনঙ্গ অধরা।
আমি একা বেড়ে উঠি রূপে-রসে মত্ত যুবরাজ
পেরিয়ে মায়ের স্নেহ, লালচক্ষু পিতার শাসন
স্বরচিত সংবিধানে গড়ে নিয়ে রঙিন স্বরাজ
একে একে জয় করি যৌবনের গন্ধে-ভরা দারুচিনি বন।
খেয়েছি নারীর মধু, এর চেয়ে বেশি তার ছলনার বিষ;
মধ্যবিত্ত মনে গেঁথে স্বামীত্বের বিপুল ব্যর্থতা
সুখের বিবর্ণ মুখে সাধ্যমতো মেরেছি পালিশ,
দুঃখকে নিয়েছি মেনে অনিবার্য রূঢ় বাস্তবতা।
এর মানে বলতেই হয় সুখে-দুখে জীবন সুন্দর:
কুষ্ঠরোগী হেসে ওঠে মিষ্টি কোনো স্মৃতির জোছনায়,
নুলো ও ঠুঁটোর নারী সন্ততিতে ভরে তোলে পল্লবের ঘর;
কামরুলের কিষানীরা বিলি কাটে চুলের বন্যায়।
যা তুই ফিরে যা পাখি, কালো পাখি, এখন যাবো না—
আগে তো দু’হাত ভরে জীবনের লুটে নিই সোনা!
প্রত্নরমণী
তোমাকে দেখেনি মধ্যযুগের নিপুণ পটুয়া,
অজন্তা কিবা ইলোরার ভাস্কর—
তাহলে দেখতে শত ক্যানভাসে,
ব্রোঞ্জে-পিতলে কষ্টিপাথরে,
টেরাকোটা-কাঠ-সোনার পুতুলে
তুমি সাজিয়েছো পুরাকীর্তির সবগুলো যাদুঘর!
কৃষ্ণের পাশে যে আছে দাঁড়িয়ে
যৌবনবতী পাথুরে-স্তনের নারী
লজ্জায় ভেঙে খান-খান হবে
তুমি যদি শুধু একটু সাহসে
জোড়ামূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে
খুলে ফেলো এই শাড়ি!
তোমাকে মানাতো প্রত্নবেদীতে পঞ্চালিকায়
গোপীচন্দনে তিলক পরালে বৈষ্ণব কবি,
কোলাহলময় বিশ-শতকের শেষপাদে কেন এলে?
নষ্ট কালের ভ্রষ্ট প্রেমিক
কী দিয়ে তোমার বন্দনা করি?
নারী-কীর্তনে ব্যবহৃত সব উপমা দিয়েছি ফেলে!
তোমাকে দেখেনি চিতোরের রাজা,
রূপের পূজারী রসিক রত্নসেন—
তাহলে দেখতে নিদারুণ ক্ষোভে
মিথ্যুক সেই হীরামন পাখি,
এমনকি প্রিয় পদ্মাবতীকে এক-শূলে চড়াতেন!
নর্তকী নও, তোমার চলার পথ জুড়ে তবু
প্রবাহিত তুমি নৃত্যের নানা মুদ্রায়:
দ্যভিঞ্চি আর হেনরী’র নারী
আমাদের প্রিয় রাজহংসীরা
তোমাকে দেখেই গ্রীবাভঙ্গির অসঙ্গতিকে শোধরায়।
তুমি চলে গেলে ঘর জুড়ে হাঁটে তোমার প্রতিমা,
সারা বাড়ি হয় পরাবাস্তব কোনারক ও খাজুরাহো:
সাজের টেবিলে-বিছানা-বালিশে,
ফাঁকা করিডোরে-বিরান হেঁসেলে
থেকে থেকে জ্বলে ‘তুমি নেই’ এই সত্যের দাবদাহ।
সুন্দরালি’র যৌথ অবচেতন
পউষের ঘাসে পরীর পেসাব!
বাতাস ধরেছে বরফের ভাব,
ফাটা পায়ে হেঁটে হাল নিয়ে যায় ক্ষিপ্ত সুন্দরালি―
বিগত রাতের ব্যর্থতা ভাবে:
কী যেন কীসব দেখেছিলো খা’বে,
পাঁচন উঁচিয়ে বিড়বিড় করে গাইটাকে দেয় গালি:
বাঁয়ে ক’লে দেহি ডানমুহি যাস,
মইত্যার মা’র দেমাগ দেহাস,
হেট হেট হট, সিধা অ’য়া চল্, ফাডায়া ফালামু বেডি;
মেয়া-মানুষের মন বোঝা ভার
দরদ বোঝে না দিল-কলিজার
পরান দিলেও ফুঁস মারে য্যানো মনুমোড়লের জেডি!
হায়রে কপাল! দোষ ধরি কার,
একবেলা ভাত, দুই বেলা মাড়,
মইত্যার পেডে যাই কিছু ঢোহে কিরমিরা খা’য়া ফ্যালে―
জমিনে ঢোহে না লাঙলের ফাল
মাডি য্যানো দেও-দানবের ছাল
বানে-ডোবা জমি তা-ও ভাসি’ ওডে মরশুম চলি’ গ্যালে।
একাত্তরের যুদ্ধ করিছি
দেশের জন্যি অস্ত্র ধরিছি
কান ভরি’ হুনি হগলে আমারে মুক্তিযোদ্ধা ডাহে!
যত চিল্লাই ‘চেতনা চেতনা’
নেতায়া পড়িছে গোখরোর ফণা―
চেতনা খা’য়া কি কারো কোনোদিন পেড ভরে কও বাহে?
শনাক্ত-চিহ্ন
পরিচয়পত্রে কোনো শনাক্ত-চিহ্নের কথা কখনো লিখি না
বস্তুতই হাজার মুখের ভিড়ে আমাকে আলাদা করে চেনা যায় কি না
এখনও নিশ্চিত নই:
শ্রীপুরের বড় মীর্জা, রঘুবাবু, দীপালি বাড়ই
থেকে কী অর্থে ভিন্ন আমি বলেনি তা’ কেউ
অনাদি মানবস্রোতে বহমান অন্যতম ঢেউ
মিশে আছি জীবনের ফেনা ও কল্লোলে;
বুঝি না অন্ধের মতো কোন্ লগ্নে জন্ম কার কোলে।
মাঝেমাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি: তুই কোনদেশী,
কোন্ গাঁয়ে বাড়ি তোর, কে কে প্রতিবেশী ?
কোন্ বংশে জন্মেছিলি–মিয়া, মীর্জা, খন্দকার, জেলে?
গীতা না বাইবেল নাকি কোরান শরীফ ছিলো মায়ের রেহেলে?
আছিস অজ্ঞাতবাসে নাকি খুব দোর্দণ্ড প্রতাপে?
সাহিত্যবেত্তারা তোকে মাপে কোন্ দশকের মাপে?
কে যেন ভেতর থেকে ব’লে ওঠে: জ্বী না,
আমি শুধু জন্ম বুঝি প্রজন্ম বুঝি না।
বিশাল সমুদ্র জুড়ে ওঠে-পড়ে ক্লান্তিহীন ঢেউ
কোনোটা সনাক্ত ক’রে বলেছে কি কেউ:
“অই যে, অইটা দেখো, দৈর্ঘ্যপ্রেস্থে বেশ!”
কে-ঢেউ অমান্য ক’রে অনিবার্য বায়ুর আদেশ
বলেছে “অনন্য হবো, আমার ভেতরে চাই আরো বেশি জল?”
মূলতই ঢেউ মানে সমান জলের স্ফীতি, অভিন্ন কলকল,
খোঁজে একই তট,
অবশেষে মাথাকুটে বিরস বালুতে লুপ্ত হয় গতির দাপট।
জীবনের উপমাও অনন্ত সৈকতমুখী তরঙ্গ সফেন:
খণ্ড–খণ্ড একা তবু কেমন একাত্ম দেখো চুকিয়ে লেনদেন
সারিবন্দী শুয়ে আছে পাপী ও পরহেজগার, জমিদার, প্রজা,
দাদী-নাত্নী, খালা-খালূ, পিতা ও আত্মজা,
কামেল পীরের সাথে নগরীর ধড়িবাজ ঠক
এবং তাদের পাশে কোনোদিন আমি হবো আরেক ফলক।
ভ্রমণ-বৃত্তান্ত
ছেঁড়া কাগজের টুকরোর মতো
উড়ছি তুমুল ঝড়ো-বাতাসের তোড়ে
পরিণামহীন ভ্রান্তবিহারে
কাল-কবলিত ভুল-পবনের নাও;
পার থেকে দূরে ছিটকে পড়েছি প্রলয়তাড়িত তবু
নিমজ্জমান জাহাজের জেদী নাবিকের মতো আমি
কম্পাস হাতে ঝুলে আছি মাস্তুলে।
পুরাণকথিত শ্বাপদের ক্রোধে
হিংস্র কালের বিদঘুটে কালো থাবা
মটকে দিয়েছে স্বপ্নের ঘাড়
তবুও দিব্যি আশ্বাসে দিন কাটে:
গলাকাটা লাল মোরগের জেদে
রক্ত-স্বপ্ন একাকার করি চূড়ান্ত পাখসাটে।
হরিপদের দিনরাত্রি
তরল হীরের নদী,
সোনারঙ নৌকো দোলে দূরে—
স্বেচ্ছায় লাফিয়ে পড়ে ঝাঁক ঝাঁক রুপালি ইলিশ…
সহসা স্বপ্নের ঘোরে হেসে ওঠে হরিপদ জেলে:
দেখে সে গঞ্জের হাটে আজ বড়ো ক্রেতাদের ভিড়,
নিবিড় ছায়ার মতো মলিনার চোখ মনে পড়ে,
বলে “ও জাইল্লার মেয়ে, আর ক’ডা দিন,
আগামী আশ্বিনে তোরে ঘরে তুলি নিমু….”
অথচ কোথায় ঘর!
স্বপ্নফেরা হরিপদ নিয়তির ঘাটে
ফুটো নৌকো, ছেঁড়া জাল নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কলসতাড়িত জলে নিত্যদিন কেঁপে ওঠে বিমূর্ত মলিনা,
স্নানার্থিনী ধীবরকন্যার গাঢ় সোমত্ত যৌবনে
আগতর লেপ্টে-থাকা লালপেড়ে শাড়ি
কে যেন হৃৎপিণ্ডে তার পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে
ব্যান্ডেজের মতো করে বেঁধে রেখে যায়….