তোমার মৃত্যুর পরে
তুমি মরে গেলে, আর সবাই বলল—সব ঠিকঠাক আছে
যে সব সৈন্য সকালে কুচকাওয়াজে বেরিয়েছিল, তারা
সকলেই ব্যারাকে ফিরেছে, এক মগ গরম চায়ের সঙ্গে
শুকনো রুটি চিবুচ্ছে; দেশ দখলের লড়াই যেহেতু শেষ
সেহেতু তোমার মৃত্যুতেও পতনের আশঙ্কা করছে না।
প্রতিদিনের মতো সূর্য পশ্চিমে হেলে যাচ্ছে, বইছে ঠাণ্ডা
বাতাস, আজ অমাবশ্যা, চাঁদ উঠবে না—প্রকৃতির নিয়ম
অন্দরে মেয়েরা কাঁদছে, পরস্পর খোঁজ-খবর নিচ্ছে, আজ
রান্নার ঝামেলা নেই, এসেছে প্রতিবেশীদের খিচুড়ি ইলিশ
তোমার শবাধারের পাশে আগরের ধোঁয়ার সাথে মৃদু গুঞ্জরণ
দূরের আত্মীয়রা করছে তোমার শব-সমাধির আয়োজন।
সত্যিই কোথাও অনিয়ম নেই; সব কিছু ঠিকঠাক আছে
কার ঠিকঠাক আছে? সূর্য উঠলেই সব ঠিকঠাক থাকে?
এমন ঠিকঠাক থাকার পৃথিবীতে তুমি অনেক দিন ছিলে
কিন্তু আমার তো ঠিকঠাক নেই; এখন আমার সব বেঠিক;
কারো থাকা না থাকা, সূর্যের ওঠা না ওঠা—সব সমান
তোমার মৃন্ময় যাত্রার পথে এখন প্রত্যেকে খুঁজছে অন্তরাল।
বলো, তুমি কিংবা আমি, আমাদের থাকা না হলে—ক্ষোভে
কেউ তো করেনি আমাদের জন্য আহা-উহু, তবু নিস্পৃহ
সন্তের মতো বলতে হবে—জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক!
তুমি অভিমানে গেছ চলে, এখন কে আর মারবে আমাকে
তোমার ভালোবাসার বর্ম যখন ছিন্ন, তখন এখানে নৈরাজ্য
মৃত্যু কিংবা বেঁচে থাকা অহেতুক সংসারীদের অধিকারে।
মা
এখানে আসার পরে ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে যেতে
সম্ভবত আমি হারিয়ে ফেলছি দিনের ক্লিষ্ট স্মৃতি
হয়তো নির্ভরতা, কেউ আমাকে তুলে নেবে কোলে
অনেক দিয়েছি হামাগুড়ি, ছিলাম কাদা ও জলে লেপ্টে
সাঙ্গ খেলাধুলা, খেলার বৌ ও ছেলেপুলে রেখে
আমাকে মায়ের কাছে ফিরে যেতে হবে
মনে হচ্ছে এসে গেছে সময়, মস্তিষ্ক করছে না কাজ
বালিকা বধূদের শরীরের বিভেদ পাচ্ছি না টের
চিহ্নের পার্থক্য থাকলেও ফুরিয়েছে ব্যবহার যোগ্যতা
যারা ভুলিয়ে রেখেছিল সাময়িক আনন্দে, স্পর্শে
তারা কি কেউ দিয়েছিল একবিন্দু তৃষ্ণার জল
যদিও তারা ছিল মায়ের রেপ্লিকা
সন্ধ্যার আগেই তারা আমায় রেখে করেছে গৃহত্যাগ
তাদের রয়েছে নিজস্ব সন্তান, নেই সান্নিধ্যের প্রয়োজন
কেনই বা দিচ্ছি দোষ, তাদেরও আছে ফেরার ভয়
অথচ রেখে যাওয়ার আগে মা কতবার করেছিল বারণ
যদিও অবোধ শুনিনি নিষেধ, তবু জেনে গেছি
কাদা ও পানিতে পিছলে গেলে, এমনকি আগুন ও সমুদ্র
যেখানেই যাই, ঘুমানোর জন্য ফিরতে হবে তার কোলে
এখন পাচ্ছি টের, এখন আমার ঘুমিয়ে পড়ার সময়
ভুলে গেছি নাম, শব্দের মানে, আয়তনের আপেক্ষিকতা
মেয়ে বন্ধুদের স্মৃতি ভুললে এখনো সম্ভব মাতৃদুগ্ধ পান
জানি—মা শরীরে ধরলে হবে না দেহের ক্ষয়।
স্বজন
যে দুঃখগুলোর জন্য আমি দুঃখ করি
অস্পূর্ণ প্রেমের জন্য রয়েছে কান্না
ঈশ্বর আমাকে কিছুই দেননি বলে—
করেছি হা-হতোস্মি
জরা-মৃত্যু-শোক স্ত্রীর মুখঝামটা
বসের নির্দয় আচরণ
অর্থ কষ্টে হয়নি পূরণ সন্তানের ইচ্ছা
বন্ধুদের ঈর্ষার চাবকানিতে হয়েছি ক্ষতাক্ত
পদ ও পদবির পার্থক্য করেছে পরিচয়হীন
তবু ভাবি—এই যে কষ্ট ও তুচ্ছতার সঙ্গে
আমার বসবাস, আমার মিলন
আমাকে ছাড়া কোথায় বা হতো
এইসব তুচ্ছতার আশ্রয়
আমার আদর ও উপেক্ষায়
সেই তো একমাত্র সময় ও সঞ্চয়
এখন মনে হয় বেশ আছি—
যারা নেই তারা আমার নয়
তাদের জন্য কেনই বা থাকবে হাহাকার
যারা আছে তারা আমার আপনার জন
এতদিন তাদের অহেতুক করেছি উপেক্ষা…