১.
আমি তারে রোজ দেখি। বলি, শোন—
নিজেরে করতে পারিস যদি খুন
চমৎকার খুনি হবি তবে।
নইলে তোর নিজের কী হবে
নিজেও ভেবে পাবি না কূল।
কী ভাবিস, এমনি এমনি ফোটে ফুল
মোটা ছাল ভেদ করে গাছের বিশ্রী ঠোঁটে?
আর যদি খুনি ট্যাগ কোনোমতে জোটে
মাথায় পরে নিস রক্তের মুকুট।
বসন্ত কুঞ্জে কুঞ্জে দেবে চিরকুট।
০২.
আমি তারে এও বলি, ভাঙ।
আসলে যেইটা জামাই সেইটাই নাঙ।
হাঁটতে পারিস যদি পথ বেঁকে যাবে,
জালের বাঁকার মতো নিজস্ব স্বভাবে।
এ যে এক মিস্ট্রি খেলা নদী ভালো জানে
শরতের উড়ো মেঘ শতভাগ মানে
মন ভাঙে, ধন ভাঙে কী ভাঙে না বল
চোখের পানির কাছে ঝর্ণাও ছল
খুব করে ভেঙে গেলে লাশও প্রতারক
সারসের নিয়ম মেনে গলা তুলে বক?
০৩.
তারে বলি চলে যা চোখের সীমান্তে
দিনের গর্ভ লুটে দিন আনতে।
আকাশকে শামিয়ানা করে নিতে হলে,
তারাকেও টোকা মেরে ফেলে দিবি হোলে।
চলে যায় বকপক্ষী— চলে যায় ঢেউ—
এ জগতে কবে বল কারো হয় কেউ?
চলে যাওয়া এমন এক দার্শনিক থিম,
কাফেরের কাছেও তা আলিফ লাম মিম।
চলার শব্দ এমন— মৃতরক্তস্রোত
যেন বাপের বীর্য ছেঁড়া আয়ুষ্মান পুত।
০৪.
তারে বলি, খেলে যা। পৃথিবীটা মাঠ।
যে ঠোঁট খায়নি চুমো সে ঠোঁটই কাঠ।
যেই হাতে লেগে থাকে সময়ের রেণু,
যেই চোখ বীণাকেও মনে করে বেণু,
তার কাছে খেলা এক আজব ম্যাজিক।
দ্বীপকে প্রদীপ ভেবে মারো যদি কিক
দেখবে খেলার মজা, সুতানলী সাপ—
মুহূর্তেই হয়ে যাবে আদিতম পাপ।
তখন তোমার তুমি গোটা বিশ্বময়
খেলায় হয় না কভু পৌরুষের ক্ষয়।
০৫.
রোজ রোজ দেখি আর রোজ বলি ওকে,
হে বন্ধু, আছো তো ভালো? সবকিছু ওকে?
তা যদি না হয় তবে সেইখানে যাও—
বুকে ফোটা ফুল চুষে বুক–মধু খাও।
দেহের যেখানে থাকে জন্মের প্রপাত
যেখানে দুধের শুরু, শেষে থাকে ভাত,
যেখানে প্রভাত ভেঙে সূর্য ফোটায় দিন,
যেখানে মৃত্যুর কাছে জন্ম রাখে ঋণ,
যাও যাও বন্ধু যাও সেইখানে যাও
যেখানে জলেই জ্বলে অগ্নি দাউদাউ।
০৬.
বলি তারে, বেঁচে থাকা বিস্ময় এমন—
লোহা পিষে বের করা রসের মতন।
বাঁচাকে করতে হয় মৃত্যু দিয়ে শুরু
অর্জুনের শরে শরে দ্রোণাচার্য গুরু
যে রূপে জন্মান। বাঁচার কৌশল;
শিখতে হলে দেখতে হবে চন্দ্রলোভা জল
জোয়ারের শক্তি থাকে চোখের পাতায়
দৃশ্যও অ–দৃশ্য হয় দৃষ্টির নাচায়
আগুনের জামা পরে বরফের প্রাণ
অনুভব করা মানে— জীবনের গান।
০৭.
বলি, কেন এত দ্বিধা? এত সংশয়?
সাগরের মৃত্যু হলে মরুভূমি হয়।
মানুষের দেহে থাকে নক্ষত্রের ভাগ
পৌষের ফসলে ফলে জরাগ্রস্ত মাঘ
পথের শুরু কি তবে শেষ রেখা নয়?
বলতে পারা পাখি জানে কথার কী ভয়।
তবু কি পাখির কণ্ঠে সুর–বনায়ন
চিরকাল পাখ–পাখি করেনি বয়ন?
দ্বিধা কেন যেই যোনি মুত্রধারা ঢালে
সে যোনিতে শিশু ফুটে ক্যানভাসীয় চালে।
০৮.
তারে বলি শোন তবে, বিচিত্র ভোদাই—
উত্তম ভাস্করই জানে বোধের খোদাই
কী করে করতে হয়। কাঠঠোকরাটা—
কোথা থেকে শিখে এলো এ শৈল্পিক কাটা?
গাছের বল্কলে থাকে সময়ের দাগ।
দুর্দান্ত দুপুরে দেখ, রোদের নিদাঘ—
কেমন স্তব্দতাখানি নৈঃশব্দ্যে বাজায়
কোন সে তরঙ্গ তারে কানের গুহায়
পাঠায় অমন যেন বল্মীক নগরে
বাল্মিকীর রামায়ণ গুঞ্জরণ করে।
০৯.
তারে বলি, শীতাতপ ঘর যদি চাস
বায়ুমণ্ডল কিছু নয় নিশ্বাসই বাতাস।
আলাদীনের জ্বীনের দেহ প্রদীপের
ঘরে, যেভাবে জায়গা নেয়— ভালো করে
চেয়ে দেখ, আমাদের সমস্ত জগৎ
দেহের রক্তের মধ্যে ছুটাইছে রথ।
চেয়ে দেখ, মানুষের ভেতরে মানুষ।
চেয়ে দেখ, অন্তরীক্ষে যত মুদ্রাদোষ
সব আছে নিমজ্জিত নিজের ভেতর।
শালিকেরও কণ্ঠে থাকে মানুষের স্বর।
১০.
বলি রোজ, ওরে প্রিয়, স্থির হোস যদি
তোর কাছে ধরা দেবে অরণ্য ও নদী।
বৃক্ষ তো দৌড়োয় না দাঁড়ানোটা জানে—
খাদ্য এসে লুটে তার শেকড়ে মননে।
জগতের আর যত ছুটছে কেবল,
ক্ষয় হচ্ছে আয়ু আর ক্ষয় হচ্ছে বল।
স্থির হলে নেমে আসে— মেঘলা আকাশ।
মৃত্তিকার মুষ্ঠি চায় মাননীয় লাশ।
স্থিরতা জড়তা নয়— বিরাটের স্তুপ;
সামান্য গন্দকে থাকে ব্যাপ্ত গন্ধধূপ।
১১.
বলি তারে, শোন তবে কালিক বয়ান—
প্রতিটি কুকুর তার গণ্ডীর মস্তান।
প্রত্যেক যন্ত্রের থাকে নিজস্ব নির্যাস।
গঞ্জিকার পাতা দেয় নেশার এস্রাজ।
বিকেলই ক্ষমতা রাখে রাত্রি প্রসবের।
হিরণ্য নগরে উপ্ত বিলুপ্ত রাজ্যের।
কিসের বড়াই তবে কীসের প্রসাদ?
তাসের ঘরেই জন্মে শতায়ু প্রাসাদ।
পাথরের পাখা হলে প্রজাপতি হয়।
নক্ষত্র উড়ার জন্য ডানা শর্ত নয়।
১২.
বলি শোন, জল যদি মাটি হতে চায়,
প্রেমের সৌন্দর্য এনে মেলে দিস গায়।
মহাকাশ মৃত্তিকার তুপ্ত সহবাসে,
ভোরের শিশির কণা মৃদু হাসি হাসে।
উলঙ্গ সুন্দর কত বোঝার ক্ষমতা—
কেবল খুলতে জানে যে, সেই জানে তা।
এরই নাম শিল্পবোধ— সভ্য কিংবা বন্য
অরণ্য নগর তাতে নগর অরণ্য।
মিলনের রসায়নে— জল হয় মাটি।
বেতের বুনন মানে পাটি পরিপাটি।
১৩.
বলি রোজ, এই এক বার আছে, বল
শনি,–রবি–সোম–বুধ–বেস্পতি–মঙ্গল
সমস্তই মিথ্যাবার। জন্মবার ছাড়া।
জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে, কারা?
ঘাসের সবুজে জানি অমরত্ব আছে।
শিশ্নের নৃত্যের মধ্যে কি জীবন নাচে?
তবে কি এ জন্মকাঠি? মৃত্যুকাঠি কই?
গরম বালুর স্পর্শে চাল হয় খৈ।
জন্মবার মৃত্যুবার তাও তবে নাই?
কোথা হতে আসে মনু কোথা চলে যায়?
১৪.
তারে আমি ভালোবাসি। তাই বলি, রোজ—
প্রিয়জন প্রিয় হলে দিও ফুল— রোজ।
নতুবা মায়ের মৃত্যু, পিতার যৌনতা,
নতুবা বাসরঘরে কন্যার মৌনতা,
দাদার দাদির আর প্রপিতামহের
বাৎসায়ন শুনবে সব শীৎকারের।
খনির সোনার শব্দ না শোনা ভালো।
হাতে ছুঁয়ে দেখতে নেই বিদ্যুতের আলো।
বরঞ্চ সেটাই ভালো— প্রিয়জন পেলে
পাঁজরের বাতায়ন পূর্ণ দাও মেলে।
১৫.
তারে বলি, ভালো থাকা— সহজ অসুখ,
সঙ্গমবিহীন তৃপ্ত নয় কোনো মুখ।
নর–নারী–গরু–গাধা–সিংহ বা বাঘ
তৃপ্তরেখা উহ্য থাকা মুখের ভূ–ভাগ
প্রত্যেকের। অসামান্য সামান্য পাথর—
ডুব দিয়ে ভালো থাকে হাজার বছর,
ভালো থাকে গলাকাটা খেজুরের গাছ,
ভালো থাকে না–উল্টানো ক্যালেন্ডারে— মাস,
স্মৃতির সুরভি নিয়ে গত হলে দিন—
মৃত্যুকেও মনে হয়, আহা কী সুদিন!
১৬.
বলি— শুধু মন নয়, পা কী বলে শুনো।
সময়ে সাপের আগে কাঁটাকেও গুণো,
অসময়ে সহ্য করো ছায়ার সন্দেহ,
দেহ ছাড়া মন পাবে মন ছাড়া দেহ,
আজব চিড়িয়া এই মানবজীবন
এখানে খাওয়াও এক যুদ্ধের শীলন।
নিজ চোখে নিজ মৃত্যু দারুণ সুন্দর
এমন দৃশ্যের জন্য উপযুক্ত ঘর
পা যদি কবরে নেয়— আগে চলে যেও,
নিজের কবরে বসে নিজ মাংস খেও।
১৭.
বলি তারে, চলে গেলে বসন্তের রোদ
কাঁঠালে খোঁজো না কভু আমের হলুদ।
যে মেয়েটা দিতে পারে বুকের নরম,
তারো কিছু থেকে যায় খুচরো শরম।
পেনিসের পাপ থাকে— এও সত্য বটে,
পাপের গোড়াতে সদা সত্যদুর্বা জোটে।
বঙ্কিম চন্দ্রের হাসি কেবলই শিশুর?
ক্রুশবিদ্ধ লাশটা কি একলা যিশুর?
কাঁঠাল কাঁটার নিচে রেখেছে উত্তর
যেমন বোবার কণ্ঠে সমুদ্রের ঝড়।
১৮.
বলি তারে, শোন তবে— এও কথা ঠিক,
কথা যদি পান হয় থুথু হচ্ছে পিক।
হাঁপর সে ফোলা গালে ফুঁ দেয় আগুনে।
মৃত আত্মা বদগন্ধ ঢালে দেহবনে।
হাঁটার ভূগোল নয় খাদ্যের ভূগোল।
বৃদ্ধারও যৌবনে থাকে স্তন দু’টি গোল।
ফুলের মতন শক্ত আর কিছু নাই।
মাটির কণার ভেতর আকাশ হারায়।
রোজ তারে বলি আমি সোনালি গন্ধের
এমন রঙিন কথা, কথা যা অন্ধের।