বাঘের চোখে চোখ
তোমাকে দেখলে বাঘের চোখে চোখ রাখার গল্পটা শুনতে ইচ্ছে করে―সবুজ ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে যতবার আকাশের তারার দিকে চেয়ে থাকি―ততবার নিজেকে তোমার সাথেই তুলনা করি আমি―তুমিই তো বলেছ, বাঘের চোখ রাতের অন্ধকারে মিটমিট করে জ্বলে―
গরুটাকে ছেড়ে দিয়ে বুড়ো বটগাছের নিচে এসে ঝিমোই―ভাতঘুম নেমে আসে চোখে―দেখি, বাঘের পিঠে চড়ে আমি চলে যাচ্ছি দূরে―আমাকে একদিন ‘ভীরু’ বলে টিপ্পনী কেটেছিল যে গেঁয়ো প্রেমিকা, তার সামনে দিয়ে চলে যেতে থাকি―ভাবো, কী অদ্ভুত এই নারীদের মন―বাঘের পিঠে চড়তে দেখেও আমাকে আগের মতোই ‘ভীরু’ বলে ফিক করে হেসে ওঠে সে।
সেই হাসিতে ঘুমের জড়তা কাটে―তখনো চুপচাপ ঘাস খেয়ে যাচ্ছে কালো গাই―তার পিঠে বসে আছে লম্বা লেজের ফিঙে―আর সুস্বাদু কিশমিশ ভেবে গরুর পিঠ থেকে খুঁটে খাচ্ছে এঁটুলি―
এবার দেখে নিয়ো, আমিও নির্ভুল শিখে নেব বশীকরণবিদ্যা―রপ্ত করে নেব শ্বাসমূলের ভেতর দিয়ে হাঁটার নিখুঁত পদ্ধতিগুলো―একা-একা এক দিন আর এক রাত কাটিয়ে দেব বাদার জঙ্গলে―
তোমার মতো আমারও বাঘের চোখে চোখ রাখার খুব শখ―
বর্ষা ঋতুতে সুন্দরবন
আকাশে মেঘের খেলা, রিলে করে দেখাচ্ছে নদী―আমি তার তীরে বসা অবাক দর্শক―নদীর ও-পার থেকে পাতার হাত নেড়ে ডাকে সবুজ সুন্দরীরা―মাঝখানে বয়ে যায় শিবসা, বলেশ্বর, রায়মঙ্গলের জল―এই জলে আমাদের ঘামের নুন মিশে আছে―
অনড়, নির্ভুল হয় মেঘের পঞ্জিকা―আমি তবু, সারাটা বছর শুধু বর্ষার প্রতীক্ষায় বসে থাকি―আষাঢ় ঘনিয়ে এলে মেঘের মেয়েরা দল বেঁধে সেচ দিতে আসে বিপুল সুন্দরবনে―মুষল ধারায় যদি গলে পড়ে পুরোটা আকাশ, নোনা নদীগুলো মিঠে হয়ে ওঠে―আমি, আঙুলের ডগায় একফোঁটা জল তুলে নিয়ে জিহ্বায় চেটে নিই স্বাদ―
জোয়ারের থইথই জলে ডুবে গেলে পারদ-রঙা চর, শ্বাসমূলগুলো নাক উঁচু করে থাকে―আমি ভাবি, খুব যত্ন করে সারি সারি কে রুয়ে দিয়ে গেল অজস্র হরিণের শিং―
ঋতুর নিয়ম মেনে বর্ষা নেমে এলে সুন্দরবন আরও বেশি সতেজ, সবুজ হয়ে ওঠে―
দুপুরের দৃশ্যাবলি
বর্ষাধোয়া ভাদ্রের রোদ পৃথিবীজুড়ে নামে―লেগে থাকে সুন্দরী, গেওয়া, গরানের পাতায়―হরগোজার কাঁটায় ঠিকরে পড়ে সেই রোদ―চিক চিক করে ওঠে ভাটায় শান্ত নদীটির জল―জাল বোনার ফাঁকে গোলপাতার টঙ-ঘরে বসে আমি দুপুরের দৃশ্যাবলি দেখি―
এই কি সেই নদী, যার বাঁক ঘুরে এসেছিল খানজাহান আলীর নাও―জোয়ারের অপেক্ষা নিয়ে এইখানে ভিড়েছিল নিশান ওড়া দিল্লির বজরা―তার নোঙর যেন শিংঅলা মহিষের মাথা―কাছি যেন গোলবাহার সাপ―
বিশাল পেটের খোলে শুয়ে ছিল কালাপাহাড় ধলাপাহাড়―শরতের ধারালো রোদ্দুর পোহাবে বলে তারাও উঠে এসেছিল লোহার গলুইয়ের ’পর―তখন বনমোরগের ডাক আর হেঁতাল-কেতকীর পাতায় বেজে উঠেছিল স্বাগত সঙ্গীতের সুর―
সেই ফাঁকে, সোনাবিবি, ঘোমটা সরিয়ে একবার দেখে নিয়েছিল সুন্দরবনের অপরূপ রূপ―
ঋণ স্বীকার
উড়ে যেতে যেতে এই গ্রামে কুর্নিশ করে যায় মেঘ―তার নিচে সুপারির বাকলে ঘেরা বাড়ি―এখানে, ছোট ছোট ঘরের পাশে কেয়া আর কেওড়ার বন―মেঘের বিপরীতে বনটিয়ে উড়ে যায় যদি, আমি তার পিছে পিছে চলি―
ও মেঘ, জল আগুন আর শব্দ কীভাবে এক দেহে রাখো―আমাকে কি সেই বিদ্যা দেবে―দেখো, এই গোলপাতার ঘরে বাস করে যারা, তারা সব বাঘ―আমি তো তাদের সাথে চলি, কথা কই―তাদেরই তরুণ কোনো মেয়ে প্রিয় বাঘিনী আমার―
আমাকে মুগ্ধ করে তোমার এই উড়ে উড়ে চলা―চোখ নেই, তবু, যেদিকে পাহাড়, শুধু সেদিকেই যাও―প্রিয়তম বাঘিনীর কাছে যেভাবে আমিও যাই রোজ―তোমার কাছেই তো শেখা সব―যদিও, এতকাল সেই ঋণ করিনি স্বীকার―
আরও পড়ুন:
মারিয়ানার ৩৫০ বছর আগের প্রেমপত্র: বিরহগাথা ॥ আদনান সৈয়দ