শাশ্বতী
শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে
প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া;
স্বর্ণ সুযোগে লুকাচুরি-খেলা করে
গগনে-গগনে পলাতক আলো-ছায়া।
আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে;
হানে মৃদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি:
মূক প্রতীক্ষা সমাপ্ত অবশেষে,
মাঠে, ঘাটে, বাটে আরব্ধ আগমনী।
কুহেলীকলুষ, দীর্ঘ দিনের সীমা
এখনই হারাবে কৌমুদীজাগরে যে;
বিরহবিজন ধৈর্যের ধূসরিমা
রঞ্জিত হবে দলিত শেফালি শেজে।
মিলনোৎসবে সেও তো পড়েনি বাকি,
নবান্নে তার আসন রয়েছে পাতা:
পশ্চাতে চায় আমারই উদাস আঁখি;
একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা॥
একদা এমনই বাদল শেষের রাতে—
মনে হয় যেন শত জনমের আগে—
সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে;
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণীজুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;
একটি পণের অমিত প্রগলভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে॥
সন্ধিলগ্ন ফিরেছে সগৌরবে;
অধরা আবার ডাকে সুধাসংকেতে,
মদমুকুলিত তারই দেহসৌরভে
অনামা কুসুম অজানায় ওঠে মেতে।
ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি,
অবাধ সাগরে উধাও অগাধ থেকে;
অমল আকাশে মুকুরিত তার হৃদি
স্বাতি মণিময় তারই প্রত্যভিষেকে।
স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখি-সম;
সে-রোমরাজির কোমলতা ঘাসে-ঘাসে;
পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম;
কিন্তু সে আজ আর কারে ভালোবাসে।
স্মৃতিপিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে
আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা:
সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না॥
উটপাখি
আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি?
কেন মুখ গুঁজে আছো তবে মিছে ছলে?
কোথায় লুকাবে? ধূ-ধূ করে মরুভূমি;
ক্ষ’য়ে-ক্ষ’য়ে ছায়া ম’রে গেছে পদতলে।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই;
নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ।
নিষাদের মন মায়ামৃগে ম’জে নেই;
তুমি বিনা তার সমূহ সর্বনাশ।
কোথায় পলাবে? ছুটবে বা আর কত?
উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা।
প্রাক্পুরাণিক বাল্যবন্ধু যত
বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা॥
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূন্যে চলবে না আগাগোড়া।
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনো বিপদপ্রাজ্ঞ নও।
নব সংসার পাতি গে আবার চলো
যে-কোনো নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে।
মিলবে সেখানে অনন্ত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্ষণে॥
কল্পলতার বেড়ার আড়ালে সেথা
গ’ড়ে তুলবো না লোহার চিড়িয়াখানা;
ডেকে আনবো না হাজার হাজার ক্রেতা
ছাঁটতে তোমার অনাবশ্যক ডানা।
ভূমিতে ছড়ালে অকারী পালকগুলি,
শ্রমণশোভন বীজন বানাবো তাতে;
উধাও তারার উড্ডীন পদধূলি।
পুঙ্খে পুঙ্খে খুঁজব না অমারাতে।
তোমার নিবিদে বাজাব না ঝুমঝুমি,
নির্বোধ লোভে যাবে না ভাবনা মিশে;
সে-পাড়াজুড়ানো বুলবুলি নও তুমি
বর্গীর ধান খায় যে ঊনতিরিশে॥
আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দু-জনে সমান অংশীদার
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,
আমাদের ‘পরে দেনা শোধবার ভার।
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি।
ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে।
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক’রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি:
তুমি নিয়ে চল আমাকে লোকোত্তরে,
তোমাকে বন্ধু আমি লোকায়তে বাঁধি॥
মহাসত্য
অসম্ভব, প্রিয়তমে, অসম্ভব শাশ্বত স্মরণ;
অসংগত চির প্রেম; সংবরণ অসাধ্য অন্যায়;
বন্ধদ্বার অন্ধকারে প্রেতের সন্তপ্ত সঞ্চরণ
সাঙ্গ করে ভাগীরথী অকস্মাৎ বসন্তবন্যায়॥
সে-মিলন অনবদ্য, এ-বিরহ অনির্বচনীয়
ধ্বংসসার স্বপ্তস্তূপে অচিরাৎ হারাবে স্বরূপ;
আশা আজি প্রবঞ্চনা; দিব না স্মারক অঙ্গুরীয়;
ব্যবধি ব্যাপক জেনে অঙ্গীকার নির্বোধ বিদ্রূপ॥
তবু রবে অন্তঃশীল স্বপ্রতিষ্ঠ চৈতন্যের তলে
হিতবুদ্ধিহন্তারক ক্ষণিকের এ-আত্মবিস্মৃতি;
তোমারই বিমূর্ত প্রশ্ন জীবনের নিশীথ বিরলে
প্রমাণিবে মূল্যহীন আজন্মের সঞ্চিত সুকৃতি॥
মৃত্যুর পাথেয় দিতে কানা কড়ি মিলিবে না যবে,
রূপান্ধ যুবার ভ্রান্তি সেই দিন মহাসত্য হবে॥
জাতিস্মর
নাথু সংকটে হাঁকে তিব্বতী হাওয়া।
প্রাকৃত তিমিরে মগ্ন চুমলহরি।
ছঙ্গু-সায়রে কার বহিত্র যাওয়া
অপর্ণ বনে দিয়েছে রহস ভরি॥
সুহৃদ আগুন নিবে গেছে গৃহকোণে;
শ্রান্তসাথীরা স্বপনে আপনহারা;
আমি শুধু বসে তুষারিত বাতায়নে
প্রহরে প্রহরে গুণি খসে কত তারা॥
অঙ্গ তুহিন, তপ্ত আমার মাথা,
ক্লান্ত, তথাপি নিদ্রা আসে না ডাকে;
বাণীহীন কোন্ অনাদি বিষাদগাথা
গুঞ্জরে বিস্মরণের ফাঁকে ফাঁকে॥
হিমানীবিজন এই দুর্গম দেশে,
মনে হয় যেন, কে আমার অনুগামী;
হয়তো বা আমি ভুলে গেছি আজ কে সে,
কিন্তু ভোলেনি তারে অন্তর্যামী॥
বিগত জনমে, এই পর্বতশিরে,
এমনই নীরব প্রাগৈতিহাসিক রাতে
শিকার সমাপি এসেছিনু ঘরে ফিরে
মৃগের বদলে তাহারে কি ল’য়ে সাথে?
মিনতি আমার প্রথমে ধরেনি কানে;
কুটিল ভ্রূকুটি মোছেনি ললাটে ত্বরা;
তার পরে কেন—তা কেবল সেই জানে-
অযাচিতে হল সহসা স্বয়ংবরা॥
চ্যুত বল্কলে নিবে গেল দীপখানি;
বাহিরের হিম মুকুরিল দ্রব চোখে;
হঠাৎ তাহার লঘু ভাস্বর পাণি
খুঁজিল আমারে প্রাক্তন নিরালোকে॥
আবার কি তার আদিম নিমন্ত্রণী
আহ্বানে মরে অমৃতের অভিসারে?
কাঁদে সেদিনের প্রণব প্রতিধ্বনি
প্রত্ন গিরির গহ্বর কারাগারে?
পুরাণপুরুষ ছাড়া পাবে নিমেষে কি?
মাটির মানুষ মিলিবে মাটির সনে?
বিদগ্ধ প্রাণী, এ কি মরীচিকা দেখি?
ফিরিব প্রভাতে পরিচিত পরিজনে॥
মৌল আকূতি মরমেই যাবে ম’রে।
জনশূন্যতা সদা মোরে ঘিরে রবে।
সামান্যাদের সোহাগ খরিদ ক’রে
চিরন্তনীর অভাব মিটাতে হবে॥
বর্বর বায়ু চিরায়ু অচলচূড়ে
মুছে দেবে মোর অশুচি পায়ের রেখা।
মার্জিতরুচি জনপদে, বহু দূরে,
ভিড়ে মিশে আমি ভেসে যাব একা একা॥
অপচয়
প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্ময় রজনী,
ফেনিল মদিরা-মত্ত জনতার উল্বণ উল্লাস,
বাঁশির বর্বর কান্না,মৃদঙ্গের আদিম উচ্ছ্বাস,
অন্তরের অন্ধকারে অনঙ্গের লঘু পদধ্বনি?
আছে কি স্মরণে, সখী, উৎসবের উগ্র উন্মাদনা,
করদ্বয়ে পরিপ্লুতি, চারি চক্ষে প্রগল্ভ বিস্ময়,
শূন্য পথে দুটি যাত্রী, সহসা লজ্জার পরাজয়,
প্রতিজ্ঞার বহুলতা, আশ্লেষের যুগ্ম প্রবর্তনা?
সে-শুদ্ধ চৈতন্য, হায়, বৃথা তর্কে আজি দিশাহারা,
বন্ধ্য স্পর্শে পরিণত স্বপ্নপ্রসূ সে-গাঢ় চুম্বন;
ভ্রাম্যমাণ আলেয়ারে ভেবেছিল বুঝি ধ্রুবতারা,
অকূল পাথারে তাই মগ্নতরী আমার যৌবন॥
মরে না দুরাশা তবু; মনে হয় এ-নিঃস্ব জগতে
এতখানি অপচয় ঘটাবে না বিধি কোনো মতে॥
সৃষ্টিরহস্য
আয়ুর সোপানমার্গ বহু কষ্টে অতিক্রম করি
উন্মুক্ত মৃত্যুর প্রান্তে ঊর্ধ্বমুখে দাঁড়ায়েছি এসে;
সিন্ধুর ভাস্বর আঁখি খোঁজে মোরে নিম্নে নিরুদ্দেশে;
আমার আরতিদীপ মহাশুন্যে সাজায় শর্বরী॥
সম্মুখে নিখিল নাস্তি, পৃষ্ঠদেশে মৌল নীরবতা;
প্রশান্তি দক্ষিণে, বামে; জনহীন, অন্তর, বাহির।
তবু কার আবির্ভাবে কণ্টকিত আমার শরীর;
অবচেতনার তলে গুমরে কি জাতিস্মর কথা?
তবে কি বিরাট শূন্য শূন্য নয়, সাগরের প্রেত;
উদ্বেল বিক্ষোভ তার পরিণত বিদেহ ঈথারে?
তবে কি দুর্মর মর্ত্য ক্রন্দসীতে ক্রন্দন বিথারে;
শস্যের মিসরী শবে উপ্ত সম্ভাবনার সংকেত?
নির্লিপ্ত আলোর দ্বীপ নয় ওই দিব্য নীহারিকা,
কালের প্রপাতে মগ্ন বাসনার ভাসমান ফেনা?
অবচ্ছিন্ন তারারাশি, ওরা চিরদিনকার চেনা
পশুদের স্থুল সত্তা, লালসার মূর্ত বিভীষিকা?
নাই নাই মৌন নাই, সর্বব্যাপী বাঙ্ময় জগৎ;
নির্বাণ বুদ্ধির স্বপ্ন, মৃত্যুঞ্জয় জ্বলন্ত হৃদয়;
হয়তো মানুষ মরে, কিন্তু তার বৃত্তি বেঁচে রয়;
জন্ম হতে জন্মান্তরে সংক্রমিত প্রত্ন মনোরথ॥
কপোল কল্পনা ত্যাগ; নিরাসক্তি অসাধ্যসাধন;
অনন্তপ্রস্থান মিথ্যা; সত্য শুধু আত্মপরিক্রমা;
বিদ্রোহে স্বাতন্ত্র্য নাই; মুক্তি মানে নিরুপায় ক্ষমা;
সৃষ্টির রহস্য মাত্র আলিঙ্গন, পুনরালিঙ্গন॥
হৈমন্তী
বৈদেহী বিচিত্র আজি সংকুচিত শিশিরসন্ধ্যায়
প্রচারিল আচম্বিতে অধরার অহেতু আকূতি:
অস্তগামী সবিতার মেঘমুক্ত মাঙ্গলিক দ্যুতি
অনিত্যের দায়ভাগ রেখে গেল রজনীগন্ধায়॥
ধূমায়িত রিক্ত মাঠ, গিরিতট হেমন্তলোহিত,
তরুণতরুণীশূন্য বনবীথি চ্যুত পত্রে ঢাকা,
শৈবালিত স্তব্ধ হ্রদ,নিশাক্রান্ত বিষণ্ন বলাকা
ম্লান চেতনারে মোর অকস্মাৎ করেছে মোহিত॥
নীরব, নশ্বর যারা, অবজ্ঞেয়, অকিঞ্চন যত,
রুচির মায়ায় যেন বিকশিত তাদের মহিমা;
আমার সঙ্কীর্ণ আত্মা, লঙ্ঘি আজ দর্শনের সীমা,
ছুটেছে দক্ষিণাপথে যাযাবর বিহঙ্গের মতো॥
সহসা বিস্ময়মৌন উচ্চকণ্ঠ বিতর্ক, বিচার,
প্রাণের প্রত্যেক ছিদ্রে পরিপূর্ণ বাঁশরীর সুর:
জানি মুগ্ধ মুহূর্তের অবশেষ নৈরাশে নিষ্ঠুর;
তবু জীবনের জয় ভাষা মাগে অধরে আমার॥
যারা ছিল একদিন; কথা দিয়ে, চ’লে গেছে যারা;
যাদের আগমবার্তা মিছে ব’লে বুঝেছি নিশ্চয়;
স্বয়ম্ভূ সংগীতে আজ তাদের চপল পরিচয়
আকস্মিক দুরাশায় থেকে থেকে করিবে ইশারা॥
ফুটিবে গীতায় মোর দুঃস্থ হাসি, সুখের ক্রন্দন,
দৈনিক দীনতা-দুষ্ট বাঁচিবার উল্লাস কেবল,
নিমেষের আত্মবোধ, নিমেষের অধৈর্য অবল,
অখণ্ড নির্বাণ-ভরা রমণীর তড়িৎ চুম্বন॥
মোদের ক্ষণিক প্রেম স্থান পাবে ক্ষণিকের গানে,
স্থান পাবে, হে ক্ষণিকা, শ্লথনীবি যৌবন তোমার:
বক্ষের যুগল স্বর্গে ক্ষণতরে দিলে অধিকার;
আজি আর ফিরিব না শাশ্বতের নিষ্ফল সন্ধানে॥
অকৃতজ্ঞ
আমার মৃত্যুর দিনে কৌতূহলী প্রশ্ন করে যদি-
সাধিলাম কি সুকৃতি, হব যার প্রসাদে অমর?
মেনে নিও মুক্ত কণ্ঠে, নেই মোর পাপের অবধি;
সারা ইতিহাস খুঁজে মিলিবে না হেন স্বার্থপর॥
অজস্র ঐশ্বর্য মোরে অর্পিয়াছে সমুদার বিধি;
ভুঞ্জেছি নিষ্কুন্ঠ মনে সে-সকলই প্রাপ্য ভেবে আমি।
পেয়েছি অমিত সুধা আমন্থিয়া কালের বারিধি;
করেছি তা আত্মসাৎ, শুধু বিষ কণ্ঠে গেছে থামি॥
দেখেছি এ-মরচক্ষে নটরাজ মহাশূন্যে নাচে;
শুনেছি পার্থিব কানে সে-নক্ষত্রনুপূরের ধ্বনি।
তথাপি আমার বীণা বাজায়েছে বেসুর পিশাচে;
অধরার অনুনাদে সাড়া কভু দেয়নি ধমনী॥
ফাল্গুন অঙ্গনে মোর ছড়ায়েছে অশোক পলাশ।
দক্ষিণের বাতায়নে কৃষ্ণচূড়া হেনেছে বৈশাখ।
জাগায়ে মেদুর মেঘে চপলার চকিত বিলাস
বিকচ কদম্বকুঞ্জে আষাঢ় দিয়েছে মোরে ডাক॥
শেফালিরঞ্জিত হস্তে নবান্নের নৈবেদ্য এনেছে
অতিক্রমি কাশবন সিতাম্বর শ্যামল আশ্বিন।
কাননে ছড়ায়ে সোনা উদাসী অঘ্রান চ’লে গেছে
পৌষের পাথেয় দিতে সর্বহারা হয়েছে বিপিন॥
তথাপি অভাব মোর মিটে নাই মুহূর্তের তরে;
অপব্যয়ী প্রকৃতির অরক্ষিত দানসত্র থেকে
অপহরি মহাবিত্ত আনিয়াছি বৎসরে বৎসরে
অন্তর্ভৌম কোষাগারে মরুলুপ্ত সুড়ঙ্গের পথে॥
সে-উদার দৃষ্টান্তেও হয় নাই কার্পণ্য লজ্জিত,
সন্দেহের অবকাশ পায় নাই গৃধ্নুতা আমার।
ফিরেছি ধনীর দ্বারে অপলাপী চীবরে সজ্জিত,
বলেছি নাটকী স্বরে, বিশ্বে শুধু সত্য অবিচার॥
অন্তরঙ্গ সখাসম ফুলধনু আমার ইঙ্গিতে
ফুটায়েছে পারিজাত হিমরুক্ষ তুঙ্গ তপোবনে;
স্বয়ংবরা শৈলসুতা এসেছে কৌমার্য নিবেদিতে;
টুটেছে দুঃস্বপ্ন মোর ব্রহ্মান্ডের মঙ্গলাচরণে॥
তবু মোর নীল কণ্ঠে উঠে নাই কামোদ ঝংকারি;
অনভ্যস্ত রসনায় উৎসরিত হয়নি দীপক।
মোর প্রিয়সম্ভাষণে বিরহের আশঙ্কা সঞ্চারি,
অন্তরের দ্বার জুড়ে হেসেছে অশ্লীল বিদূষক॥
গোপন বৈভব আমি ব্যক্ত কভু করিনি প্রিয়ারে;
বুঝি নাই বিনিময়, বিনা বরে কুড়িয়েছি পূজা;
অভিব্যাপ্ত ক্ষুধা মম অবরোধে ঘিরেছে তাহারে;
পরিতৃপ্তি বিতরিতে পারেনি স্বয়ং দশভূজা॥
নিমেষ না যেতে তাই ফুরায়েছে প্রথম আবেশ;
উন্মীলিত বিলোচন জ্বলিয়াছে বিপ্রবলব্ধ লোভে,
অচিরাৎ সে-আগুন কামেরে করেছে ভস্মশেষ;
অপর্না সেজেছে চণ্ডী আত্মহিতে মোর উপদ্রবে॥
কেবলই চেয়েছি আমি, ক্ষতি কভু ছোঁয়নি আমারে;
কোনোদিন বজ্রাঘাতে সর্বস্বান্ত করেনি উর্বশী;
মোর তারাদীপাবলী মূলাধার অমার ফুৎকারে
কখনো যায়নি নিবে, ধ্বংসমূক হয়নি ক্রন্দসী॥
শিখিনি কদাচ আমি কাম্য যার নিশ্চিন্ত অমরা,
অনির্বাণ কুম্ভীপাকে হতে হয় তাহারে নিখাদ।
শুধুই জঞ্জালে তাই ভরিয়াছি প্রাণের পসরা;
গায়ত্রী জপেছি, কিন্তু শোনা গেছে নিরর্থ নিনাদ॥
আমার মৃত্যুর দিনে, তাই যদি অলস জিজ্ঞাসু
মাগে শবপরিচিতি, বিনা ভাষ্যে বোলো তারে, সখা,-
জগতের কোনো কাজে লাগেনি এ-অখ্যাত গতাসু,
যায়নি অনাথ ক’রে কোনো মৌন হৃদয়-অলকা॥
১৯৪৫
০১.
তুমি বলেছিলে জয় হবে, জয় হবে :
নাট্সী পিশাচও অবিনশ্বর নয়।
জার্মানি আজ ম্রিয়মাণ পরাভবে;
পশ্চিমে নাকি আগত অরুণোদয়।
অন্তত রুষ বাহিনী বন্যাবেগে
কবলিত করে শোষিত দেশের মাটি;
বিভীষণদের উচ্ছেদে ওঠে জেগে
স্বাধীন প্যারিস্, যথারীতি পরিপাটী;
এ-বারে সমরে,শান্তিতে সহযোগী
মার্কিন্ ঢালে সমানে শোণিত, টাকা;
ধনিক যুগের প্রধান ভুক্তভোগী
ইংলণ্ডেই সমাজতন্ত্র পাকা॥
০২
অবশ্য চীনে নেতারা স্বার্থপর,
সর্বথা জনশক্তির বাধ সাধে;
স্থগিত ভারতে আপ্ত কালান্তর,
জিন্না যেহেতু বিমুখ গান্ধিবাদে।
তাছাড়া আবার রক্ষকে ভক্ষকে
ভেদ ভোলে স্বচ্ছন্দ বেল্জিয়ামে;
ইটালির প্রতিবিপ্লবী পক্ষকে
সম্মুখ রেখে, ত্রাতারা তারণে নামে।
তথাচ গ্রিসের ট্রটস্কীয় বামাচারী
বিনষ্ট চার্চিলের বাক্যবাণে;
ধরে তুরস্ক বিশ্রুত তরবারি;
আর্জেন্টিনা প্রগতির রথ টানে॥
০৩
সত্য কি তবে সে-দিন তোমার মুখে
ভর করেছিল দুরূহ দৈববাণী?
ভূয়োদর্শনে ঢাকি অতিবস্তুকে,
তাই আমাদের অনুভবে শুধু হানি?
হয়তো অমৃত ব্যর্থ মৃত্য বিনা,
পাপ পুণ্যের মুকুরিত প্রতিরূপ,
ক্লীবের মারণ ভীষ্মের দক্ষিণা,
মুক্তির উৎপত্তি অন্ধকূপ,
ভূতের অগাধে নিহিত ভবিষ্যৎ,
অন্যায় আনে আস্থা ন্যায়ের প্রতি,
শত্রুনিপাত মহামৈত্রীর পথ,
পরিশ্রমীর স্বধর্মে সদ্গতি॥
০৪
কিন্তু জীবন এতই বিকল কি যে
কেবল মরণে প্রমার সম্ভাবনা?
প্রাণধারনের যে, দৃষ্টান্ত নিজে
রেখে গেছ, তা কি অন্ধ প্রবঞ্চনা?
ক্ষমা, অহিংসা, মনীষা, বিবেকী দ্বিধা,
অত্যাচারের সঙ্গে অসহযোগ,
অসম্পৃক্ত ইষ্টের সদভিধা,
বিচারে বিশ্বমানবের বিনিয়োগ
এ-সকলে আজ তুমি কি নিরুৎসাহ,
বুঝেছ সাধুর শাঠ্যেই মজে শঠ?
রাইনে জুড়ায় বার্সেলোনার দাহ,
স্পেনে নিষিদ্ধ যদিও ধর্মঘট!
০৫
অতএব হোক আহ্লাদে আটখানা
বুদাপেস্তের ধ্বংসে হিসাবী চেক্:
কার্যকারণে ধার্য বিমানহানা,
ভার্শাও দ্রেস্দেনের পূর্বলেখ।
সমিতি বসুক লণ্ডনে, লুব্লিনে,
যে যাবে, সে যাক সান্ফ্রান্সিস্কোতে,
মিথ্যা মানুক আর্তেরা দুর্দিনে:
কর্মের ফল ফলবেই জোতে জোতে।
আজও নিমিত্তমাত্র সব্যসাচী;
মমতা অচল সাধারণ শুদ্ধিতে:
কৃপা খুঁজে মরে মোহজালে কানামাছি;
ব্যাহত বিধাতা ব্যক্তির বুদ্ধিতে॥
০৬
তবু জানি যবে জয় হবে বলেছিলে,
চাওনি তখন তুমিও এ-পরিণাম:
শুন্যে ঠেকেছে লাভে লোকসানে মিলে,
ক্লান্তির মতো, শান্তিও অনিকাম।
এরই আয়োজনে অর্ধশতক ধ’রে,
দু-দুটো যুদ্ধে,একাধিক বিপ্লবে;
কোটি কোটি শব পচে অগভীর গোরে,
মেদিনী মুখর একনায়কের স্তবে!
নির্বাণ নভে গৃধ্নু রাহুর গ্রাস
তুমি অনিকেত নির্বাক নাস্তিতে:
কে জবাব দেবে, নিখিল সর্বনাশ
কোন্ অবরোহী পাতকের শাস্তিতে?
নাম
চাই চাই আজো চাই তোমারে কেবলি|
আজো বলি,
জনশূণ্যতার কানে রুদ্ধ কণ্ঠে বলি আজো বলি—
অভাবে তোমার
অসহ্য অধুনা মোর, ভবিষ্যৎ বন্ধ অন্ধকার,
কাম্য শুধু স্থবির মরণ|
নিরাশ অসীমে আজো নিরেপক্ষ তব আকর্ষণ
লক্ষ্যহীন কক্ষে মোরে বন্দি ক’রে রেখেছে, প্রেয়সী,
গতি-অবসন্ন চোখে উঠিছে বিকশি’
অতীতের প্রতিভাস জ্যোতিষ্কের নিঃসার নির্মোকে|
আমার জাগর স্বপ্নলোকে
একমাত্র সত্তা তুমি, সত্য শুধু তোমারি স্মরণ॥
তবু মোর মন
চাহে নাই মোহের আশ্রয়|
জানি তুমি মরীচিকা; তোমা সনে প্রাণ বিনিময়
কোনোদিন হবে না আমার|
আমার পাতালমুখী বসুধার ভার,
জানি, কেহ পারিবে না ভাগ ক’রে নিতে;
আমারে নিঃশেষে পিষে, মিশে যাবে নিশ্চিহ্ন নাস্তিতে
এক দিন স্বরচিত এ পৃথিবী মম॥
জানি ব্যর্থ, ব্যর্থ সেই সন্ধ্যা নিরুপম
যবে মোর আননে নেহারি
অগাধ নয়নে তব ফলদা স্বাতীর পূণ্য বারি
উঠেছিল সহসা উচ্ছল|
জানি সেই বনপথে, চিরাভ্যস্ত প্রেম নিবেদনে
আপনারে ছলি,
পশিনি তোমার মর্মে, নিজের গহনে
জমিয়েছিলাম শুধু মিথ্যার জঞ্জাল|
জানি, কত তরুণীর গাল
অমনি অধৈর্যভরে শতবার দিয়েছি রাঙায়ে ;
অনুপূর্ব পথিকার পারে
বজ্রাহত অশোকেরে অলজ্জায় করেছি বিনত
ক্ষণিক পুষ্পের লোভে| ক্রমাগত
তাদের পদাঙ্ক মুছে গেছে রৌদ্রে, ধারাপাতে, ঝড়ে;
যুগান্তরে
তোমার স্মৃতিও জানি, সেই মতো হারাবে ধুলায়॥
তবু চায়, প্রাণ মোর তোমারেই চায়|
তবু আজ প্রেতপূর্ণ ঘরে
অদম্য উদ্বেগ মোর অব্যক্তেরে অমর্যাদা করে;
অনন্ত ক্ষতির সংজ্ঞা জপে তব পরাক্রান্ত নাম—
নাম—শুধু নাম—শুধু নাম॥