সুদীর্ঘ শীতরাত্রি
তারপর, সুদীর্ঘ শীতরাত্রি এলে প্রাচীন মন্দির থেকে উড়ে আসে ঘণ্টার আওয়াজ। আমরা যারা নবীন শিকারী, পাললিক বাতাসে চড়ে আসা এই সব শব্দ শুনে ভাবি একঝাঁক ধাবমান চিতা।
তারও অনেক পরে যখন ঠাণ্ডা মুখের মতো একখণ্ড চাঁদ নিঃশব্দতার পুকুরে নিঃসঙ্গ সাঁতার কাটতে শুরু করে, তখন কোনো এক শিকারসঙ্গীর ঠোঁটে জ্বলে ওঠে আগুন এবং পালমল ধোঁয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে নিতে আমরাও বুনতে শুরু করি গল্পের চারা। আজ, এইখানে যে হরিণীটি বধ হবে, শুনেছি পূর্বজন্মেও সে মরেছিল একই নিয়মে। অথচ তারও ছিল কিছু স্বপ্ন—প্রেম—ছিল রিরংসা…
আমাদের অজস্র আষাঢ়ে গল্প সেই সব হরিণীর উদ্দেশে উড়ে যেতে থাকে…
তোমার কুঠার
এই গেঁয়ো দুপুরের রোদে স্নান করা হলো—পায়ের তালু থেকে সরে সরে গেল সাড়ে তিন মাইল মেঠোপথ—কত বুনো পাখি, জংলি ফুল আর পাতার গল্প নিয়ে এখন এই নরোম ছায়ার নিচে বসে আছি—রোদের সরোবরে টুকরো টুকরো মেঘেদের সাঁতারের কথা ভাবি, একা—কী দুর্দান্ত এই দিন—বড় ঘামঝরানিয়া—
গোশালার হাওয়া আসে সাথে আসে ঘাস আর গরুর পাকস্থলীর ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়া ঘ্রাণ—জাবরকাটা চোয়াল বেয়ে নেমে যায় গরুদের ঘুম—এটুলির মতো গায়ে লেগে থাকে দগ্ধ দুপুরের আরাম—এইসব দেখি নিরিবিলি, একা—এই অপূর্ব, ঘামঝরানিয়া দিনের দুপুরে—
অদূরে জঙ্গল ছিল—কুঠারের আঘাত পেয়ে ভেসে আসত খণ্ডিত কাঠের চিৎকার এখন ওসব নেই—তবু আমি, জঙ্গলফেরত কোনো-এক কাঠুরের প্রতীক্ষায় বসে থাকি রোজ
যারা গাছেদের নির্বাক বলে জানে—বলে দাও তাদের, ওহে কাঠুরে, তোমার কুঠার কেবল বৃক্ষদের ভাষা দিতে পারে!
বাদাবন
মাটির মানুষ আমি, খাটি দিনরাত। কোদাল চালাতে গিয়ে ঘামি। জল আর কাদা মেখে হই একাকার। ক্লান্ত হই। আমার ক্লান্তিও ধরে মাটি। এই মাটি, ঘাসের মখমল বিছিয়ে রাখে মাঠে। শহরে যে বন্ধুরা থাকে, তাদেরও বলেছি এই কথা, ‘একবার আয় আমাদের গ্রামে, সারারাত ঘাসের বিছানায় শুই, কথা কই তারাদের দিকে চেয়ে…’
আমি যার গেঁয়ো প্রেমিক, তাকে পাঠাই ফুল। নীল নীল ঘাসফুল সব। নাচের স্কুলে পড়ে সে। শহরের রঙিন মঞ্চে তার উত্তরীয় ওড়ে। তার কথা ভেবে সারা রাত জাগি—আকাশে অসংখ্য তারা। তাদেরও তো নাম আছে, ধাম আছে, আলো আছে আলাদা আলাদা।
দক্ষিণে বাদাবন। বাঘের ডাকে ঘুম ভাঙে গভীর কোনো রাতে। বাঘটার মুখে ধরা হরিণীকে ভেবে সারা রাত কাঁদি, গোধূলির মেঘের মতো লাল হয় চোখ। কোদাল কোপাতে গিয়ে অসাবধানে ভাঙে যদি শামুকের ডিম, তখনও তো কেঁদে কেঁদে এ বুক ভাসাই।
বাদাবন পেরিয়ে গেলে অথৈ সাগর। আমার বাল্য বন্ধু সুধাকর যায়। ইলিশের মরসুম এলে প্রতিবার নৌকা ভাসায়। কূল নেই। জল তার আকাশে মিলেছে, নাকি আকাশ মিশেছে ওই জলে, এত দিন সমুদ্রে গেল, সুধাকর আজও তার পায়নি জবাব। ঘাম আর চোখের জলের মতো তার স্বাদ—ও কেবল এতটুকু জানে।
আমারও ইচ্ছে করে সমুদ্রে যাবার, শুধু প্রেমিকা ছাড়ে না। কেবলই শাসনে রাখে। এখানে-সেখানে যাই, মাঠ-ঘাট চষি, আনমনে ঘুমিয়ে পড়ি ঘাসে—এসব বারণ করে। আর দেয় নিজের দিব্যি, ‘ওখানে সাপের বাস। শঙ্খিনী, চন্দ্রবোড়া, গোখরার হাঁড়ল—সবুজ ঘাগরা আর ঘুঙুরের দিব্যি দিয়ে বলি, ওখানে যাবে না কিন্তু…’
আমি শুধু হাসি। কে তারে বোঝাবে গিয়ে, এমন বেহুলা আছে যার, তার কি সর্পভয় সাজে?