শীতলপাটি
ছাবিয়া বেগম—যার গায়ের রঙ সিন্ধু নদ থেকে উঠে আসা মাগুরমাছের মতো ফ্যাকাশে কিংবা কালো। তাঁর ছিলো একান্ত মহৎ ও মোমবাতি জীবন। হাজার বছর আগের গুহাময় অন্ধকারে নিভৃতে জ্বলতেই দেখি অথচ মায়ের আলোয় প্রাগৈতিহাসিক খাওয়া-দাওয়া—দ্রাবিড় সন্ধ্যার ইতিহাস পাঠ—উপনিবেশিক ঘুমপড়া চলে..
মায়ের বিয়ে সংক্রান্তি,—আব্বার খিলখিল হাসি—ভুবন বাড়ির উঠোন—ভাঙা কোসনের কানিদে ইশারা এঁকে—কলাপাতা রঙের ফ্রকপরে কিতকিত লিখছিলো—সংসার-পাগলা গঙ্গাঋদ্ধি বয়াংসি মুনির মেয়ে—ঘনকালো মেঘের মতো লম্বা-দীঘল চুল। পিঠজুড়ে প্রাচীন যুগের পাহাড়ি দেয়াল—যেন ঝর্ণার আঁধার!
পনের ফাল্গুনে ছেমড়ির পেটে আমার জন্ম। মা এখন মাইয়ে হ’য়ে উঠেছে মাত্র! চোখে—হাওয়ার মতো তিনশো ষাট বছরের হাহাকার! পৃথিবী জন্মেরও ছয়শ বৎসর পূর্বে আমাদের জন্ম! মা এবং আমি দুইজনই একই বয়সী শিশু! তারপর এক অনার্য রাতে মায়ের সাথে আব্বার পরিচয়। প্রবল ব্যক্তিত্বে দাঁড়ানো অর্জুন গাছের ন্যায় বিজিত—সৌম্য প্রাচ্য যুবক! দুলদুল ঘোড়ার চোখের জ্যোতির মতো মেধাবী পুরুষ! আব্বার আস্তাবলে আজো হর্ষ-হ্রেষা!
মা-মাইয়েটারে বাত্তানোই—আমরণ আঁধারে তোর ভয় করে না?
নারে—বাসি-হাসি মুখে রেখে কয়।
তুই ফাজে গেলে?
আগেই দান করবানে—এক মাদুলি আগুন!
মা এমনই স্নিগ্ধ আলোমাটি—
ক্লান্তির মাঠে—খাঁটি বুননে রঙিন শীতলপাটি
অসহ্য যন্ত্রণা হাসির পেয়ালায় ঢেলে
জ্বেলে দেয় দূরতম তারার বেশে—সন্তানের কপালে স্নেহের চাঁদ বসায় মা
অথচ যুগেযুগে তিনি আঁধারের প্রতিমা!
মাছুরা খাতুন—বড় বুগো
জল-জীবনের চোখে উড়তো একটা মাছরাঙা শৈশব
চিনেল হাঁসের গ্রীবার মতো বুগো দান-দক্ষিণায় ভরপুর
আমার জন্য ছিলো—স্নেহশাসনে সম্পাদিত অনুরাগ
কনকনে শীতের সকালে জগতের খেত থেকে
কুড়ায়ে আনতো স্বপ্নের শামুক—মুক্তলোভী ঝিনুক
পুলকিত মনে খোঁপ থেকে বাইর করতো—গরম ডিম
কিনতো ইকোনো কলম—তাজা ডিম বিক্রির টাকা
বুগোর কলমে প্রথম প্রেমের কাঁচা কবিতা লেখা!
আর এই আমি?
একটা বুনো-ময়না—মৎস্য প্রজাতির কালবাউশ—মসৃণ কালো শরীর
কলাম তো—ছন্নছাড়ার একশেষ—তবু আমার শামুক স্বভাব
জীবনের চোখে শৈশব এক হিরণ¥য় আন্দোলিত পুকুর
সেখানে সাঁতার কাটে পেলব পাখনাওয়ালা স্বপ্নের রাজহাঁস
আর ঘুঘুমী কৈশোর তাড়া ক’রে ফেরে
গাঙশালিকের ছিপছিপে বুকের পালক—ধূসর বিষণœ বাদামি গ্রহে;
যেখানে ঘন কমলা-হলুদ রঙের ঠোঁটে সাজানো রূপকল্পের হরিৎ জীবন
চোখের ভূগোল ঘিরে পালকহীন পাটকিলে হলদে রঙের রিঙ
টইটই ক’রে বাঁধানো পোকা-মাকড়ী যাপন
আর দৌড়োচ্ছি দিগন্তে ঘুরঘুর করতে থাকা গন্তব্যে!
তৌহিদ আমার দুর্দান্ত সাহসী ছোটভাই
আমাদের কৈশোরের দিনগুলো ছিলো দারুণ তুখোড়—ঝগড়ামুখর
আয়ুতে ছোট হলেও বড় হ’য়ে গেছে জীবনের বায়ু!
তায়েবা মুঠোফোনে রয়না মাছের মতো হাসে
চলতে চলতে কিলান্ত—কাঁচি-কাটা পায়ের পাতায় চোখ পড়ে
এইসব ক্ষত চিহ্ন—তিলক আঁকা নির্ভর সম্বল—এখন বুঝি!
দরদী-জেদি ছোটবোন—মারুফা খাতুন
নেদা থাকতেই জড়ায়ে ধরলো টেমির আগুন
সেদিন আব্বা মায়ের প্রতি হয়েছিলো তীব্র অসহিষ্ণু
একদিন শ্রাবণের ভরা পুকুরে হাবুডুবু খাইলো মলি
অথচ ওর জীবনে দুপুর ভরপুর
কচ্ছপের ন্যায় স্থিরময় গুটানো মমতা নিয়ে
মলি চ’লে গেছে নিজস্ব খামারে
হাঁসের ছানার মতোন কোমল ভবিষ্যৎ নিয়ে
বাড়ে গেছে খরগোশের ছটফটানি
অথচ আমি সিজারের ঘোর-বিরোধী!
গোলাম মোস্তফা সরদার—আমার আব্বা
যখন বাড়িতে এলাম—
সবে কুঁড়ি বছরের জোয়ান
পিছনে ফেলে একটা গোলামী জীবন
হলেন—গর্বিত কৃষক, পোকা লাগা ধানের জন্য বিষণœ গানের সুর!
সংসারে তখন অপ্রাচুর্যসূচক উচ্চ কোলাহল!
বাবার লাঙলের ফলায় প্রথম দেখিলাম—
গীতলময় জীবন চাষের প্রকৌশল।
গৌরবময় একমাত্র ছেলেটা দারুণ রসিক
শান্তিপূর্ণ মাধুর্যের সুরে কয়—
‘আমরা সবাই মিলে ছয়ভাইবোন’
জানেন? খোলা জানলায় আব্বার ডাকনাম মধু;
অথচ দেবদারু গাছের মতো দীর্ঘতর ছায়া
আমাদের ঘিরে রাখে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া
মধুরে—আমার মধুউউউউ
তিন আলিফ মদে ডাকলে—
জীবন হয়ে ওঠে—মধুময়…
নারকেল পাতার চশমা
এই পুঁথি শিল্পের দক্ষিণা গিরাম, আলোকিত ফানুস
মানুষ—ইতিহাস কবিতার
আর জীবনের গায়ে জড়ানো—ধূ-ধূ
শুধুই দূরের হাসি
ভালোবাসি—পালায়ে যাওয়া ধুলা
শুলা দিয়ে তৈয়ারি মেলার পুতুল
আমরা মাখতে থাকি পরাজয়
ভয়—অভয়ে শব্দের গুণন শুরু
গুরুমুখী ফুলের নকশা—মহৎ জানো?
পুরোনো গোছানো গান
ধান—আর জনপ্রিয় নেতা
যেথা অতীত ঐতিহ্যে খুশি
পুষি যুদ্ধে ফেরা সৈনিকের ট্রেনিং এর মতো
কতো সাহসেরা দল বেঁধে
কেঁদে কেঁদে সান্ত্বনার জাবর কাটে
হাটে হারিকেন—ঘোলা আলো
ময়লাকালো কেরোসিনে সমুদ্র ধোয়ানো
উল্টোনো পানির মগ
জগ—কলপাড়ে খালি পড়ে থাকা
মাজাবাঁকা ছাই ফেলা ভাঙ্গা কুলো
ভুলো মনে উঁকি মারে—হালখাতার হাঁড়ি
সারি সারি কবরের বাগান
চান উঠা তারাদের ঘরে
ভরে গেছে ঐ সব কারা
তারা—অপরিচিত ছায়া!
মায়া ঝরা বাঁশপাতার মিহি স্লোগান
টানটান ব্যথায়—শিরিষের পাকা ফল—কি অপার বেদনা
কেঁদো না—ছুঁয়ে দাও—তুমি এক অচেনা ফতুর!
মধুর স্বাদ নিয়ে শরীর ঘোরে
দোরে কোনো মৌমাছি পায় না দেখা
একা বাবুই উঁচু পাতায়—বিনম্র বাসা বুনে দোলে
ঝোলে মনে প্রশান্তি—ইচ্ছের নির্জন সমুদ্রঘাট
কাঠবিড়াল খেয়ে গেল কৃষকের বীজধান
গান গেয়ে ভাত-শালিকটা শ্যালো মেশিনের গরম
নরম জলে গা ধুয়ে পালকে বুলায় ঠোঁট
জোট বাধা দুষ্টু বালক জিয়েলগাছের সরল কোমরে
গোমরে কুপায়ে খুন চড়ায়
গড়ায়—রাষ্ট্রের বুকে গলগলে ক্ষত!
গতকাল সকালে সাপঘুড়ির আঠা দরকার;
সরকার প্রয়োজনে খুনি হয়ে ওঠে!
কইমাছের জন্য খালে গেছে বাবা
হাবা-গোবা বোনটা স্কুল থেকে ফিরেই ভাত চায়
হায় এখনো রান্না হয়নি মায়ের!
ভাইয়ের সাথে ওর খুনসুটি
সরপুঁটি-ঝোল—কে খাবে আগে ভাগে
লাগে খোঁপে কবুতর জোড়া ডানায় মেখেছে গুঞ্জন ঘামের
কামের জন্য সবাই হ’য়ে ওঠে মাস্তান!
বেহান—ডাকেছে হ্যালোন, বাড়িতে ফেলেছে সাড়া!
ঋষিপাড়া থেকে ফিরলো দাদী
বাদী খাসি—ভীষণ অস্থির বুনো!
শুকনো কাঁঠালের পাতা—কুড়ায়ে, মা ফিরলো বাড়ি
শাড়িখানা আড়ায় ছিলো ঝুলে—রৌদ্রবেলা
চৌ-চালা ঘরের চালে শিমগাছে দারুণ ফুল
ভুল—শুধুই ফুলের বাহার, এবার শিমে মড়ক!
সড়ক—আধাপাকা—খাদিজার যাত্রা স্বপ্নের ছলচ্ছল
কচ্ছপের মতো হাত পা গুটিয়ে ফেলে সেখানে
যেখানে অষ্ট-ধাতুর মাদুলি—ধান শুকানো চাতাল
হাসপাতাল থেকে দূরে থাকলে বিপদ কমে
ক্রমে দূরের যাত্রী হবো—কোনো আনন্দে থাকবে না ঘটা
যতটা কাছে আসার গল্প হোক না কেন!
হেনতেন কথা—কালিবাড়ির মাঠে ফুটবল খেলা
বেলা শেষে—দর্শক নাই; সবার পেটে ক্ষুধা
সুধা—এখন বিলাস বিলাস লাগে।
একটু আগে—টায়ারবাহিত বালক—কিছু
পিছু পিছু তাদের পোষাকুকুর— পালিত গৃহ
হিংস্র জন্তুগুলো মানুষের নিখুঁত নিরাপদ!
সভাসদ—ভাঙ্গা হবে পুরোনো ঘর—জিয়েনোমাছ মাটির হাঁড়িতে
বাড়িতে এসেছে নতুন পোড়ানো ইট
ঠিক—ভবিষ্যৎ পুঁতে রাখা পিতার কারবার
বারবার—পৃথিবী জানে কিনা? বসবাস হচ্ছে মহিষের!
মানুষের প্রতি তার কোনো সিম্প্যাথি নাই!
পানের বরজ থেকে সিরাজ কাকা কয়—
নয়ছয় না করে—‘পেড়ে নে কাঁচকলাগুলো’
হুলো বেড়াল—দুধকলায় লোভ ঢুকায়ে রাখে।
এই ফাঁকে উঠোনে নারকেল শুয়োচ্ছে রোদ!—কেমন ভুলে
চুলে কোনো গন্ধ নেই বাজারের তেলে
কে বলে—এবার রবিশস্যের ফলন ভালো—তার কথা সোজা
বোঝা গেল সকালে মোরগের ডাকে!
পাকে শতবর্ষী একটা বাদাম গাছ—বাড়ির পাশে হাট
কাঠ-ঠোকরা—কুটুম ডেকে আনে—ধোঁয়া উঠছে চায়ের
মায়ের আঁচল থেকে খসে পড়ে কান্না
রান্না করা চাউলের খুঁচি—অখুশি ফেরেস্তা
রাস্তা থেকে বজলু দাদা কয়—অলক্ষুণে!
পা গুনে—ভিজে গায়ে কামরুলের রঙিলা বউ
নৌ-বাহিনী থেকে চাচা ফিরলো প্রাতে
তাতে কি এমন আসে যায়! ঐ পাশে চাঁদ বাঁকা
কাকা চোখ রাঙায়, চাচী পুলকিত হাসে! সেখানে যার
তার হাসি দেখে মনে হয়—বান্দর!
সুন্দর লুকায়ে রাখা বড়ই পাপ!
অভিশাপ, অভিশাপ—ঐ উঠোন থেকে ফিরু বুগো ডাকে
তাকে—সরিষার তেল দিতে হবে পিঠে
চিটে ভরা ধান—বড়মা কানি মেরে চায়
গা’য় কাঁদা সমেত মাছ ধরে ফিরলো মনি
শনি ধরা খাঁ খাঁ দুপুর—যেন ভয়নক দুঃসময় লাগে!
আগে থেকেই পাতা ঝরা আমগাছে ডাকছে উটকো কাক
ঝাঁক ঝাঁক পোনা—মাইকে এলান—মরে গেছে বড়খালা
জ্বালা করে বুক—ঘর থেকে মা রাবিয়া লেখা একটা মনভোলা
ফুলতোলা বালিশের কভার—হাত বুলায় শোকবহ
আহ! কতো কারুকাজ রেখে—
বেঁকে যায় আপন মানুষ—তবু ঢেকে
রেখে যায় স্মৃতির কারু ও কুজন।
হা হয়ে শুয়ে আছে নতুন বালির পথ—নেমেছে আন্ধার
সন্ধ্যার একটু আগে একটা শিয়াল—গ্রামের কোন্তে
জ্যান্ত মুরগির বাচ্চা মুখে, লোকালয় থেকে বেড়িয়ে
পেরিয়ে যাচ্ছে মরা পৃথিবীর রাস্তা—শিয়ালের ডাকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ
কেউ নেই যাত্রী ছাউনিতে—ঝুলবারান্দার কার্নিশে জমানো জীর্ণ
জনাকীর্ণ জায়গায় শব্দহীন ফাঁকা
ধোঁকা ধরা বড্ড বেমানান শোকে!
লোকে আমারে শিল্প কয়ে চিল্লায়
কিল্লায়? না খেয়ে কবি অসুস্থ প্রায়—জীবন যেন সিন্ধ
বৃদ্ধ বাবার কাছে পরাজিত তিরস্কার
পুরস্কার কবিকে গৃহস্থালি দেয়! গল্লা গল্লা!
তল্লা-বাঁশতলায় সাপ বেজির লড়াই
কড়াই তলায় দাঁড়ায়ে—আমাদের কাজ নয় উদ্ধার করা
সরাসরি বলা ভালো—শুধুই বেগার খাটা আর নিয়তির কসমিক ভাঁজ
কাজ যা করে, শুধুই সময়!
পাপের পালকিতে চড়ে মরিয়মের আনন্দের লেশ
বেশ তো—‘তুই-ই দুনিয়া পাল্টে দিলি
বুঝলি সবাই কি সপতা পারে’
মানুষ এক অসাধারণ নিরুপায়—শিকারির তাড়া
যারা শুধু থেকে যায় চিরকাল শিল্পের কারিকর।
পাথরঘাটা মনোহরনগর
ও রুমিচা বেগম
অই আকাশের কছম
এ শহর ফিরে যাবে
ঐ মধুনগর।
যে শরীরে শুয়ে আছে ঘাসের পাহাড়
গাই ফেরা সন্ধ্যার রাখাল
আমাকে দিয়ে যায় মাটিয়ালী টান
এ নগরে বৃক্ষের ছায়া ঘোরে
ঝরে কতো নিমফুল
আকন্দ গাছের ঝোঁপে—জোছনা রাতে
ভ্রম হয় কেউ যেন চুপটি বসে
এ নগরে গাছের জলে
ফলে কতো স্বপ্নের বীজ
মেঠো পথে ঝরে কতো রক্ত পলাশ
মানুষেরা ছেড়ে দেয় বৃক্ষের সুর
ডেকে আনে অফুরান মায়া।
এখানে মৌচাকে রানী আসে
আতার গন্ধে ফোটে কুমারীফুল!
ডুমুরের ফল দেখে এ নগরে ফিরে আসে অবাধ্য বাউল
দলকের তোড়ে ওঠে কানিমারা কৈ
আমনের ধানে ভাজে পড়শি মাটির খই
এ নগরে নারীদের মুখে মুখে শালুকের হাসি
পাখিরা গড়ে তোলে বিপুলা প্রাসাদ
এখানে তালপাতায় আঁকা নগরের মাথা
সিদ্ধ ধানের গন্ধ—ঘুম কেড়ে নেয়।
বরইফুলে ছড়ায়েছে উদোম ঘ্রাণ
কামিনীর তলায় হেঁটে আসা ভোর
গোর থেকে শোনা মায়ের কোরানীসুর
এ নগর মধুমাখা নয় বেশি দূর।
মাছিউড়া গবরের লেপ্টানো দোর
চুলকাটা চিত্ত’র কাটে না ঘোর
এ নগরে ফিরে আসে
ফিরে গেলে কেউ।
এখানে মশার গান
বেহুদা পথিকের ফেলে যাওয়া পথ
বুড়িভদ্রায় মিষ্টি কোমল ঢেউ
শ্রীগঞ্জের হাটে ঠাঁই হাবিবনগর।
এখানে হুক্কায় ধোঁয়া উঠা সকাল
ভাটিপূজা দিয়ে যাওয়া দয়ালের বোন, রাঁধা তার নাম
দেখে তাকে নিজেকে কৃষ্ণ ভাবতাম!
পালপাড়া পার হয়ে জাইলেদের বটতলা
ভেসে আসে নাভি-গন্ধী মাছের নিঃশ্বাস
এ নগরে আমরা সবাই কবি
গ্রিসের ঘরে ঘরে অন্ধ হোমার!
এ নগরে সবাই পরস্পরে
পরিচয় যুগযুগ ধরে
ধর্মেরা এ নগরে গলাগলি করে, দল বেঁধে চলে
বলে তাঁরা দেশত্যাগী ভিটেহারা ব্যথা
তবু আমরা এক সূত্রে গাঁথা।
এখানে চলে রসে রসে মুকাভিনয়
নদীর শান্ত জলের মতো সরল মানুষ
তারা ভয় পায় মুখোশ
মান নিয়ে ক্ষুধার্ত বাঁচে
এ নগরে বৈকাল নামে টিয়ের ঠোঁটের মতো লাল
ঘুঘু রঙের বাদামি ছাইছাই মেঘ
নেমে আসে ঘুড়ি ওড়া আকাশ
বটের মিষ্টি ফলে দৌড়ে যায় ঢেউয়া
ডালে ডালে পাখির কিচিরমিচির
বালকের সুতোকাটা সাপঘুড়ির লেজ
ফুটে থাকা হালকা বেগুনি রঙের কলমি ফুল
চারিদিকে আজ ধুতরো ফুলের মৌসুম!
এখানে আখের ক্ষেতে শিয়েলের ডাক
আকাশ শীত আর কুয়াশা নামায়
ঘন বাঁশবন—সন্ধ্যার মতোন নীরব
তার ভেতর ডেকে ওঠে হঠাৎ—হুতোমপেঁচা
ঠিক মৃত্যুর সংবাদের মতো কাতর শোনায়
এখানে বুজফলের কাঁটায় গেঁথে মায়াশৈশব
কাটা ধানখেতে নাচে কৈশোরী গঙ্গাফড়িং
ভাতশালিকের পাতে রাখা ক্ষুদার্ত চোখ
অ-ভাবের আকাশে অন্ধরাতের বাদুড়
উড়ে গেছে জীবনের রাজহাঁস, সোনালি কচ্ছপ!
এ নগরে পরিত্যক্ত ভিটেমাটি থেকে
উড়ে যায় মৃত্যুর ডানা সমেত উইপোকা
পাখিতে ভরে ওঠে মুহূর্ত আকাশ!
হলদে পাখির ডাকে ফিরে আসে বউ কথা কও
শিশুরা পা-মা ধুয়ে মুখস্থ করে শটকে
অংকে কাঁচা ছাবাল-মাইয়ে—মাকে ফাঁকি
শোনে দাদীর কাছে—বেহুলা-লখিন্দর
ঝরে পড়ে তেঁতুলের ফুল
কলা-মোচার ফুল—ভেসে আসে আদিম ঘ্রাণ
নালার জলে ভাসে ব্যাঙের ছানা
জীবন এখানে ব্যাঙের ছাতার মতো শুভ্র ও পেলব
সোনারঙা সেই ছানা মন দিয়ে দেখে
মমতায় ভরে ওঠে বালিকা প্রাণ।
বৃক্ষচারী এক নিশাচর শ্যারেল—খেয়ে পাকা কাঁঠাল
গায়ের রঙ ছাইকালো বাদামি অস্পষ্ট আভা
মাধবীলতায় গোধূলির আনাগোনা
বিল থেকে সাঁতরে আসা হাঁসের পাল
এখনো চৈত্রের রোদে শুকানো
গাব-রসে ভোজানো হাতে বোনা লাইলন সুতোর জাল
এ নগরে আছে লালনের গান
কপোতাক্ষে পদ্মফুলের আসনে মধুসূদন
ঘরে ঘরে ফররুখের রেনেসাঁ
মীরের হুসেনী বিষাদ
রাজা-ধীরাজ আছে মনোজ
এখানে নদীয়ার হারানো সুর আর তাজ
বাড়ির গেটে কাগুজে ফুলে গেছে ছেয়ে
কবরের ওপর ঝুঁকে আছে ছবেদার ডাল
হারানো শোকগুলো সিঁদুরে মেঘের মতো লাল
কৃষকেরা ঘরে ফেরে গান গেয়ে গেয়ে।
শোক দিবসের রাত
শোক দিবসের চল্লিশা রাত
কালো রাত্রি নেমে এলে পিতার কথা মনে পড়ে!
গ্লাস টাওয়ারের আলোটা আকাশ ফুঁড়ে ওঠে
বর্শার ফলার মতো স্বচ্ছ সফেদ বুকে
বিপরীত যুগলে ফিরে আসে
কষ্টের ফিসফিসে দানা
আঙুলের নরম মাথায় বাদাম ভাঙ্গার আওয়াজ!
মুড়িওয়ালাদের বাতিগুলো জলে ভেসে ভেসে
বিলায়ে যাচ্ছে নগদ লেনাদেনা
সঙ্গীর কোমল বাহুতে গুঁজে দিচ্ছে পুরুষ ঠোঁট
আঙ্গুলের ডগা খুঁজে বের করে
কাচুলির গিঁট! কুলফি মালাই!
বেড়ে যাচ্ছে গুমট আবহাওয়া
দমদম করে দৌড়াচ্ছে সময়—বুকের অলিগলি
আবছা আলোর গায়ে শিকারি চোখ মারে
সে যেন প্রতিবেশীর নজরে তাকায়
এমন আকুতি বয়ে বেড়ায় রাতের পাখিরা
নিরিবিলি হেঁটে পার হয়ে যাই
ঢাকা ক্লাবের মেইন রোড়, মৎস্য ভবন
শিল্পকলার গেট—কিড়িঙ কিড়িঙ বেল—ফনিক্স সাইকেল
মাথা নিচু করে প্রেসক্লাবের শিশুগাছ, পল্টন মোড়ে সিগারেটের মুখে আগুন
শহরের ক্লান্তি মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছে বাইতুল মোকাররম
গুলিস্তানে মৌসুমি নেশায় বেওয়ারিশ কুকুর
আকাশের দিকে চেয়ে দিলকুশার বক
শাপলা চত্বর—লাইট খেকো শিয়ালের মতো ছোক ছোক করে
হিজড়াগণিকাদের ভিড় ঠেলে কমলাপুর অভারব্রিজ
মুগদা বিশ্বরোডে কবি লতিফ চানের দেখা
কাঁদো বাঙালি কাঁদো
জাতিকে অন্ধ করে কাঁদানোর আয়োজন!
মোড়ের দোকানে সস্তায় বিক্রি হচ্ছে
পিতার ঝাঁঝালো বাণী
রাত গভীর হলে গর্জে ওঠে অসহায়
নিজেদের ভাগ্য নিয়ে সত্যিই শোকাহত ভবিষ্যৎ!
দিনভর আশটে ভ্যাপসা গুমোট গরম
থেমে থেমে বৃষ্টির নাচ—নিত্যকলা
রাস্তায় রেইনকোট পরা লোকের ভিড়
ভিজে ভিজে ফ্যাক্টরি ফেরত কাম-কর্মীরা
তাদের বেদনা মোড়ানো অসুস্থ ডানা তিরতির করে কাঁপে
ঘাসের গোড়ায় পানি পৌঁছানোর আগেই
থেমে যায় বৃষ্টির তোড়, গিলে ফেলে হা করা মাটি
তৃপ্তিত কোনো সংকেত নেই!
অনওয়ে রাস্তার মাঝে ধূলায়িত
সৌন্দর্য ঝাড়ের পাতাবাহারের বাগান
বন্ধ সরকারি অফিস ঘরে বিরক্তিকর
বেজে যাওয়া ঘুষপ্রদানকারীর টেলিফোন
আমরা এগিয়ে যাই অন্ধকারের পথ দিয়ে
বুক পকেটে বিশ্বাসহীনতার ঝিঁঝিঁপোকা
এসব যুবক বুকে শুয়ে থাকে কেবল
কিশোরী মন আর চপল মগজ।
জাতি ভোঁতা হলে ক্ষতি কী এমন?
বাবার রোজগার বন্ধ হলে
এভাবে ভাবতে বাধ্য হই
লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে কবিতার খোরখাতা
এসব ফরমালিন কথা মানায় না চুলোর হাঁড়িতে
কানে ভেসে আসে—
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’
পাগলের মতো ফিক করে হাসি চাপে
বিড়বিড় করে পথ চলি
তামাশার অপর নাম বুঝি স্বাধীনতা?
মুক্তি মানে কি ক্ষুধার্ত যাপন?
কেউ কি কখনো মুক্তি পায়?
এক মুক্তি থেকে আরেক মুক্তির দূরত্বের নাম—বন্দি!
গণতন্ত্রের আরেক উপাধী কৌতুক
কাঁদতে কাঁদতে দর্শক হাসি দেয়
ভুলে যায় প্রয়োজনের অধিক খুন!
বাবা বলতেন—ওরে বাপ
যেকোনো খুন ও খুনি সমান পাপী!
ভুলে যাই মায়ের কথা—
ঢোল কলমির মতো ভরে ওঠে দীর্ঘশ্বাস
আমাদের যেন একটাই কাজ
এইসব চামার সরকারের গোলামি করা!
পিতা বা স্বামী তোমরা কী শুনতে পাও
এসব বিকল মাইকের গান?
রাঙা মরিয়মের শাদা চুলের বয়ান
বয়স তহন আর কতো হবে? যদ্দুর মনে পড়ে, আট কি নয়। তোর দাদা কোলে কোরে নিয়ে আসলো আমারে। তহন আমি এট্টুখানি ফুটফুটে—পুতুলের মতো তুলতুলে। জানিস; আগুনের মতো লাল ছিলাম আমি! সবাই কতো—আমি নাহি দশ গিরামের সেরা বউ! কি কবো তোরে, যা ভাল্লাদো! তোরে কতি তো আর লজ্জা নেই। যেদিন তোর দাদার পান খাওয়া রাঙা ঠোঁট আমার চিকন ঠোঁটের উপর ভর কল্লো, লজ্জায় আমি চুন হলদি মিশানোর মতো কমলা হয়ে গিলাম। বুছতিছির ব্যাপার? কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেমড়ির শরীরে পূর্ণবয়স্ক দাদার ছোঁয়া কিরাম ভারী ছিলো? আমি যেন পিষে যাতাম, কিন্তু কিছু কতি পাত্তাম না। কিরাম এক আরামে ভাসে যাতাম। মনে ওতো ছোট খালের মধ্যি দিয়ে দাঁড় বায়ে যাচ্ছে কোন দক্ষ মাঝি। আর তার আঘাতে আঘাতে ছোট ছোট তিরতিরে ঢেউগুলো পাড়ে আছড়ে পড়তেছে। আমিও তোর দাদার বুকে নেতায়ে পড়তাম। কি রহম যে শিউরে উঠতো বুক! সারা দিন আর তোর দাদার কাছে আসতি পাত্তাম না। বেটা মানুষ এতো ফাজিল হবে ক্যান?
কি এক ঝড় আসলো দেশে। আমাগে হিন্দু বান্ধবীরা রাতের আন্ধারে বাড়ি নিয়ে চলে যাতো ভারতে। কচি মনে কি যে কষ্ট তহন। তা আর কারে কই। আব্বার কাছে কলি কতো—ওরা ওপারের মানুষ! জমি-জায়গা বদল করে চলে যাচ্ছে। যাক তাতে আর কার কি। যে যেকানে থায়ে সুক পায়, পাক না। বাপির বাড়ি গিয়ে কতো খেলার সাথীদের আর পালাম না। মনে পড়ে এহন, বিয়ের দিন বাপের বাড়ি ছাড়ার কি কষ্ট, দেশ ছাড়ার ঢের কতো না কষ্ট।
তারপর দেকতি দেকতি বয়স ওলো বাইশ। চারচারটে ছেলেপেলের জন্ম হলো। তোর দাদা কতো আমি ততই নাকি হাঁসের পালকের মতো নাদুসনুদুস টানের হচ্ছিলাম। আড়ালে পালিই জোর করে চেপে ধত্তো বুকির মধ্যি। ওর নাকি ইচ্ছে কত্তো আমারে বুকের মধ্যি ঢুকোয় রাখপে। তুই ক, তা কি হয়? মানুষরে আবার বুকের মধ্যি রাহা যায়? এহন বুঝিরে ও আমারে ব..হু…ত ভালোবাসতো। সেইরাম মনে কত্তো। সত্যি কি পুরুষ ছিলো তোদের মতো পাছ ছয় জনরে সে এক ঠেলায় ফেলে দিতি পাত্তো। কি বুকের পাটা। ওর বুক জড়ায় ধল্লি মনে ওতো পৃথিবী হাতের মুঠোয়। লজ্জা যে এতো মধুর হয় তা কি জানতাম? শোন তারপরের এক কতা—আমার এক গোপন ।
রোগ ওলো। না শাদা, না লাল। না কলার রস, না মেন্দির। আমি তোর দাদারে একদিন কলাম। সে কয়ার সাথে সাথে ভরত ফকির আর গোপাল ডাকতাররে ডাহে নিয়ে আসলো। ওরাও আমারে খুব স্নেহ কত্তো। আমার বাপের নাম শুনলি সবাই আমারে আদর কত্তো। সমস্যার কতা কলাম। আমারে কাঁচকলার আটার মতো ওষুদ দিলো। সেই যে ভালো অলাম আর ওসব রোগ দেখিনি।
একদিন দুপোর বেলায় তোর দাদা খায়ে-দায়ে পাজাকোলায় গেলো। নতুন ভাটায় আগুন দেবে। সেই যে আগুন জ্বাললো এখনো নিভলো না ভাই। দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো আমার কলিজা। যেন আমার প্রাণপাখি উড়ে গেলো। শুনিছি সতী নারীর পতি মরে। এরাম সতী অওয়ার কোনো দরকার আছে ক? কয়লার আগুনি যহন বেদনার বাতাস লাগে গনগনে হয়ে ওঠে অতীত স্মৃতি। মনে হয় মরে যাওয়া এর থেয়ে ভালো। কতো এ আগুন কিদে নিভায়? চোহের জলে নাহি নারীরা পাতলা হয়! ছাই হয়ে উড়ে যায় আহত ব্যথা! আমি হতি পাল্লাম না। এতো ব্যথা কি এতো অল্প জলে নেভে? নেভে… নেভেরে চোখের জলে অনেক ব্যথা নেভে কিন্তু নেভে না শুধো পতি মরার ছাতি। আমাকে রাখে চলে গেলো একটু বলেও গেলো না। সে যে ক্যানো আমারে রাকে গেলো? কতো কষ্টের সংসার ছিলো কিন্তু কি জানিস? ওর চোকেমুকে ফুটে থাকতো শিমুল ফুলের রাঙা হাঁসি। আমার চুলে থাকতো বসন্ত আর শরীরে বর্ষাকাল। আমারে নিয়ে কি যে কত্তো। ছেলে পুলে বড়ো হলো তবু তার পাগলামি গেলো না। বলতো ঘুমালি আমার বুকের উপর ঘুমাও।
ছেলেরা মানুষ ওলো। মেয়েরা চলে গেলো স্বামীর ঘরে। আমি আবার একা হয়ে গেলোম রে দাদা। সারাদিন একা একা বসে বসে পাছায় ঘা হয়ে গেছে। পা দুকোন অচল প্রায়। দেকতি দেকতি কম তো আর ওলো না। পচ্চাত্তর পার ওলো। আর বাঁচতি ইচ্ছে করে না বুজলি! কবে যে মরবো? মরার জন্যও অপেক্ষা কত্তি হয়। বড় পরিহাসে ভরা এই রহস্যময় কা- তায় না? খাতি শুতি সবকিছুতে শুধো জ্বালা আর যন্ত্রণা। ভাল্লাগে না বুজলি? কতো আর সহ্য হয় এরাম জীবন!
কান্তি কান্তি দাদীর হলুদ চোকের কোণায় জমে গেছে চিমনির ধোঁয়া!
- সিদ্ধ ধানের ওম: পলিয়ার ওয়াহিদ, প্রচ্ছদ : শতাব্দী জাহিদ, বইমেলা–২০১৬, দোয়েল প্রকাশনী, মূল্য : ১৩০ টাকা