কথা রাখিনি আমি
একদিন বৃষ্টিকে বলেছিলাম
ভিজিয়ে দাও পরিশুদ্ধ করো
বৃষ্টি ভিজিয়ে গেলো
পরিশুদ্ধ হইনি।
একদিন সূর্যকে বলেছিলাম
ভেতরটা আলোকিত করে যাও
সূর্য আলো ঢাললো
আলোকিত হইনি।
মৃত্তিকাকে একদিন বলেছিলাম
সহিষ্ণু করে দাও
মৃত্তিকা পরম মমতা মেখে দিলো
সহিষ্ণু হইনি।
বৃক্ষকে একদিন বলেছিলাম
আরও প্রাণময় সবুজ করো
বৃক্ষ সর্বস্ব উজাড় করে দিলো
প্রাণবন্ত হইনি।
যতবার কথা রেখেছে ওরা
ততবার কথা রাখিনি আমি।
কালের স্রোতে
সময় পাল্টে দেয় সবকিছু
বনপোড়া হরিণ বুকে ভয়ের পুটিলে বেঁধে
লাফিয়ে লাফিয়ে চলে;
এক আগন্তুক শঙ্কা তাড়া করে পিছু পিছু।
মাহুতটুলির যে সহিস ঘোড়ার পিঠে
চাবুক মেরে দৌঁড়েছে এতদিন;
সেও ক্লান্ত অবসন্ন এই অবেলায়।
অজন্তা-ইলোরার গায়ে গায়ে
যে চিত্রকল্প খোদাই ছিল
তাও উঠে এসেছে সিন্ধুর উপত্যকায়
ইন্টারনেটের মাকড়ের জালে
ঝুলে আছে সভ্যতার শিশির বিন্দু
সূর্যের আলোয় তারা হয়ে জ্বলে
রাতের আঁধারে
সময় পাল্টে দিচ্ছে সময়কে পলে পলে
স্বস্তির চাষাবাদ
ইদানিং দরজা খোলা রেখে ঘুমাই
জলে ধোয়া নির্মল বাতাস—
ফুসফুস ভরে দেয়।
ক্যালেন্ডারের পাতায় পাতায়
ফ্রেমে বাঁধা ছবিতে
শুকনো ফ্লাওয়ার ব্রাসে
দীর্ঘশ্বাস ঝুলে ঝুলে আছে;
লুণ্ঠিত বুকের পাঁজরের দীর্ঘশ্বাস
ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায়;
চরপড়া নদীর দীর্ঘশ্বাস
উজাড় অরণ্যের দীর্ঘশ্বাস
বন্ধ্যা জমিনের দীর্ঘশ্বাস
সেঁটে আছে দেয়ালে দেয়ালে,
বিষময় এই ঘরদোর
তাই দরজা খুলে শুই।
চোরছ্যাঁচড় যা খুশি নিয়ে যাক
টেনশন নেই;
নির্মলবায়ুতে ঠাসা আমার হৃদয়
কে লুটবে আর?
তাই স্বস্তির বালিশে শিথান দিয়ে
গভীর নিদ্রায় ভাসি
সবকিছু চলে যাচ্ছে ইঁদুরের দখলে
ঘরের ভেতর ইঁদুরের উৎপাতে অতিষ্ঠ
রাতে যখন শুবারঘর আঁধারে ডুব দেয়
তখন নেংটি ইঁদুর যেনো পাখা মেলে উড়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে।
দূর পাহাড়ের চূড়ায়; যে ঈগল চোখের কোঠরে শিকারের ছক
আঁকে ক্ষণে ক্ষণে
ঘাতক ইঁদুর ফন্দি আঁটে মনে মনে।
সুচতুর ইঁদুরগুলো রেকি করে ঘরময়
আমার গতিবিধির ভাষা মুখস্ত করে
কখনো তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে প্রকাশ্যে
বিদ্রোহ করে কিংবা বিদ্রূপ করে আমাকে।
ইঁদুরের সুচাগ্র ধাঁরালো দাঁতের কসরতে
ক্ষত বিক্ষত হয়—
জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথ কিংবা রফিক আজাদের
ভালোবাসার মলাটবদ্ধ বই
খামচে খেতে চায় মননের শুভ্র কানন।
ঘুমের সলিলে ভাসতে ভাসতে যখন অচৈতন্য শয্যাসঙ্গী
ওর নিথর দেহের গন্ধ শুঁকে শুঁকে
হামলে পড়তে চায় সুঠাম বক্ষের মাঝখানে
শালা বেহায়া ইঁদুর—
যে বাগানের মালি হয়েও প্রাণ ভরে
ফুলের সুবাস নিতে পারিনি
বজ্জাত ইঁদুর সেখানেও ভাগ বসায়।
ঘরে ঘরে ইঁদুরের উপদ্রব
দেশে দেশে ইঁদুরের আগ্রাসন
পৃথিবীটা একদিন ইঁদুরের দখলেই যাবে নাকি!
সাদাকালো রঙধনু
সেদিন বিকেলে ঝমঝম বৃষ্টি শেষে
অনঙ্গ মেঘ রোদের আলিঙ্গনে নিমগ্ন, অতপর
মেঘের প্রাচীর ভেঙে রোদ হেসেছিল।
ধনুকের মতো একটি রঙধনু
আমাদের মাথার ওপর ছাতা মেলে ধরলো
আমরা সেই ছাতার নিচে, নিজেদের সঁপে দিলাম।
ছাদে জমে থাকা বৃষ্টির জলে
পা চুবিয়ে চুবিয়ে রাজহংসের মতো হেঁটেছিলাম
রঙধনুর গা বেয়ে অবিরল রঙ ঝরছিল
তোমার দেহজুড়ে
চোখে-মুখে সে কী হোলি উৎসব!
সাত রঙের সাতটি স্বপ্ন বোনে
বেঁধে রাখলে শাড়ির আঁচলে
আর আমি, রংধনুটি পকেটে পুরে
ছাদ থেকে নেমে এলাম।
রঙ নাকি বর্ণচোরা হয়—বুঝিনি সেদিন।
এক রঙের সঙ্গে অন্য রঙ মেশালেই
মৌলিকত্ব হয় লীন
তেমনি তুমি আজ হারালে
বর্ণময় ভালোবাসার সতিত্ব।
বর্ষামঙ্গল
বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছ
এসো উঠোনে নামি
বৃষ্টির চেয়েও তোমার আটপৌরে শাড়িটা দামি!
নেমে এসো জীবনের উঠোনে
অঝোর ধারায় ভিজিয়ে নাও
রক্ত,হাড্ডি-মজ্জা,শিরা-উপশিরা, দেহের কোণে কোণে
ধুয়ে নাও
জীবনের ভুল-চুক গুলি।
বৃষ্টি কী শুধুই কান্নার চারুপাঠ
বিরহের দহন,কষ্টের অনল।
কান্নার নেই কোনো ব্যাকরণ—নেই প্রকরণ
পৃথিবীর চার তৃতীয়াংশ জুড়ে থৈ থৈ বর্ষার নাচন
তোমার জলজ দেহেও বর্ষার কাঁপন
আবহমান বাংলার হৃদয় জুড়ে কেবলই জলের গজল
নেমে এসো উঠোনে
পরিশুদ্ধ হই-বর্ষায় ভিজে ভিজে।
আখ্যান, দুই হাজার বিশ
দুই হাজার বিশের ক্যালেন্ডারটা একশ হাত মাটির নিচে পুঁতে রাখবো। যেন কোনোদিনই পৃথিবীর আলো ছুঁতে না পারে। এই ক্যালেন্ডারের পাতায় পাতায় শুধুই স্বজন হারানোর বিষাদ। দীর্ঘশ্বাসের ছড়াছড়ি। এই কালস্মৃতি তলিয়ে রাখবো বিস্মৃতির অতল সাগরে। কোনোদিনই যেন স্বপ্নের সুনীল সাগরে ভাসতে না পারে। অপয়া অলক্ষুণে এই দিনগুলো ঢেকে রাখবো পাকা ধানের গোলার তলায়, শালিকের ডানার নিচে, মিথিলার শাড়ির গোপন ভাঁজে ভাঁজে। ওর মুখ দেখবো না। হে প্রকৃতি, নিষিদ্ধ করো এই গ্রহণকালের ফিরে আসা পৃথিবীতে।
বিষময় বিষাদসিন্ধু মনে রাখতে চাইনে। শুধু চিরজীবিতরা তারা হয়ে আলো ঢেলো পৃথিবীর শুভ্র কাননে। মানুষ কেবলই ভালোবেসে যাবে নারীর শাশ্বত প্রেম—নদীর যৌবন—ফুলের হাসি-শালিকের গান
দেরাজবন্দি শার্ট
রক্তমাখা একটি শার্ট এখনো দেরাজবন্দি
মাঝে মাঝে খুলে দেখি
গন্ধ শুঁকি
বুকে জড়াই
জাপটে রাখি—খানিকক্ষণ।
এক অপার্থিব অনুভূতি বিদ্যুৎ চমকায়
টনটন করে শিরদাঁড়ায়;
শিরায় লাগে টান
মস্তিষ্কের কোষগুলোতে
বিক্ষুব্ধ সমুদ্র ঢেউ খেলায়
কখনো আকাশের মৌনতা ভেঙে
চিৎকার করে কতিপয় দাঁড়কাক,
রাতের গা চুইয়ে চুইয়ে
টুপটাপ ঝরে আলোর বর্ষণ
স্বপ্নের বুদবুদ ভেসে ওঠে
ভালোবাসার পদ্মপুকুরে।
বিজয়ের ছোপ ছোপ রক্ত
লেপ্টে আছে এ-ই শার্টে
সূর্যের দ্যুতি ছড়ায়
অনন্ত মহাকালে।
গুণীর গাঁ
কাল সারারাত স্বপ্নের হাত ধরে হেঁটেছি। হাঁটতে হাঁটতে আয়নানদীর পাড়ে এক প্রবীণ বটবৃক্ষের গোড়ায় বসলাম। এ গাঁয়ের নাম গুণীর গাঁ। শুনে আমি তো অবাক। এটা কি কবি নির্মলেন্দু গুণের পৈতৃক ভিটে? কী জানি! এই গাঁয়ের মানুষ; গাছঠাকুর আর নদীমুনির উপাস্য। পাকা ধানের শীষ কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, আমি গর্ভবতী হই বছরে তিন বার। সূর্যের আলো এসে হাত বুলিয়ে যায়, বৃষ্টি এসে স্নান করিয়ে দেয়, বাতাস শন শন বয়ে গান শুনিয়ে যায়, মৃত্তিকা চির যৌবনা এক ঋতুবতী নারী। ভাদাইলা পাতা লতাগুল্মের আসন বিছানো চারিদিক। রোগ শোক ব্যাধির প্রবেশ নিষিদ্ধ এই গাঁয়ে। প্রতিটি মানুষ যেন বৃক্ষমানব, প্রতিটি নারী যেন নদী। কবি নূরুল হুদার ভেষজমানব সঞ্জীবনীর সুধা পান করে করে হাজার বছর ধরে এই জনপদে। হঠাৎ আমার গা-ছুঁয়ে এক অপ্সরা বলে উঠল, ‘গুণীর গাঁয়ে থেকে যাও হে ভিনদেশি। আমৃত্যু তুমি যৌবনের দরিয়ায় ভাসবে।’
ঘড়ির অ্যালার্ম কর্কশ শব্দে শাসিয়ে উঠলো। ধড়ফড়িয়ে উঠি। গুণীরগাঁকে মনে জমা রেখে; অফিসে যাই।
দৃষ্টিভঙ্গি
তোমার বুকে মুখ রেখে—
শুধু গোলাপের গন্ধ শুঁকেছি
খুঁজেছি প্রেমের অলিগলি ।
অথচ আমার দেহ জুড়ে;
শুধুই রক্ত-মাংসের গন্ধ শুঁকেছ
খুঁজেছ সন্দেহের চোরাবালি।