আগুন
মা উন্দালে মাটিরসড়া চাপিয়ে
খই-মুড়ি ভাজেন,
ধানের খোসা ফুঁড়ে বকুলফুলের মতো
খই-মুড়ি ফুটে ওঠে,
এক কড়াই ভাজাফুলের গন্ধে
উন্মাদনা আমার চোখেমুখে!
উনুনে সেই-আগুনের আঁচ
আজো লেপ্টে আছে দেহ জুড়ে,
আগুনের আঁচে মায়ের শরীরের ঘ্রাণ শুঁকি;
আগুন ছিল জলের মতো
গায়ে প্রশান্তি মেখে দেয়।
সময়ের চৌকাঠ পেরিয়ে দেখি
চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা,
হৃদয়ে দহন
ধরিত্রীর দেহ জুড়ে দগদগে ঘা।
মা, আমাকে সেই আগুনের পরশমণি দিয়ে যাও
ঘুম
অনেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঘুমান
আমি ঘুমের জন্য ঘুমাই,
ঘুমের ভেতরে মৃত্যুর স্বাদ খুঁজি;
খুঁজি আমিহীন আমাকে-ই!
ঘুমের কাছে আমরা হেরে যাই
চূর্ণ হয় দম্ভ,
হেলে পড়ে মান-অপমানের নিত্তি
অহংকার-ক্রোধ-ক্ষমতা,
টি-টেবিলে গ্লাসে ঢেকে-রাখা জলের মত
পড়ে থাকে নীরব-নিথর দেহ।
ঘুমের কাছে আমারা হেরে যাই;
অথচ ঘুম ছাড়া মানুষ বাঁচে না!
প্রত্নপাঠ
একদিন হামাগুড়ি দিয়ে
গুহা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম
হাজার-হাজার বছর আগে,
আমাদের আগুন জ্বালানোর কলাবিদ্যা
চিত্রশিল্প, যূথবদ্ধ জীবনাচার, কামশাস্ত্র
সবকিছু ইতিহাসের কাছে গচ্ছিত রেখে।
পৃথিবীর আলো-বাতাসে এসে
পশুদের সঙ্গে পরিচয় ঘটল।
পশুদের ঘর-বাড়ি নেই, রাষ্ট্র নেই, পাসপোর্ট-ভিসা নেই।
পশুদের পরিধেয় নেই, শিক্ষা-কলা নেই, সমরাস্ত্র নেই।
পশুদের বিত্তবৈভব নেই, গণিকালয় নেই, ধর্ষণ নেই,
যোনিচ্ছেদে বাধা নেই, পরকীয়া প্রেম নেই,
ব্যাংক-বিমা নেই, সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি নেই, পরকালের মোহ নেই।
সর্বোত্তম জীব হিসেবে হোঁচট খেলাম
হিসেবের খেরোখাতায় বড্ড গরমিল!
একদিন আমরা
বৃক্ষের সান্নিধ্যে
সবুজ ছিলাম,
নদীর ভালোবাসায়
চিরযৌবনদীপ্ত ছিলাম;
স্বর্বংসহা মৃত্তিকার কোলে
পলিমাটি ছিলাম,
গুহার অন্ধকূপে
আলো জ্বালাতে শিখেছিলাম
জল
জল চাইতেই
মা এক গ্লাস অমৃতসুধা দিতেন,
ভালোবাসার দ্রাবক পান করে
প্রজাপতি হয়ে যেতাম, পাখি হতাম!
কৈলাশের হিম ছড়ানো জল
মরুবক্ষে নূহের প্লাবন ডেকে আনত,
মায়ের মাটিরকলস যেন
পাহাড়ি ঝর্ণার আধার।
আজকাল বোতলজাত খনিজজলে
তপ্ত গলিতলাভা পান করি!
চিলের ডানায় ভর-করে
মায়ের সেই মাটিরকলস খুঁজি
কফিন ঘর
দিন-রাতের কোনো ফারাক নেই
নেই কোনো ক্ষণমাপকযন্ত্র;
কতিপয় লাশের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে
ভোরের সূর্য ওঠে
কতিপয় লাশের অপেক্ষায়-থেকে
সন্ধ্যামালতি ফুটে,
তাই কফিন ঘরের কপাট থেকেও নেই!
কফিনের আছে কতো রকমফের
আছে জমকালো আভিজাত্যের ছাপ,
কফিনের ভেতরের লাশ জানে-না
দুনিয়াদারির খবর। সে তখন-
জর-নশ্বর, শুধু মানুষের-দায়
কফিনবন্দি লোকটি কালের শকটে
চড়ে, স্বজনের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে
মাটির ঘরে শয্যা-পাতে, সে-কি তা জানতো!
জীবনভর জৌলুসের দরিয়ায় ভেসে-ভেসে
কফিন শব্দটি-ই বেমালুম ভুলে গেছে সে
সময়ের রথে
কেউ একজন এসে আমাকে টাইম মেশিনে বসিয়ে যাও
ছুটে যাবো আজন্ম শৈশবে—ঘুড়ির মতো নয়,পাখি হয়ে
উড়ে-উড়ে। লাঙল-জোয়াল কাঁধে গাঁয়ের ঐ কাদামাটিজলে—
শস্যদানার হাসি দেখব। কামিনী ফুলের ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে
শিশিরধোয়া দূর্বাঘাসে গা ভেজাব।
কেউ একজন এসে আমাকে টাইম মেশিনে বসিয়ে যাও
গিলগামেশের রাজ্যে মহাকাব্যের পাতায় পাতায় খুঁজব
স্বর্গাভিযানের কাহিনি। নালন্দার পালি টোলে শিখব
জীবনের ধারাপাত। সক্রেটিসের হাত ধরে বাতি নিয়ে
হাঁটব আঁধারের আলপথে।রবিঠাকুরের শোবার ঘরে
ফুলদানিতে ফুল সেজে নেব রবি-রশ্মি।
কেউ একজন এসে আমাকে টাইম মেশিনে বসিয়ে যাও
মহাভারতের ব্রাত্যজনদের সঙ্গে গলাগলি করব,
চে’র সান্নিধ্যে গহিন অরণ্যে আয়েসে চুরুট ফুঁকে-ফুঁকে
বুকের পাঁজরে সেঁটে নিবো বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ
চুমু খাবো মার্ক্সের সমাধি বেদিতে।
কেউ একজন এসে আমাকে টাইম মশিনে বসিয়ে যাও
ক্লিওপেট্রার বুকের ঠিক-ভাঁজে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকব,
আফ্রোদিতির যৌবনের মৌবনে আমৃত্যু থাকব ক্রীতদাস!
দ্রৌপদীর দেহ জুড়ে জড়িয়ে দেবো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার
কাচস্বচ্ছ মিহি ঢাকাই মসলিন