আহা চট্টগ্রাম! তোমার দখিনে জলের তরঙ্গে
খেলা করে কত সঘন সমুদ্র, যেন জলকেলি
কোনো যুগলের, একে একে মাখে তারা সারা অঙ্গে
সমুদ্রের বুহুবর্ণা রূপ। জলে ফোটা জলজ চামেলী
ছড়ায় সৌরভ বাতাসে বাতাসে নীল দ্রাঘিমায়
খাঁজকাটা মৃত্তিকার বলিরেখা তলে জড়াজড়ি
মুক্তাভরা ঝিনুকের। তারপর ধুসর সন্ধ্যায়
হেঁটে যায় বুকে দিয়ে ভর, লাল সমুদ্রশর্বরী
শঙ্কচিল পানকৌড়ি পান করে জলের স্বনন
ফুরফুরে উড়ে অন্তরীক্ষে শব্দহীন নির্বিকার
কুলে ধেয়ে আসা ঢেউ, তারপর আত্মসমর্পন
দেখে শুধু নেচে উঠে আলোধৌত সমুদ্রের পাড়।
আকাশের বেদীমূলে জলের চুড়ায় জনপদে
অতল অমল সমুদ্রের সকরুণ আর্তস্বর
শোনা যায় গোধুলীতে পৃথিবীর শান্ত ছায়াহ্রদে
সেতারের চনমনে নৃত্যগীত, অজর অমর।
শোকাতুরা তুমি, বিরহের ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুকণা
শীতের পাতার মতো ঝরে পড়ে সাগরের জলে
বিক্ষুদ্ধ সুনামী দেবী মাঝে মাঝে তুলে ক্রদ্ধ ফনা
তেড়ে এসে ঘাড় ধরে নিয়ে যায় সাগর অতলে
অনঙ্গঅভঙ্গ দেহে নেচে ওঠে কুহুক ফেনিল
নীলতিমি অসহায়, কাঁদে কত হাঙর কঙ্কাল
জলের উচ্ছ্বাসে ভরা হায়েনারা হাসে খিল খিল
তবুও মানুষ পান করে সামুদ্রিক মায়াজাল।
জলের বিবর হতে উঠে আসা তুমি হে নগর
সুধাজলধী তুমি জলজ সংহিতা, উদভ্রান্ত
সলিলের রেনু, নির্ঘুম নিশিতে বাজাও মর্মর
জলের ঝালরে তুমি বন্ধু অপরুপ চন্দ্রকান্ত
হৃদয়কার্নিশে ঝুলে থাকা ভারাক্রান্ত ঝুলকালি
ছাপ করে দাও মূর্ত মহিমায় অম্ল শুভ্রতায়,
উপকূলে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে চিক চিক বালি
মনিমরকত যেন জ্বলে উঠে হিমেল জোস্নায়
আহা কী অমেয় শিহরণ নীলাম্বরি জলরাশি
বিথানে রজত ঢেউ,ভাঙা-খেলা পাহাড় বিচূর্ণ
হীরকের দ্যুতি নিয়ে জ্যোতিষ্মান অমৃতের হাসি
জগতের সব রুপ চুরি করে তুমি পরিপূর্ণ
দুরের নাবিক দেখে কোমলাকুসুম ঘুম ঘুম ছায়া
ভয়ঙ্কর তুমি সুন্দরতম, হে জলজ কানন
কালের কারোটি হতে ঝরে পড়ে সমুদ্রের মায়া।
গৌরবে ভাস্বর তুমি চিরন্তন শুভ সত্য তুমি
মানসসুন্দরী হে সজল শূপর্নখা সমুজ্জ্বল
তোমার সান্নিধ্যে পেয়েছে পূর্ণতা চট্টভূমি
তুমিতো উদ্ভাস, তুমি প্রজন্মের হৃদয় ফসল।
উত্তমাশা অন্তরীপ নয়, পতেঙ্গার নুন মাখা
সজীব বাতাস দেয় স্বস্থি অন্ধ অবেগের মতো
নিয়ে আসে দুর হতে প্রেয়সীর প্রিয় আঙরাখা
উলঙ্গ সৈকত ধুয়ে দেয় সব বিষময় ক্ষতো।
তোমার বিশাল উদারতা দাহদীর্ন তপ্তমনে
আনে শান্তি রৌদ্রনীল পালকের শুদ্ধতায়
ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরের আয়োজনে
ভোরের পাখিরা মেলে ডানা সীমাহীন মুগ্ধতায়।
কী মহাগর্জন! বেদনা বিদুর কান্না বিহবল
আরক্ত আবহে ভরা সমগ্র অন্তর। প্রশান্তির জল
কল কল করে গেয়ে যায় তবু উপকূল চট্টলায়
জ্বলে উঠে সেই রূপালি করোটি অজস্র বিভায়
নেই রাত নেই দিন অবিরাম অনুপম গান
যেন রমনীয় এক ভারাক্রান্ত কুসুম বিতান
ঝরে কুঁড়ি, জলে ঝরে পড়ে শিশিরের শুভ্রকণা
জোছনার মায়াভরা রাত কারা আঁকে আলপনা
থমকে দাড়ায় কোন সোহাগিনী দুয়ারে তোমার
কোন অভিসারে উতাল পাতাল জলের জোয়ার
বাড়ে হৃদ কম্প! ফুসে উঠে জল কাহাদের টানে
কোন কথা বলে যায় চুপিচুপি বাতাসের কানে
সে কথা কী জানে চাঁদ? বলো তুমি ওহে সুদুরিকা
কেন তুমি অনন্তর বুকে জ্বালো রজতের শিখা
কার শোকে অন্তরালে কাঁদো তুমি হলুদিয়া পাখি
ভালোবেসে চেয়েছিলে দিয়ে যেতে কার হাতে রাখি
গোপনে গোপনে কুমুদ কল্লোল বনে দীপ্যমান
উদাসিনী তুমি গর্ভে ধরো কত সমুদ্রসন্তান
আশৈশব লড়াই করে ঝড় আর ঝঞ্জার সাথে
বেঁচে থাকে অদম্য সাহস নিয়ে কৃষ্ণকায় রাতে
কখনো অসীম স্নেহ, নাও কোলে মাতৃত্বের বোধ
কখনো অচ্ছুৎ ভেবে ছুড়ে ফেলে নাও প্রতিশোধ
উলম্ব উচ্ছ্বাসে উড়ে উলুখড় কূলে উপকূলে
প্রচণ্ড আক্রোশে জল প্রতিদিন উঠে ফেঁপে ফুলে
দুর্নিবার শক্তি নিয়ে ধেয়ে আসে শুভ্র ফেনা রাশি
দাঁত গুলি যেন তার শাঁখের করাত, অবিনাশী
ঢেউ মহাঢেউ তরলপাহাড়, মহাতোলপাড়
কিশোরী কুন্তল কাঁপে, কম্পমান কেতকীর ঝাঁড়
সামুদ্রিক লতা-তরু-গুল্ম! পাখির কেশর কাঁপে
সূর্য বৃক্ষ শাখে আর আন্দোলিত জলের উত্তাপে
হে সমুদ্র! হে আমার উপকূলবর্তী রত্নাকর
তোমার বুকেই বাঁধে সন্তানেরা সব বাড়িঘর
কি অজানা আকর্ষনে ঋদ্ধ! কি পুলক শিহরণ
অতল রহস্য ঘেরা বালা, যেন জলমগ্ন মন
দোল খায় জলে ছোট দ্বীপগুলো ভাসে আর হাসে
নিদ্রাহীন নীহারিকা চেয়ে থাকে বসে নীলাকাশে
উড়ে মাছ রঙ পাখি সারাদিন সামুদ্রিক মাঠে
ফিকে হয়ে এলে সূর্য রঙ ভীড়ে দ্বীপের তল্লাটে
চপলা কিশোরী দেয় ঝাঁপ জলে পরম আনন্দে
দেখে তুমি ঢেউ হয়ে নেচে ওঠো অনাবিল সন্ধ্যে
জলজ বধুয়া লাজ নম্র জল রঙ শাড়ি পরে
গায়ে মেখে শুটকীর ঘ্রাণ প্রতীক্ষায় থাকে ঘরে
কখন ফিরিবে তার প্রাণপ্রিয় মৎস্যজীবী স্বামী
বধুর কাটে না সেই ঘোর, সূর্যদেব অস্তগামী
ভাসে মনে তার ভয়াল রাতের কত শোকস্মৃতি
মেঘের জটলা পূর্বাকাশে! বধুয়ার মনে ভীতি।
হে সাগর! হে ত্রিকালস্পর্শী সহস্রবর্ষী সাধক
তিমিরে জ্বালাও তুমি ক্ষুদ্রপ্রাণে আশার চেরাগ
ত্রিকালজ্ঞ তুমি কৃষ্ণসম মহান বংশী বাধক
তোমার পরশে মুছে যায় হতাশার কালো দাগ
দেখেছি তোমায় সোনা দিয়া দ্বীপে শুটকী মাকানে
কোরাল মাছের রক্তে ভেজা সামুদ্রিক জনপদে
চেতনা ভাস্বর কবি মননে জলের কলতানে
বাজে কতো নম্র সুর মর্মরিত অজানা দ্বৈরথে
প্রবাল প্রাচীর ঘেরা শৈবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন
নারিকেল বৃক্ষশিরে বিগলিত স্বর্ণশোভা দিন
নরোম আলোকে শুধু মুখরিত শিকারীর ঘর
দ্বীপ নয় যেন এক সুপ্রাচীন জলের নগর
সহস্র ধীবর ছুটে অহরাত ট্রালারে সাম্পানে
জলের উষ্ণতা নিয়ে চলে জীবন ভাটা উজানে।
ভোর নামে পৃথিবীতে, সাগর অতল হতে উঠে
নতুন সুরুজ এক, দ্বীপবাসী জাল নিয়ে ছুটে
যায় জিবিকার খোঁজে দুর থেকে আরো বহুদুরে
ডাকে আনন্দের বান তৃনে ঢাকা ক্ষুদ্র দ্বীপ জুড়ে
ধরা পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সোনা জেলেদের জালে
মাছ হল জীবনের নাম। ঢেউয়ের তালে তালে
ফিরে আসে সোনা ভরা নাও স্তব্দ গোধুলীতে
জল কেটে নামে রাত পুনর্বার এই পৃথিবীতে
এখানে পৃথিবী মানে লালদিয়া ছোট বালুচর
এখানে যায় না শোনা অন্যসব পৃথিবীর স্বর
পৃথিবীর সপ্তচার্য প্রাকৃতিক নিদর্শনে ভরা
প্রত্নের ফসিল, বিধাতার কারুময় হাতে গড়া
দীর্ঘতম সামুদ্রিক তট। যদি খুলে তার দ্বার
অপার নিসর্গ নিয়ে ছুটে আসে দখিনা জোয়ার
তারপর বালুচরে মিশে যায় নুনমাখা জল
অনুভবে প্রতিদিন জ্বলে উঠে স্মৃতির অনল
চাহেনা নিভিতে তাহা যতটুকু লেগে থাকে মনে
বিক্ষুব্দ তরঙ্গ তলে চিত্র আঁকা সমুদ্র স্বননে
অনিবার খেই হারা পথভোলা দুরাগত পাখি
ঝাপটায় ডানাগুলো। কেঁপে উঠে সুরা শূণ্য সাকী
রোদের সুবর্ণ চিহ্ন মুছে ফেলে পশ্চিমের কোণে
শিল্পীর নন্দন হাতে গোধুলীরা স্বপ্নজাল বোনে
অবাক লালিমা নিয়ে ধীরে ধীরে জলের অতলে
ডুবে যায় আলোর প্রদীপ। পৃথিবীতে সন্ধ্যে হলে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বেলভূমে অপরূপ দাগ
বিরহ কাতর কতো প্রেয়সীর অন্ধ অনুরাগ
মিলায়না কোন দিন। তেপান্তরে দিগন্তের গায়ে
অপূর্ব পড়ন্ত বেলা কারা যেন ধরেছে জড়ায়ে
কূয়াশার জাল ছিড়ে আকাশ নীলিমা হতে ঝরে
পড়ে জোছনার মায়াবী কুসুম শুভ্র বালুচরে
যতটুকু চোখ যায় আলোর নুপুর শুধু বাজে
বিষণ্ন বদন কার লাল হয় আরক্তিম লাজে
আহা কত রূপ তার নীলাম্বরী বধুয়া আমার
ঢেউ হয়ে কূলে এসে ইশারায় ডাকে বার বার
চট্টলা সমুদ্র তলে ঝিনুকের পাশাপাশি পড়ে
থাকে মুক্তো, পড়ে থাকে প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা, নড়ে
উঠে সব গুলো ঠোট অতলে অদৃশ্য অপরূপ
খেলা চলে নিসর্গের, প্রতিদিন থাকি আমি চুপ।