শ্রীলেখা
শ্রীলেখা উনচল্লিশেও অবিবাহিত
দুবার বিবাহের সম্ভাবনা জেগেছিল
একবার তেইশে; ছেলের পছন্দ হওয়ায়
শ্রীলেখার বাবা-মা হাফ-ছেড়ে বেঁচে ছিল,
শ্রীলেখার পছন্দ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি;
শেষ পর্যন্ত হলো না। কোন বড় ব্যাপারে
বিয়ে ভাঙ্গেনি; খুবই মামুলি ব্যাপার।
বরপক্ষের তেমন কোন আবদার ছিল না
শুধুমাত্র একটা স্কুটার। কৃষি কর্মকর্তা ছেলে
মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে হয়, মাঝে মাঝে
এখানে সেখানে যেতে হয়; একটা স্কুটার
হলে ব্যাপক সুবিধা। মেয়ে অসুন্দর
ব্যাপার না, স্কুটার এই কমতি পুষিয়ে দেবে।
মেয়ের রূপের মত বাবাও বর্ণহীন;
অর্থাৎ দরিদ্র, স্কুটারের টাকা জোগাড় করা
সম্ভব না। স্কুটার বিহীন কন্যায় বরের পোষাবে
না; বিয়ে হলো না। পরেরবার একত্রিশে,
বিপত্নীক বর; পানের বরজ আছে
আয়-রোজগার মন্দ না। বিয়ের সব কথা পাকা,
স্কুটারের বায়না নেই শুধু ঘরের কাজকাম
জানা হলেই ছেলের চলবে। শ্রীলেখা কাজেকামে দক্ষ,
ঘরের সমস্ত কাজ এক হাতেই সেরে ফেলতে পারে।
এ বিয়েও শেষ পর্যন্ত বিয়েতে গড়াল না। বিপত্নীক
মত বদলে ফেলল। কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেল
আরেকটু কম বয়সী সুশ্রী পাত্রী পেয়ে গেছে।
বিয়ের সম্ভাবনা মিটে যাওয়ার শ্রীলেখা ঘরের
কাজের অতিরিক্ত অন্য আজে মনোযোগ দিতে
চেষ্টা করল, মাটি দিয়ে বানানো পুতুল
মানুষের শোকেসের শোভাবর্ধন করতে লাগল।
বছর খানেকের মধ্যে স্কুটারের টাকা জমা
করে ফেলল। স্নো পাউডার অন্যান্য প্রসাধনী
ব্যবহারের ফলে শ্রীলেখার শ্রীহীন রূপে শ্রী ফিরতে
শুরু করল। পাঁচ বছরের মধ্যে আপাত শ্রীহীন শ্রীলেখা
আকর্ষণীয় নারী হিসাবে রূপান্তরিত হল।
ততদিনে বয়স এবং অভিজ্ঞতায় শ্রীলেখা
বুঝতে পারল বিয়েই নারীর জীবনের লক্ষ্য নয়।
উনচল্লিশের শ্রীলেখা আজ একজন সফল নারী
কয়েক ডজন স্কুটার তার উঠানে হাটু গেড়ে থাকে,
অসংখ্য সুদর্শন তরুণ আজ তার পাণিপ্রার্থী।
কাজ শেষে প্রতিদিন শ্রীলেখা ঘরে ফিরে, ঘষে ঘষে
মুখ থেকে ফাউন্ডেশন তুলে। আয়নায় নিজেকে
পরখ করে, পুরনো শ্রীলেখাকে খুঁজে;
একটা স্কুটারের অভাবে যার বিয়ে হয়নি।
হারাধন
প্রতিদিন কিছু না কিছু হারিয়ে যায়;
গত বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রীর উপহার
হাতঘড়ি, সময়ের বেখেয়ালে
কোথায় যে হারিয়ে গেল;
ঘড়ির জন্য কাতর ছিলাম
তবু স্ত্রীর তীর্যক তীর থেকে
রক্ষা পেলাম না। অবহেলা;
তার, তার উপহারের প্রতি
ব্যাপক অবহেলা।
জন্মদিনে মেয়ে ছাতা উপহার
দিয়েছিল, বাবার মাথায় বৃষ্টির
ফোঁটা দাপট দেখায়। তীব্র রোদে
চামড়া ফেটে যায়। বাবার
বিড়ম্বনায় মেয়ের মায়ার উপহার
সেও হারিয়ে যায়। যত বলি
নিয়ে যাইনি ঘরে কোথাও আছে;
বিশ্বাস করে না, হারানো বাতিকের জন্য
বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়।
ছেলেকে নিয়ে চার লাইনের পদ্য
লিখেছিলাম, খুশি হয়েছিল।
প্রথম রোজগারে লেখক বাবার জন্য
কলম কিনেছিল, দামি কলম।
লেখকের জন্য গৌরবের উপহার
কপালের ফেরে সেও হারিয়ে যায়।
ছেলের কাছে মুখ দেখাতে
লজ্জা লাগে। ছেলে অবশ্য মহৎপ্রাণ;
পুনরায় লেখক বাবার মর্যাদা
রক্ষায় অবতীর্ণ, পুনরায় দামি কলম।
প্রতিদিন কিছু না কিছু হারিয়ে যায়
তেরশো কবিতার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেছে।
রবীঠাকুর, জীবনবাবুর পরে জানান দিতে
তৈরি পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেছে। পাড়ার
সাহিত্য আড্ডায় পঠিত হবে বলে
নিয়ে গিয়েছিলাম, প্রশংসা উত্তর
বেলুনের মত ফুলতে ফুলতে ঘরে
ফিরে দেখি পাণ্ডুলিপি হাপিস।
তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হদিস পাইনি।
পাড়ায় নতুন কবি আবির্ভূত হয়েছে
নতুন ধারার কবিতা প্রসব করে সবার
নজর কাড়ছে। পড়ে মনে হয়
কবিতা গুলো আমার লিখনি।
প্রমাণের অভাবে হাত কামড়ানো
ছাড়া কিছুই করতে পারি না।
প্রতিদিন কিছু না কিছু হারিয়ে যায়
হারিয়ে ফেলেছি বেদনার কবি জীবন।
তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম
দিদির নাম মল্লিকা ছিল না কিংবা
মল্লিকা-ই, নামের হেরফেরে ঘটনা বদলায় না
কাজল পড়া গাঁয়ের বধুর সৌভাগ্যটুকু
জোটেনি তার ভাগ্যে, দূর আকাশের
তারাও মনে রাখেনি, মুছে গেছে;
নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে আমাদের মল্লিকাদি।
এক চিলতে বারান্দার কোনে
ইজেলে এক মনে ছবি আঁকত দিদি।
নিজের জীবন ভাল করে বুঝে উঠার
আগেই ইজেলের মলিন ক্যানভাসে
সেঁটে গেল তার ছবি, সময়ের কষাঘাতে
মরে গেল ইজেলের রঙ। বিবর্ণ
কাঠ ক্ষয়ে ক্ষয়ে উনুনের আগুন হল;
পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করল মল্লিকাদির জীবন।
সাড়ে দশ খুব বেশি রাত নয়;
মফস্বল শহরের জন্য অবশ্য একটু বেশি।
শহরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা
আবৃত্তি শেষে একাই ফিরছিল। সাড়ে
বারোটায় ঘর থেকে উনপঞ্চাশ ফুট দূরত্বে
আহত অবস্থায় পাওয়া গেল, হাসপাতালে
ডাক্তার বলল ধর্ষিত। ভাল ঘরের মেয়ে
এত রাত বাইরে! প্রতিউত্তরে নিশ্চুপ
মুখ। ডুমুর গাছের ডালে মল্লিকাদি
যখন ঝুলছিল; হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।
এখন রঙচঙ বড় শহরে থাকি। মফস্বল
ছেড়েছি কয়েকজন্ম আগে। পরিবারের
লজ্জা। মল্লিকা নামে আমাদের পরিবারে
কেউ ছিল না। আমার দিদির নাম মল্লিকা নয়।
তাকে আমরা ভুলিনি। মফস্বল ছাড়ার পূর্বে
ডুমুরের গাছ আমরা কেটে ফেলে ছিলাম।