শৈশবের আলো-ছায়ায় পনেরোই আগস্ট
বন্ধু, জীবনের অঙ্ক আর মানসাঙ্কের ফলাফল নির্ণয়ে
প্রতিদিন ব্যস্ত সময়ের নিষ্ঠুর সহযাত্রী আমরা।
দীর্ঘসময় বাদে তোমার মুখ আজ অস্পষ্ট প্রায়,
কখনো কখনো তা হিমায়িত বরফের তলদেশে পৌঁছে যায়…
মস্তিষ্কে ধারণকৃত মেমোরি উষ্ণের মাত্রায় বরফ গলে গেলে
ফেলে আসা কিছুদিন উঁকি দেয়, ভালোবাসা হয়ে।
আজ তোমাকে মনে পড়ে গেলো।
কী অদ্ভুত! দেখো,
তোমাকে মনে আসতেই কেমন স্পষ্ট হলো
রায়পাড়ার সেই রাস্তা-ঘাট, পুকুর-মাঠ।
যেখানে আমাদের দূরন্ত শৈশবে
মাটিতে লাটিম ঘোরানো,
আকাশে ঘুড়ি ভাসানো আর
বৃষ্টির ছন্দে ডুব সাঁতারে পুকুরের জলে কত যে জলকেলী…
বন্ধুরা কে কোথায় আছে জানা নেই তোমার আমার।
কেন যে শৈশব এই মধ্যবয়সে এসে
প্রায়শ তাড়া করে নিয়ে যায়!
জীবনের প্রথম স্কুল ইকবাল নগরের
শ্রেণী শিক্ষক সুনীল স্যারের পিতৃস্নেহ,
রাজিয়া ম্যাডামের দ্বরাজ কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে
বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া।
একদল সমবয়সী শৈশব বারবার মনে করে দেয় বন্ধু জিল্লুকে
একটু বেশি দুরন্ত আর হাতচলা স্বভাবের ছিল সে।
সাদীর কথা মনে আছে নিশ্চয়,
ও ছিল ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত আর
ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের।
ওপর ক্লাসের মজিবর ভাই—
আমরাই ওর বন্ধু ছিলাম।
মনে আছে, একবার ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে
দোতলা থেকে পড়ে গিয়ে
অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া মজিবর ভাই
ভোঁ-দৌড় দিয়ে সকলকে আতঙ্কিত আর অবাক করে
পাঁচ পয়সার আইসক্রিম খেতে খেতে
ঘুড়ি ওড়ানোর নেশায় আবার তার ফিরে আসা?
সে গল্প এখনো বন্ধুদের সাথে আড্ডায় জুড়ে দেই অবাক বিস্ময়ে!
সোহেল তোমার কি মনে পড়ে, লোপার কথা?
তোমাদের বিল্ডিংয়ের ঠিক পাশের বিল্ডিং ছিল ওদের।
আমার প্রথম স্কুলে যাওয়ার সাথী ছিল সে।
আমাদের শৈশবের আর একজন
অসম লিঙ্গের বন্ধু পানসি।
কোন ভাসানে সে উড়িয়েছে পাল,
কেমন আছে সে, খোঁজ রাখিনি কতকাল!
সেই শৈশবেই আমরা তাদের আলাদা ভেবে
পার্থক্য গড়ে ফেলেছিলাম—
নারী-পুরুষের সহজাত নিয়মে।
আমরা যখন আর একটু বড় হলাম
তখন ওদের মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল
নারীত্বের আকর্ষণ লজ্জা!
সেই থেকেই ওরা
আমাদের দলছুট হতে শুরু করলো ধীরে ধীরে
অথচ, আমরা তখন অনেক বেশি
অনুভব করতে থাকি তাদের।
তারার কথা শুনেছি,
আধ্যাত্মিক সাধক হয়েছে আগেই।
শৈশবেই সংসার থেকে হারিয়ে যাওয়ার অভ্যেস ছিল তার।
ঘরের মায়া তারাকে আবদ্ধ করতে পারেনি কখনো।
তারার বোন মোস্তারী, রোগাটে আর
খিটমিটে ছিল খুব; শুনেছি
বেশ সুখে আছে স্বামী-সন্তানে।
জিল্লুর ছোট ভাই তাবির
দুর্ঘটনায় চলে গেছে বেশ কিছুদিন!
ওর দুষ্টুমিটা ভীষণ মনে পড়ে।
এইসব কথা মনে করতে করতে
স্মৃতির শরীরে আবার বরফ জমে হিমঘরে চলে যায়।
কখন যে কার ঘরে খেতাম,
কার মা যে নিজের মা হয়ে যেতো
বুঝতেই পারতাম না।
সেইসব মায়েরা কেমন আছেন?
সে কথা আমাদের জীবন অঙ্কের যুদ্ধে নতুন সমীকরণে-
ফিরিয়ে আনার ফুসরত মেলে না!
রায়পাড়ার প্রথম বন্ধু জীবনের সেইসব কথারা
ঘুড়ি খেলার মতোই কাটাকাটি হয়ে
ভোঁকাট্টা হয়ে গেছে অঙ্কের বেহিসাবে।
কিন্তু তোমার নিশ্চয় মনে আছে,
সেই পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টের দিনটি!
দিন তাকে বলা যায় না!
সে দিনের সূর্যটার কথা কোনোভাবেই
মনে করতে পারি না—
কেমন যেনো সুবেহ্ সাদিকের মতো!
না আলো—না অন্ধকার!
তবে হৃদয়কে ঢেকে দেয়া একটা দিন ছিল সেদিন।
রেডিওতে শুনেছিলাম প্রথম প্রিয়জনের মৃত্যু সংবাদ!
রাস্তায় যাওয়া বারণ ছিল,
সেদিন আমাদের শৈশব অবরুদ্ধ ছিল—
মায়ের আঁচলে অজানা শঙ্কায়!
মায়েদের আঁচল গড়ে কিছু অশ্রু
আমাদের মাথাকে ভিজিয়ে ছিল ভালোবাসায়।
হন্তারকের হুঙ্কারধ্বনি সঙ্কুচিত করেছিল
আমাদের শৈশবের আকাশ, খেলার মাঠ আর অলি-গলি।
চারিদিকে হন্তারকের আদেশে
সবুজ পোশাকের কারফিউ। কী অদ্ভুত!
আমরা ঘরবন্দি সদ্য স্বাধীন দেশে!
সেই মস্তিষ্কের ধারণকৃত কারফিউ
আজো হায়েনার চিৎকারে
ঘুরপাক খেয়ে যায়-বেলা-অবেলায়।
অঙ্ক-হিসাবের স্নাতকোত্তর করেও
সে অঙ্ক কিন্তু আজও মেলেনি!
বন্ধুরা কেউ কেউ হিসাবের ভুলে
মিশে গেছে হায়েনার মিছিলস্রোতে
সবুজ পোশাকের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা
গোয়েবলস সূত্রের নতুন নিশানায়।
বড় কষ্ট হয় বন্ধু, রায়পাড়ার সেই জীবন্ত রাস্তায়
কালেভদ্রে পা পড়লে
যেমন ফিরে পায় শৈশবের দুরন্ত ঢেউ দোলানো সাম্পান,
তেমনি মুখোমুখি হতে হয় সূর্যের আলোহীন এক সকালের—
উত্তরহীন সমবেত প্রশ্নের।
আমাদের প্রিয়জন হারানোর বেদনা
সুবেহ সাদিকের মতো; শেষ হয় না
আলো অন্ধকারের এক দীর্ঘরাত্রি।
সেখানে তুমি, আমি, আমাদের বন্ধুরা
ছায়া-আঁধারির বরফাদ্রিত হীমমস্তিষ্কে অপেক্ষারত।
বন্ধু, কখনো কি এক সূর্যসকাল
তার মায়াবী উষ্ণতা দিয়ে খুলে দিবে,
হিমঘরে জমে থাকা
আমাদের এইসব বরফ মস্তিষ্কের মেমোরি?
আর ভেঙে দেবে কি, মস্তিষ্কের ধারণকৃত সেই কারফিউ?
আরও পড়ুন: উত্তরবাঁকের মেঘ ॥ মোহাম্মদ নূরুল হক