অন্ধ বিড়াল
অন্ধ বিড়াল এসে প্রতিদিন দুধ খেয়ে যায়
এ-বাড়ি ও-বাড়ি হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত দুপুরে
ডুমুর গাছের নিচে চুপ করে বসে থাকে
অনুমানে গন্ধ শুঁকে-শুঁকে মাথা নাড়ায়।
দিনের আলোয় ঝকমকে সূর্যের রোদে
অথবা রাতের বেলায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে
ঝড়-বৃষ্টি প্রহারের ভয় ছাপিয়ে বিড়াল—
গৃহিণী রাখেন যে দুধ—সেখানে যায়।
শুনেছি বুড়ো এক লোক আমাদের পাড়ায়
রেখে গিয়েছিল শাদা এই জন্মান্ধ বিড়াল
কোনো কারণে দুধ কমে গেলে সকলে বলে—
অন্ধ বিড়াল এসে প্রতিদিন দুধ খেয়ে যায়!
কৃষ্ণ বুকের চাতালে
কুয়াশার শাড়ি পরে বসে আছে দূরের সবুজ
কে এসে খুলে নেবে ঘোমটার ভাঁজ
ভেতরে অঢেল জোনাকি স্রোতের ইশকুল
নামতার মতো ফোটে মহুয়ার ফুল।
হাতের রেখার মতো জেগে আছে ঘাসপত্র
আর রেখাচিত্র আঁকা দেখো পাথরের গুহায়
প্রযত্নে সবুজ রেখে বিলি করো পাতাঝরা দিন
কৃষ্ণ বুকের চাতালে জমছে প্রণয়ের বীজ…
কে তাকে পরাবে নিষেধের বেড়ি?
শেকলে বাঁধবে তার প্রাণের তাবিজ!
রোজ এসে ফিরে যায় পাখিডাকা বিকেলের রোদ
মরা বৃক্ষে লেগে থাকে সবুজের ওম—
দোয়েলের ঠোঁটে ভাসে অবিনাশী শিস
তাক করে আছে কোনো শিকারির তীর?
কুয়াশার শাড়ি পরে বসে আছে দূরের সবুজ
কপালে দিয়েছে এক ছোট লাল টিপ।
ছায়াটি কোথায় গেলো
আমাকে দাঁড়াতে বলে ছায়াটি কোথায় গেলো
রোবটের স্নায়ু থেকে খুলে নিয়ে নাট
পাতার রেলগাড়িতে চেপে নিরুদ্দেশ হলো!
কতক্ষণ হলো হাতে ধরে আছি নিজেরই প্রাণ…
আমার অন্ধকার প্রিয় বোন এতক্ষণে আলো জ্বেলে
মাঝপথে এসে রাঙিয়েছে চোখ—
এই গভীর রাতে আর কত সময় দাঁড়াবো বলো?
ছায়াটির হাতে ঘড়ি থাকতেও নেই কি কাণ্ডজ্ঞান!
ঘন মেঘ কেটে গেলে পূর্ণিমা আলোয়
ছায়াটি এসে আমার পাশে দাঁড়ালো।
ছবি
চিকন ভ্রূর নিচে শুয়ে আছে মেঘের কার্নিশ
তার নিচে সমুদ্রের তলদেশের মতো গভীর দুচোখ
আর স্বপ্নের সার্কাসে দুপায়ে দৌড়াচ্ছে ঘোড়া…
হাতের মুঠোতে গুমরে মরছে সোনার তাবিজ!
বৃক্ষের শরীরজুড়ে জড়িয়ে আছে পরজীবী লতা
আর মিহি শাড়ির মতো পড়ে আছে সাপের খোলস
ফ্যাকাশে ঘাসের ওপর হাঁটুমুড়ে বসে আছে যুবক
মৃদু হাসিতে অপলক চেয়ে আছে প্রেমিকার চোখ…
কৃষ্ণের জ্বর হলে
লৌকিক রাধা এসে ঘুরে গেছেন পার্বতীপুর!
সে এক প্রাচীনবট—ঝুরিদিয়েবিছিয়েছে পথ
চোখ বন্ধ অন্ধকারে ধাওয়া করে মোহনীয় সুর…
অসংখ্য প্রাণকণা সাপের লকলকে জিহ্বার মতো
নিশ্বাসের বায়ুজুড়ে খেলা করে বুকের ভেতর।
পাথরের প্রেম গেছে—দেহভর্তি যমুনার জলে
দেখো—কার সুরে কে নাচে সুদূর মাধবনগরে!
শত বছরের প্রত্নরাত ঘুম পাড়ে শাড়ির আঁচলে
কী মায়া বয়ে যায় যোজন হৃদয়ে-হৃদয়ে…
কৃষ্ণের জ্বর হলে রাধা পোড়ে শীতের আগুনে!
কন্যার প্রতি
নক্ষত্রের চামচ মুখে জন্মাওনি কন্যা আমার
এমনকি পিতলের চামচ মুখেও না!
বাজারের অতসব দামি জামার বদলে
দিয়েছি তোমাকে পাতার পোশাক!
আহা কন্যা আমার!
লিচু ফুলের মধুটুকু ওর মুখে তুলে দাও এবার।
যখন তুমি খুলেছ চোখ পৃথিবীর মায়ায়
বাণিজ্যের বাতাস পাক খেতে খেতে
ছুঁয়েছে শহরের উঁচু মিনার—
আর অক্ষমতার দড়ি ঝুলিয়ে গলার ভেতর
মরা ঘাসে দাঁড়িয়ে রয়েছি অপার!
আহা কন্যা আমার!
লিচুফুলের মধুটুকু ওর মুখে তুলে দাও এবার।
চাঁদের কুসুমিত পথে হেঁটে যাও তুমি—
বেড়ে ওঠো মাটি—ঘাস—তৃণের ভেতর
ঝরাফুল কুড়িয়ে বানাও গহনা তোমার
ঝলমলে ঐশ্বর্যগুলো চোখে মেখো না।
আহা কন্যা আমার! জেনে রেখো—
তোমার পিতা ছিল শুধু অক্ষরের দাস।
দূতিকা
নগ্ন হওয়ার আগে পোশাক পরতে হয়!
কাঁকর পথে বিছিয়ে রেখে লাল মার্বেল
ইতিহাসে ভিজিয়ে রাখি হাতপাখা ঘুম…
দূরের বাঁকে জেগে আছে কচুপাতায়—
শিশির কণা—সাপের ফণা—লুডুরপাতা…
বায়োস্কোপের সকল ফুটো বন্ধ রেখে
দৃশ্য যদি ডেকে আনে দুধমাখা ভয়!
পোশাক পরার আগে নগ্ন হতে হয়!
ঈশ্বরীপুরের সন্ধ্যায়
ওই দূর অন্ধকারে সাপের চোখে আমি বসে থাকি। রুগ্ণ বিছানায় যখন এলিয়ে দিচ্ছ প্রাকৃতিক শরীর—অবসন্ন স্যাঁতস্যাঁতে বিষাদে তোমার ভরে উঠছে মন!দেখো আমাদের জাফলং গল্পটা কিন্তু শেষ হয়নি—কাঁকড়ার দাঁত নিয়ে গবেষণা এখনো বাকি। সব পাখি কি নদীর কিনারে যায়? যতটা খাদের গভীরে ঘুটঘুটে আঁধারে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি!
সমূহ যাপনের ভার নৌকার গলুই ধরে পাড়ি দিচ্ছে শরীরের পথ। আমি যখন ডুমুরের কথা বলি—ভেসে ওঠে মাকড়ির দুল! সোনালুর ডাল ধরে পাখা নাড়ে বিরহী কোকিল।
আরোগ্য হাওয়ার ভেতর তৈরি করো পরাবাস্তব পথ—ঈশ্বরীপুরের সন্ধ্যায় পুনরায় শিশু হয়ে উঠি…
এ রাত ডানার হলে
সেই এক তরমুজের বন—লালরস রক্তবর্ণ চোখে শুয়ে আছে। উড়ে-উড়ে জাঁহাবাজ পাখি ঠোঁটে ধরে গতজন্মের বিড়ালের দাঁত—পার হচ্ছে শান্ত নদী। আমাদের তৃষ্ণা মেটানো পথ— ছোট হতে হতে পকেটে ঢুকেছে। মুগ্ধতার গাছজুড়ে ফুটেছে মায়াবতী ফুল।
সমুদ্রে বাতাস হলে নড়ে ওঠে আকাশের চাঁদ!—এ ব্যাখ্যা বাসি ভেবে চোখভর্তি জোছনা নিয়ে হাঁটি। পাতা কুড়ানো রাতে গ্রামে-গ্রামে জ্বলে ওঠে কুয়াশার বাতি। ভাপ ওঠা ভাতের মতো দুর্লভ কিছু শ্রুতি কানে কানে বলে যায় হাওয়াদের পরি।
এ রাত ডানার হলে ওড়ার বাসনা আমি মনে পুষে রাখি!
কচ্ছপের ঠোঁট থেকে
চৈত্রের রাতে মিলন ঘনিয়ে আসে—পাতাবন্দি অধীর বাসনা ভোর ডেকে আনে। তূণ ও তৃর্ণের স্বভাব এক হয়ে গেলে কেঁপে ওঠে অর্জুনের হাত! ঘর্ষণে আগুন জ্বলে—তারো বেশি হৃদয়ের তাপ। যেভাবে ডুবে থাকো ও হেমন জলের জীবন—কী লিপি লিখে রাখো খোলাচুল শেওলার ভেতর…
এদিকে ধীবর-জীবন জাল বুনে কাটায় প্রহর। মদ ও মাদুলিতে নেশা ধরে যায়। মহুয়ার রসে যদি ভিজে ওঠে তোমার হৃদয়—লালপথে খুঁজে নিও চড়ুই সংসার।
আরও কিছু হেঁটে হেঁটে পার করো মাঠ—ছবির মতো সাজানো গ্রাম। কচ্ছপের ঠোঁট থেকে তুলে আনো হারানো বিলাপ…
সেতারের মন্ত্রে কেন বলো অন্ধ হয় তাজা তাজা চোখ!