ডিসেম্বর, আলোজন্ম একটি মাস
বুকের ভেতর সন্তর্পণে নেচে ওঠে শৈশবের মাঠ;
আহা মাঠ! হলুদবিম্বিত; তুমুল স্পর্ধা নিয়েই ভাবি
বুকে তীব্র আগুন জ্বালিয়ে, আমাকে লিখতে হবে—
বিজয়ের একটি কবিতা; আর বাংলার শ্যামল ছুঁয়ে
শপথ নিতে হবে অপশক্তির বিষদাঁত ভাঙতে
সূর্যের রঙে আঁকতে হবে অনপনেয় একটি পতাকা।
ডিসেম্বর, আলোজন্ম একটি মাস, সপ্রতিভ—
অদ্ভুত ভঙ্গিতে আমাকে ডেকে নেয় স্মৃতির সন্নিকটে;
শুনি, সন্তানহারা মায়ের চিৎকারে ভাসে পাড়া-মহল্লা,
বধ্যভূমি বর্ণিল হয় শ্রদ্ধা অবনত গানে, আপাদমস্তক;
বঙ্গজননীরা গুমরে কাঁদে—কী প্রচণ্ড আশ্লেষ!
আমাদের জল-স্থল আর তেরশত আগুনের নদী
স্বপ্ন জাগিয়ে উঠে যায় রেসকোর্সের আকাশে
তাই, এ-মাসে আমাকে লিখতেই হবে দীর্ঘ একটি কবিতা;
শেখ মুজিবের সাহস আর অকুতোভয় বীরাঙ্গনার গল্পে
শীতনিদ্রা ভেঙে দাঁড়াতেই হবে—আলোজন্ম অভিযানে।
প্রাক্তন
দুই জানালার মাঝখানে মাথা তুলেছে দেয়াল,
উঁচু কংক্রিট; সরু গলিটিও শ্যাওলা আবৃত;
এ পথে এখন আর মানুষ আসে না, এমনকী
শীতের হাওয়া ঢুকতে পারে না যখন তখন;
আবশ্যিক নয়, তবু মাঝে মাঝে শ্যাওলাবিম্বিত
আলো এসে ধুয়ে দেয় বিক্ষিপ্ত শয্যা, গান করে;
সে গান পৃথিবীর বহু চেতনামিশ্রিত; তখন—
পৃথিবীর শিরা বেয়ে ঝরে পড়ে ধূসর স্মৃতিরা;
মরিচা ছাওয়া বাড়িটি ভাঙা হবে সময়ের খঞ্জরে,
মুছে যাবে শেষ আলো—স্বত্ব ত্যাগের নোটিশ
পেয়ে, বন্ধ জানালার দিকে সাক্ষী পাখিটিও;
উড়ে গেছে, একান্ত দুঃস্বপ্ন সঙ্গী করে!
আমাদের অনুভবের মূর্ছনাও যেন উঁচু কংক্রিট,
বিকশিত হতে গিয়ে—স্বমহিমায় হয়েছে প্রাক্তন!
মধ্য-শরতের খেরোখাতা
[১ম সর্গ]
সেই তো মর্ত্যইে নেমেছ!
বেশ-
এখন, পা রাখতে পারো পথের বিভাজনে;
খরচ করতে চাওয়া দিনগুলোর চূড়ায়
তাকিয়ে দেখতে পারো, হ্রস্ব হয়ে আসছে
ক্রমে, নিরীহ ব্যাপারগুলোও;
আর ক্ষয়ে যাচ্ছে—জীবদ্দশার প্রতিটি নদী…
[২য় সর্গ]
আমি শুধু শৈশব পেরোনো দুর্দিনের ঘোরে-
বহুবার, বানোয়াট গল্পের অবতারণা করেছি;
তাগিদ দিলেও ছুটে যেতে পারিনি—
ক্ষমা করো আমার সকল উপাসনা…
[৩য় সর্গ]
যুদ্ধ দেখে দেখে শান্তির সংজ্ঞা গেছি ভুলে;
স্বপ্ন বাঁচাতে, সাধারণ পরিষদে, ভাবছি—
বসিয়ে দেবো চড়া প্রমোদকর;
মর্ত্যইে তো আছ, থাকো;
মহালয়ার চুম্বনে উগরে দেবো প্রশান্ত হেমলক…
নভেম্বর: একটি রাত্রি
নভেম্বর: একটি রাত্রি সাক্ষী
—চলে যাই রাত্রির গভীরে, এবং
বহু প্রকৃতির মানুষ জাগিয়ে—বিভ্রম বিস্তারে।
দেখি, সংহিতা খুলে—উড়ছে উত্তাল;
বৃদ্ধ ইতিহাস, মলিন বেসাতি জীবনের নামে,
পুষ্পের করুণ কান্না সেখানেও, তাহলে?
—আমি ভবিষ্যৎ লিখি তাদেরই নামে, মর্মে;
অরণ্যে নামাই পাখিদল, তীর্থ পৃথকের আগে
ক্যালেন্ডারে রেখে যাই দাগ, বঙ্কিম;
মগ্ন সন্ন্যাসীর মতো, অবশেষে!
একটি রাত্রির ডাকে চলে যাই অন্য বাসনায়—
মসৃণ ঋতুর দায় পড়ে থাকে পাঠে ও পাপে;
যাই সিদ্ধান্তের সূত্র নাড়িয়ে, ওহে নভেম্বর,
হয়তো বা অন্য পৃথিবীর ভবিষ্যে,
পুনর্বার দেখা হতে পারে—
পাপ ও পঙ্ক্তি
লতানো আঙুর গাছ—চেয়ে থাকে ভিমরুল হাওয়া, কার্তিকের নির্জন এ নিধুবন, সখি, চতুর বাঁশিতে খোলে; আশ্চর্য সুরদহ তার, বেদনায় নত হতে হতে ক্রমেই বাড়িয়ে দেয়—তোমার প্রতীক্ষা!
দেখো, বেঁকে যাচ্ছে রাত—উত্তরের কলস্বরে; সম্ভাবনার ফুটি ফুটি কুঁড়িও তাকিয়েছে উজ্জয়িনী অভিমুখে; হয়তো-বা, সেখানেও পরিপাটি বিভেদের মদ, অধ্যাবসায়ের কিঞ্চিত ঘোরে হামা দেয় পথের প্রফুল্ল!
আমাকে নিষেধ করো না; পাপ ও পঙ্ক্তির চাদর সরিয়ে ঘুরে দাঁড়াবো ফের; অনন্ত আঙুরের কৌতূহল নিবৃত করেই যাবে—তোমার দিকে; তরুণ অঘ্রাণের কূলে, বোঝাপড়ার পারদ ঠেলে, যে তুমি—গোপনে ভাঙছ—
শব্দহীন জ্যোৎস্নায়
শব্দহীন জ্যোৎস্নায় ফুটে উঠেছিলে ফের—রঙিন পালক;
দেখেছি—উত্তর আকাশ এলায়িত করে
উড়ে আসে সুনীল বসন্ত;
অবাক মাঠ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ঠাঁয়
আমিও ঊষর মরুতে আবির ছড়িয়ে—ভালোবেসেছি;
দিনের আলো ফোটার আগে দেখি; বিন্দু বিন্দু
অভিমান ঢেলে খুলে দিয়েছো প্রত্যাগমনের
সহস্র সিঁড়ি; অন্ধ আমি—লজ্জাকাতর; শুধু জানা হয়নি;
কোন চন্দ্রে পরিপূর্ণ ফোটে তোমার কবোষ্ণ নীল!
অক্ষরের জুয়ার ভেতর
অক্ষরের জুয়ার ভেতর জীবনকে বাজি রেখে
সবিস্ময়ে চেয়ে থাকা, যেভাবে খাদ্যের পাশে
চেয়ে ছিল আমাদের অনন্ত সকাল;
নিজস্ব ধর্মে যখন সাজিয়েছো চকিত ইশারা
সহস্র অনুনাদে তেতে উঠেছে স্বপ্নচর্চিত রাত
অপত্য প্রেমের স্রোত কোনোখানে নেই;
যখন এসেছ নেমে ঘুমঢুলু বুকের ভেতর
গোপন সঞ্চয় থেকে খসে পড়া পাপ,
বসন্ত বিভ্রাটের গাছে ফুটেছে কেন শুধুই দ্রষ্টব্য!
ঠিকুজি
যে-তল ঘুমিয়ে আছে পাথরের মতো
তার কাছেই চেয়েছি নির্মাণের জল
অনেক বচসা হলো—কোলাহল বেশ
বসন্তের কলরোলে বোধের বিস্তার;
অনিকেত স্বপ্ন যেন উপমায় ঠাসা
ভালোর অপেক্ষা চেয়ে যা-কিছু গীতল
বিস্মরণে ন্যুব্জ সব হয়ে গেছে ফিকে
অনুপ্রাস, দূরতম জীবনের পথে;
অবসাদ ফেলে এসে সুখ নিয়ে বলি
অনেক নিয়েছি পাঠ—বাঁক-প্রতিবাঁক
সংশয়ী ডানা মেলে ত্রিবিধ উড়াল
পিপাসা-জলেই তবু তোমার নির্মাণ;
এখন ঠিকুজি নাচে বিমল আশ্বাসে
আলোক দ্যুতির চেয়ে বড় মায়া নেই।
প্রিয় ক্ষতগুলো ভেঙে
প্রিয় ক্ষতগুলো ভেঙে জেগে ওঠে তোমার নির্মাণ
যখন নির্ঘুম রাত্রি আরেকটি সকালের খোঁজে—
তখনো, প্রচলের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড গতিময় আমি
ধুলোর কপাট খুলে চোখ রাখি বিরহমলিন চিহ্নে;
একদিন নীল জ্যোৎস্নায় মুদ্রিত হয়েছিল তোমার নিশানা
কী আশ্চর্য! এখনো সেই ব্যাকুল মুহূর্তগুলো—
স্মরণ অরণ্যে অদৃষ্টবাদী পথিকের মতো দাঁড়িয়ে
পরিণতি ও ফলের আশা করছে না; মেয়াদোত্তীর্ণ হাওয়াও
তোমার কথা ভেবে খুঁজে চলেছে আসন্ন বসন্ত!
এ বছর আড়াল গভীর হলে—প্রবর্ধিত আলোক রেখায়
তোমার স্মরণ বেজে উঠবে নগরীর প্রাণপুঞ্জে; যদিও—
গলিত পিপাসার অধিক যন্ত্রণাময় তোমার নির্মাণ
দীর্ঘ ক্ষত ভেঙে ভেঙে শৈল্য-চিকিৎসাদুষ্ট গভীর সাম্রাজ্যে!
কার অভাবে কে কতটুকু ফোটে
প্রতারিত হতে হতে একটি বোধ
ঢুকে যায়—রাতের গভীরে;
চিন্তার গভীরে—
আদর্শকে মনে হয় পুনর্বার, ভুল চিত্রলিপি!
দূর স্বপ্ন, তখনই মনে পড়ে তোমাকে—
আপাত সত্যের ভূমিকা সরিয়ে, নিবিড় ও দৃঢ়
শীতদেহ বিছিয়ে দিতে চেয়েছিলে, স্বপ্নের ভেতর একদিন
হায় স্বপ্ন! হায় সম্ভাবনা! যা নিয়ে—
একান্ত ধ্যানের পথে হেঁটে এসেছিলে, একা!
মনে পড়ে, কত অধিরাত্রিজুড়ে বিস্তার করেছি
তোমার গোধূলি: অথচ, রঙ করা সময়ের দেয়ালে
শীৎকার ধ্বনি বাজে; মনে হয়—
নির্বোধ বেশ্যার বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠি
রাত্রিদিন, ঝরে পড়ুক নিন্দার জল চারিধারে; উৎসবের
উজ্জ্বলতা থেকে ফিরিয়ে রাখি মুখ, সুতীব্র ঘৃণায়!
মগজ থেঁতলে যাওয়া সন্ধ্যা, তবুও কী বিষণ্ন!
তোমার সংশ্রবে খুন করেছি আত্মস্বার্থ—বার বার
কোমল আর্তনাদে ভেসে গেছে দূরমাঠ, আর
রক্তের জানালা ছুঁয়ে, বেড়ে উঠেছে ধীরে—
নিকষ আঁধার, তবুও তুমি এক আরাধ্য প্রতীতি,
আত্মবিনাশে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছি
কার অভাবে কে কতটুকু ফোটে!