আদিগন্ত ফসলের কবিতা
আমার ঠাকুরদা একজন কৃষক ছিলেন
মাটিগন্ধা হাতে তিনি শস্য ফলাতেন
ধানের কাছে হৃৎপিণ্ড সমর্পণ করে
তিনি শিশুর সারল্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন
প্রতিটি ধান তখন কবিতা হয়ে উঠতো
আদিগন্ত মাঠ তখন কবিতার খাতা।
আমার ঠাকুরদার মতো অমন কবি হয়ে উঠতে
আমি কাউকে দেখিনি
তিনি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের চেয়েও
অনেক বড় কবি ছিলেন
এমনকি সেক্সপিয়রের সনেটগুলোকেও
আমার কাছে ঠাকুরদার ফসলের চাইতে
বড় কবিতা মনে হয়নি
ঘাম শরীরে তিনি যখন লাঙ্গল চষতেন
মনে হতো এক্ষুনি জন্ম নেবে
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোনো কবিতা।
অগ্রহায়নে তিনি তার সোনালি কবিতাগুলো
নিজ কাঁধে বয়ে এনে ঠাকুমার হাতে তুলে দিতেন
ঠাকুমা পরমযত্নে কবিতাগুলোর গন্ধ শুঁকতেন
স্পর্শ করতেন, রৌদ্র মাখিয়ে রেখে দিতেন
গোলাঘরের নান্দনিক মলাটে
আমাদের গোটা বাড়িটাই তখন হয়ে উঠতো
অনিন্দ্যসুন্দর এক কবিতার বই।
আমার ঠাকুরদা শস্যগন্ধা কবি ছিলেন
আমি তার অযোগ্য পৌত্র
দিন রাত শব্দের জট আঁকি
গ্রন্থের কাছে করি আত্মসমর্পণ
প্রাজ্ঞ বিজ্ঞের কাছে ছুটে যাই
কবিতা লেখার গোপন রহস্য জানতে
অথচ আমার ঠাকুরদা
শুধুমাত্র ঘাম, মাটি আর লাঙল দিয়ে
অনায়াসে লিখতে পারতেন
আদিগন্ত ফসলের অমর কবিতা।
শূন্যতা
প্রতিটি থাকার মাঝে কিছু না থাকা ফুটে থাকে
অসীমকে বুকে ধরেও
আকাশের আরেক নাম তাই শূন্যতা
জীবন যতটা শিল্পকলা তারও অধিক গণিত
এ কথা জেনেও শূন্যবাক্সে উঁকি দিয়ে মুগ্ধতা খুঁজি
এই মুগ্ধতার আরেক নাম বেঁচে থাকা।
কেন প্রতিদিন নিজেকে খনন করি
বুকের ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে
তুতানখামেনের সমাধি
সে তুমি জানবে না কোনোদিন।
সব মেঘে বৃষ্টি হয় না
কোনো কোনো মেঘ বৃষ্টির আফসোস বাজিয়ে
চলে যায় দূরে–দূরের হাওয়ায়।
এই দূরত্বটুকুর নাম শূন্যতা
শূন্যতার আরেক নাম জীবন।
রাজনীতি
এখন মৃত্যু
পুরনো দেয়াল থেকে আলগোছে খসে পড়া পলেস্তারা
শার্টের বুক থেকে টুপ করে খসে পড়া
একটা বোতাম
আলতো বাতাসে দুলে নিতান্ত অবহেলে
ঝরে যাওয়া পাতা
অথচ জীবন
দেয়ালের পলেস্তারা নয়
শার্টের বোতাম নয়
বৃন্তচ্যুত পাতা নয়
একটা শিশুর মৃত্যু হলে একটা সমুদ্র মরে যায়
একজন নারীর মৃত্যুতে মরে যায় আকাশ
একজন পুরুষের প্রয়াণে ধসে যায় পাহাড়
পুরুষগুলো মরছে
নারীগুলো মরছে
শিশুগুলো মরছে
মরে যাচ্ছে পাহাড়
মরে যাচ্ছে আকাশ
মরে যাচ্ছে সমুদ্র
তবুও এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে
কী নির্লজ্জ বেহায়ার মতো
মাথা উঁচু করে ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকছে
রাজনীতি!
জিজ্ঞাসা
সম্পর্কের সুতো বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে
ভাই একদিন ভাইরাস হয়ে যায়
ক্রমাগত হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে
মিথ্যা যেমন হয়ে যায় মিথ।
তবুও জলের ধর্ম মেনে
আমরা ভাসি-ডুবি
সম্পর্কের ঘনত্ব মাপি জলের নিয়মে।
আর্কিমিডিস, আপনার কি জানা আছে
সম্পর্ক ডুবে গেলে
কেন আর ভেসে ওঠে না কোনো দিন?
সন্দেহ
তোমার জামায় লাগিয়েছিলাম মায়ার বোতাম
আস্তিন থেকে খসে পড়ছে গুটিকয়েক
কিন্তু…সুতরাং…
সেই কবে ডাকযোগে পাঠিয়েছিলাম বসন্ত
আষাঢ় উবু হয়ে বসে আছে বারান্দায়
দৃষ্টি থেকে টুপটাপ খসে পড়ছে রাগ
কোন পাগল যেন বলেছিল–
রাগ ক্রমাগত ভালোবাসার দিকে যায়…
আমি চাইছি টেলিপ্যাথি
কেউ জানার আগেই তুমি টের পাও প্লাবনের পরিকল্পনা
বুঝে নাও আমার মাতৃভাষার নাম প্রেম
দেখতে পাও বুকের ভেতর
উদাস অক্ষরের অলস আসন
আর করোটিতে গোপনে গেঁথে গেছে
গ্রাম্যতার হলুদমাখা চাঁদ।
বিশ্বাস পুড়ে গেলে ভেসে উঠে কেবল সন্দেহ
সন্দেহ গিলে খেলে
অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।