ভালোবাসা দক্ষিণে গেছে
ভালোবাসা দক্ষিণে গেছে
আমি ছিলাম উত্তরে দাঁড়িয়ে
দক্ষিণে রোদ খুব কড়া
সে কেবল লাল-সংকেত মাড়িয়ে
যায় শুধু দক্ষিণেই যায়
তাপ লাগে উত্তরের গায়।
ভালোবাসা দক্ষিণে যাও
তবে যাও
উত্তরের কাঙালেরে
একপলক দক্ষিণা দাও।
.
কবির প্রণয়িনী
কবির প্রণয়িনী
ভালোবেসে ভাসমান তিমি’র শরীরে পা রেখে সমুদ্র পাড়ি দেয়
চেতনায় ঘণীভূত গভীরতা
অতল বন্ধনের শিহরণে তরঙ্গ দোলায়
বয়সের সমান বয়সী শোক
তবু আরও শোক চায়
শোকের সীমান্তে হাসে ঐশী মমতা।
কবির প্রণয়িনী
নিশ্চিত আতঙ্কেও ঠোঁটে তার অরুণিমা হাসি
পিতৃপুরুষ মাথা কুটে রক্তে ভাসে
বিধানের আদিম পাথরে
শূন্য হেঁসেল
অন্ধকার ফুঁড়ে জ্বলে তবু শঙ্খবালা-চোখ।
অন্ধের খরচেতনার মতো স্পর্শকাতর
নিহত নিগৃহীত শরীরে মাটির একাত্মতা।
কবির প্রণয়িনী
স্বপ্নের ছিন্ন পালকগুলো খুঁজে খুঁজে খোঁপায় গুঁজে
স্নিগ্ধ স্থৈর্যে একঘরে কবির আত্মায়
কবির ঈশ্বর।
.
স্বপ্ন
স্বপ্ন আক্রান্ত পুরুষ আমি
স্বপ্ন আমার পিতামহকে দেউলে করেছিল
আমার পিতাকে তাড়িয়েছে বুনো মোষের উন্মত্ততায়
মাকে দিয়েছে বায়ুবিদীর্ণ প্রসবযন্ত্রণা
এখন, অজগরের মত স্বপ্ন আমার শরীর গিলেছে
আমার রক্তে ঢেলেছে পুরুষানুক্রমিক বিষক্রিয়া।
আমি এখন এক ভারসাম্যহারানো যান
আমার প্রেয়সী বাহুবন্ধন ছিঁড়ে ছিটকে পড়ে নিচে
আমি তার আহত ব্যাকুল শরীর দুমড়িয়ে পাগলা হাতির মতো ছুটি
স্বপ্ন আমাকে রোদপোহানো কুমির বানিয়ে মৃতবৎ তপ্ত বালির ওপর শুইয়ে রাখে
আলোকের ক্ষিপ্রতায় দিকভ্রান্ত করে।
স্বপ্নকে এখন আমি বংশানুক্রমিক শত্রু বলে জানি
সে আমার চোখ খেয়েছে, মগজ খেয়েছে
এখন, হৃৎপিণ্ডে বসিয়েছে দাঁতাল কামড়।
আমার দেউলে পিতামহ নিভে যাওয়ার আগে
আমার পিতাকে কিছু স্বপ্ন দান করেছিলেন
স্বপ্নবিদ্ধ নিরীহ পিতার উত্তরাধিকারে
স্বপ্নই এখন আমার শেষ অবলম্বন।
.
কবি তুমি জানো
কবি তুমি জানো ক্ষুধার থাবায় কবিতার হতদশা
ভাঙামঞ্চে আচমকা থামে ছন্দচটুল পা
ভাবের তন্দ্রা ভেঙে দেয় এসে অভাবের আততায়ী
কবিতা তোমার সাপের সীমায় দোয়েল পাখির ছা।
কবি তুমি জানো নিঃস্ব প্রেমিক নুলো হাতে ধরে মালা
বাতাসেই ঝরে প্রেমের অর্ঘ্য, হুতাশই তার সাথী
ভাঙা পাঁজরে আলিঙ্গনের এত জোর কোথা তার
দুস্থ প্রেমিক শিলাঝড়ে ভিজে, নেই তার বর্ষাতি।
কবি তুমি চেনো কাগজ কলম চেনো না ভাতের হাঁড়ি
তুমি খোঁজো শুধু প্রেমিকার মন, হৃদয়ের চোরাগলি
কালো অক্ষর পিঁপড়ের ঢিবি, মগজে তোমার বাসা
মুগ্ধ বামুন ভাবের খড়গে দয়িতারে দাও বলি।
.
শরণার্থী
বড়ো নিগ্রহে পেছন ফিরেছি
পেছনে ধাবমান তুমি বন্যার তোড়
আমার দৌড় বড়জোর মসজিদের বারান্দা
ভিটেমাটি খেয়েছো সেই কবে
পুকুরের সব ঋতুবতী মাছ বানভাসি
ছেড়েছে গৃহস্থের মায়া
এ মৌসুমে ফলন ভালোই ছিল
এখন তো জলমগ্ন পঁচাগন্ধ গর্ভপাত
তোমার ফণার ঝাপটা নীল আগ্রাসন।
বড় নিগ্রহে পেছন ফিরেছি
দৌড়ুচ্ছি ঊর্ধ্বশ্বাস
কার সাধ শরণার্থী হতে।
.
শঙ্কা
যাবার সময়, দরকষাকষি এপার ওপার
এপারে উদ্বেগ, ওপারে তাড়া
এপারে ঝুঁকে —- উদগত কিছু কান্নার ভার
ওপারে অপেক্ষা, আগে পাড়ি দিয়েছিল যারা।
যাত্রী হাঁসফাঁস, গাঁটে সম্বল অচল একটি আধুলি
জমা-জিরেত প্রোথিত শেকড়ে, আলীশান সব স্মৃতি
সবে ভোর হলো, বেলা গেল কবে, হঠাৎ নেমেছে গোধূলি
পারানি কে দেবে ঘাটোয়ালের, ভাঁড়ারের কোন সুকৃতি!
এপারের কড়ি ওপারে অচল, পরমাত্মীয় অচেনা
সিন্দুক-সোনা, হঠাৎ এখন জঞ্জাল খড়গাদা
দান-দক্ষিণা, কাঙালি ভোজ, শঙ্কা তবুও ঘোচে না
জলের যাত্রা, জল কই, আছে একবুক কাদা।
.
একখানি সাদা থান
কবির সহধর্মিণী
আজীবন ভূতগ্রস্ত এক মানুষের সাথে শবানুগমন করে। ছাইদানিতে বাসনার একগাদা পোড়া ফিল্টার আর স্বপ্নের ভস্ম দেখে দেখে খানখান কৈশোরিক আকাঙ্ক্ষার হাহাকারে মুখ ঢাকে।
বাস্তুহারা রোদে ছেঁড়াকাঁথা শুকিয়ে ভাগ্যের শাপ-শাপান্ত আর অহংকারের কুড়ানো আগুনে কাঁচাসেদ্ধ শাকান্ন ভবিষ্যৎ।
কবির সহধর্মিণী
মুড়ির ঠোঙার মতো একগাদা নিষ্ফলা কবিতার পাতা নেড়েচেড়ে দেখে, ফেরিওয়ালার টুকরিতে সন্তানের জন্য হাতড়ায় একখণ্ড জমি, বাড়ন্ত কন্যার বর, নিজের জন্য ঠকে যাওয়া দাঁড়িপাল্লার সেরে পাঁচ পোয়া হিসেব।
গাদা গাদা পুস্তকের পাতার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া লটারির টিকেট খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত
কবির সহধর্মিণী, একসময় ভূতগ্রস্ত নিজেও
স্বপ্নের বেঘোরে দেখে—কবিতার পাতা নয়
হাওয়ায় উড়ন্ত
একখানি সাদা থান, ধবধবে সাদা।
.
কাপুরুষ
কাপুরুষ বলে আগলে দাঁড়াই নি পথ
চোখের মিনতি ঢেকেছে উল্টো ভ্রুকুটি
কাপুরুষ বলে অপরের সম্পদ
শক্তির বশে করি নি হাতের মুঠি।
কাপুরুষ তাই দিয়েছো উল্টো ঘৃণা
করুণার বশে শিথিল রেখেছো চোখ
অর্বাচিনের যথার্থ দক্ষিণা
আরতির শেষে উচ্ছিষ্টের ভোগ।
.
শহরান্তরে
পেছন থেকে অবিকল তুমি
সেই আলগাশ্রী কোমরের নদী
ছিপনৌকো পংক্তিময় বেণী
ঋতুবতী বাতাবিনেবুরঙ জড়িপাড় শাড়ি
দাঁড়িয়ে থাকার সেই আলসেটে ভঙ্গি
জোছনাময় পায়ের ডিম, মহুয়ার ঝিমধরা
বৈজয়ন্তীমালা-গ্রীবা
আমি মরীচিকা -আচ্ছন্ন
কখন, কীভাবে—
তিনশো কিলোমিটার দূরের শহরান্তরে
উড়ে এলে তুমি সাঁওতাল মেঘের সাম্পানে!
বিদ্যুৎ নিভে গেলে পূর্ণগ্রাসে
ঘাস না জাগিয়ে এগোলাম সন্তর্পণে
শিশুপার্কের শিরায় শিরায় জমাট বাঁধলো রক্তকণিকা
হায়! এতো হতাশা নিষ্প্রদীপ এই সান্ধ্য শহরে
কোথায় লুকাই!
.
প্রলোভন
এসো মিলি—
মিলে যাই সায়াহ্ন – ডানায়
মিশে যাই ঝিলের আয়নায়
কালো মেঘ অপলক আনত মুখ
মুখ টিপে টিপে হাসে সন্ধ্যার তারা
তোমার সলাজ টোলে—দিশেহারা
এসো দেখি, ঝাউবনে শিস দেয় কারা
ঝাউপাতা ঝরে গেছে, রোদে পোড়ে বালির চামড়া
ঝাউতলা নিরাপদ নয়
ফেন্সিডিল-যুবকেরা দালানের ছাদে বসে
মরণের বিড়ি ফুঁকে, বিষ্ঠা চিবোয়।
এসো মিলি, মিলে যাই
প্যাগোডা মসজিদের মধ্য দরোজায়
কোজাগরী উৎসবে বড় ভীড়
ভীড় আরো বরাতের রজনীতে দরগায়
এসো, শুয়ে পড়ি নীলিমার গালিচায়
মলয়ের পরীরা বসে আছে হাতপাখা খুলে
ধর্মকর্ম সব গলে যাক প্রাণের আগুনে
এসো, ঋতুর জরায়ুতে ভ্রূণ হই প্রথম ফাগুনে।
কবি পরিচিতি:
আকতার হোসাইন
জন্ম: ১০ আগস্ট, ১৯৫৭
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ
যে তুমি কাঁদাও এসে
চোখের তারা সকল মেয়ের নাচে না
কষ্ট নাও সমানে সমান
যে বিষ ছুঁয়েছে রক্ত
জলের কাতর ডানা
দরিয়া কাঁদে না দাঁড়ের আর্তনাদে
তোমাকে প্রার্থনার মতো ডাকি
নির্বাচিত প্রেমের কবিতা
নির্বাচিত কবিতা ছড়া
কিশোর কবিতাগ্রন্থ
মেঘ তোমাকে দিলাম ছুটি
ব্যাঙের ছাতা
ইষ্টি নয়
এমন নদী পেতাম যদি
মেঘের কি বাড়ি নাই
সম্পাদনা:
নিসর্গের প্রতিবেশী ( কবিতা সংকলন)
পংক্তিমালা ( কবিতা বিষয়ক ছোটকাগজ)।