সেলিনা শেলীর কবিতা
ডলারের খুৎবায় কেনা মৃত্যুর রাজ্যপাট
কত মানুষ কতভাবেই না দেশান্তরী হচ্ছে, অনিচ্ছায়!
মানুষের দেহ যায়, মন পড়ে থাকে নিজস্ব যমুনায়।
তার বুকের ক্ষতে ফুটে থাকে স্বদেশের
আলোঝরা নক্ষত্রবাগান!
আমিও তার এক হারানো বিকেলের গান।
প্রতিদিন ঝরেপড়া রক্তবৃষ্টিতে যে নুন
তা আমারই।
আমারই স্বজন
ফিলিস্তিন, মিসর, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইউক্রেন,
পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তানজুড়ে।
এখানে জীবন নেই; আছে জীবনের খোসা!
এখানে প্রেম নেই
প্রেমের বদলে আছে বারুদের নেশা!
কে ঘোরায় চাবি তার?কে করে হননের নকশা, প্রতারণা?
কে করে মানুষের প্রাণ নিয়ে এত রক্তছলা?
এখানে আবাবিল নয়, আকাশে ওড়ে মানুষের
ছিন্নভিন্ন পোড়া লাশ!
এখানে ঈশ্বর নেই, বহু আগেই হয়েছে পলাতক
অথবা বোমার কারিগরই ঈশ্বর।
এখানে
উত্তরে-দক্ষিণে পুবে পশ্চিমে—দেশে দেশে
করোনার মতো ছড়িয়ে পড়েছে ধর্মযুদ্ধ;
মূলত ধর্মাস্ত্র!
শেষ পারমানবিক অস্ত্রের কসম
ইহলৌকিক হও, নিজের মুক্তি নিজেই খোঁজো,
মানবমুক্তি- নিদান হোক তোমার পতাকা।
এখানে ঈশ্বরের ব্রেকফাস্টজুড়ে
মানুষের বারবিকিউ ঘ্রাণ।
ডলারের খুৎবায় কেনা মৃত্যুর রাজ্যপাট।
সমস্ত তালুকজুড়ে এক অভিন্ন ক্ষমতার ঈশ্বর।
তাকে তুমি সরাবে কী করে?
সে থাকে ব্যাংক ভোল্ট আর অস্ত্রঘরে।
তুমি ও তোমরা তো এক নও, বিচ্ছিন্ন।
অতএব
মরো, মরো এবং মৃত্যুর অপেক্ষা করো।
রকিবুল হাসানের কবিতা
একদিন স্বাধীন হবে ফিলিস্তিন
আমার জন্ম কোথায়—পৃথিবী কোথায়—কতদূর!
পৃথিবীর মানুষেরা দেখতে কেমন
আদৌ কি মানুষ আছে এই পৃথিবীতে
আমি-তুমি ফিলিস্তিনি—আমাকে-তোমাকে
দিনরাত হত্যা করা হচ্ছে—
খণ্ডবিখণ্ড করছে
বুক জুড়ে অগ্নিকুণ্ড—পোড়া গন্ধ-বিভীষিকাময়
মানুষের কি হাত থাকে? শরীর-পা থাকে? বুক থাকে?
ক্ষুধা ও যন্ত্রণা থাকে? মৃত্যু ও আর্তনাদ থাকে?
আমি ফিলিস্তিনি—কোন গ্রহে জন্ম আমাদের
ফিলিস্তিন ও পৃথিবী অনেক দূরের কোনো গ্রহ?
আমরা হয়তো আর খাবারের জন্য দাঁড়াবো না—
পানির জন্যও নয়।
রক্তাক্ত চোখের জলে তাকাবো না করুণ আর্তিতে!
তবুও শেষ হবে না— ফিলিস্তিন।
নতুন রক্তের লালে লাল হবে ফিলিস্তিন
পৃথিবী, তোমার বুকে একদিন স্বাধীনতা পাবে
রক্তলাল ফিলিস্তিন।
তখন দেখবে
আমরা এক গ্রহের—মানুষ ছিলাম—
শুধু আর আমাদের সন্তানেরা ফিরবে না ঘরে।
মোহাম্মদ নূরুল হকের তিন কবিতা
কবিরা আজ ঘুমিয়ে আছে
কবিরা আজ ঘুমিয়ে আছে পদ-পদবি নিয়ে—রাজার দামি জুতোর-মুকুট মাথার ওপর দিয়ে। নিত্য চাটে পুঁজির দু-পা, কুকুর-বিড়াল হয়ে—কথায় কথায় ‘জয়-মহারাজ’ বলে ভয়ে-ভয়ে। পুড়লো কোথায় মায়ের মতো মাতৃভূমির বুক—কোন মরুতে মরলো শিশু লুকিয়ে কচি মুখ? রাত্রি নামে—আকাশজোড়া রাত্রি নামে মনে—বোমারু বিমানে কারা যাচ্ছে দেখো বনে? কারও কারও রাত্রি বাড়ে, দিন আসে না আর—পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলে, চোখে অন্ধকার। মানুষ এখন নেই যে মানুষ; পাথর তাদের মন—করছে বিরান জনপদ আর করছে উজাড় বন।
মানুষ মরে পথে-ঘাটে, ইঁদুর-পেচা যেন—ছুটছে সবাই রুদ্ধশ্বাসে কীটের প্রকারেণ। দেখেও সব, কবিরা আজ ঘুমোচ্ছে নাক ডেকে—মাথা তাদের মগজশূন্য কলম গেছে বেঁকে? আয়রে বনের বৃক্ষরাজি, আয়রে পশুপাখি—মানুষ বাঁচাও-জীবন বাঁচাও বাঁধো হাতে রাখি।
রচনকাল: ০৩-১১-২০২৩ খ্রি.
জতুগৃহের গান
দুপুর কেন ঝুলছে এখন চার দেয়ালে-ছাদে? হৃদয়পুরে পাথর রেখে আকাশ কেন কাঁদে। কে কাঁদে আর কে আনন্দে পোড়ানদীর বাঁকে—চোখের জলের রঙতুলিতে বিষণ্ন মন আঁকে—সেই খবরে এখন কি আর প্রাণে জাগে ঢেউ? সময় এখন থমকে গেছে জতুগৃহের পাশে—পাণ্ডবেরা দেশান্তরী, কৌরবেরা হাসে। এরইমধ্যে পুকুর-নদী বুকের ভেতর জাগে— শান্ত জলে কে ছোড়ে ঢিল, কিসের অনুরাগে? রাগ-অনুরাগ যাক মুছে যাক জীবন-খাতা থেকে—সময় এখন প্রতিবাদের মানুষ আনো ডেকে।
মরছে শিশু ফিলিস্তিনে, মরছে নারী মাঠে—খুনের নেশায় মাতাল বিশ্ব, রক্ত পুকুর ঘাটে। সেই পুকুরের পানিতে কার ভাসছে দেখো লাশ—রক্তখেকো হায়েনারা ঘটায় সর্বনাশ।
রচনকাল: ২-১১-২০২৩ খ্রি.
দিন-দুপুরে রাত্রি নামে
মনটা যেন গুমোট আকাশ, প্রান্তরে ঝড় ওঠে—হঠাৎ মেঘে-মেঘে কি আজ বজ্রপাণি ছোটে? বর্জ্র তো নয়, যুদ্ধবিমান ফিলিস্তিনে ওড়ে—ড্রাগন যেন আকাশ থেকে উল্কারাশি ছোড়ে। স্বপ্ন ছিল ওই আকাশে হাস্নাহেনার ঘ্রাণে—দেবদূতেরা আসবে উড়ে মানব শিশুর টানে। বিশ্ব হবে সুখের স্বর্গ, থাকবে না বিদ্বেষ—মেঘের ভেলায় উড়বে শিশু, দেখবে পরীর দেশ। কিন্তু কোথায় সে-সব স্বপন, মানুষ করে খুন—রাবণ ভরা বিশ্ব এখন শরীর ভরা তূণ।
অন্তরে সব বিষের ঘড়া, চোখে আগুন জ্বলে—হৃদয় এখন মৌন পাহাড়, পাথর কথা বলে। দিন-দুপুরে রাত্রি নামে গভীর অন্ধকার—যে দিকে চোখ যায় দেখা যায় সবই বন্ধদ্বার। কোন মরুতে মুখ লুকালে বিশ্ববিবেক আজ? মরছে দেখো তোমার শিশুই, মারছে রাবণ রাজ। রাম হয়ে আজ আসো তুমি, গাণ্ডিবে হাত রাখো—পৃথিবীকে ভালোবাসার ছায়ায়-মায়ায় ঢাকো।
রাকিবুল রকির অনুবাদে ফিলিস্তিনি দুই কবির কবিতা
০১.
আমি লিখতে চাই দেশ ।। নাজওয়ান দারবিশ
আমি লিখতে চাই দেশ
চাই শব্দগুলো
নিজেরাই দেশ হয়ে যাক।
অথচ আমি নিজেই এখন রোমানদের খোদাই করা মূর্তি
আর যাকে ভুলে গেছে আরববাসী।
উপনিবেশকারীগণ চুরি করেছে আমার কাটা হাত
সাজিয়ে রেখেছে জাদুঘরে।
ব্যাপার না। আমি এখনো লিখতে চাই—
দেশ।
সবখানে ছড়ানো আমার শব্দ
আর নীরবতাই আমার গল্প।
[নাজওয়ান দারবিশ ১৯৭৮ সালে জেরুজালেমে জন্ম গ্রহণ করেছেন। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা আটটি। বিশটিরও বেশি ভাষায় তাঁর লেখা অনূদিত হয়েছে।]
০২.
একদিন তারাহীন রাতে ।। মোসাব আবু তোহা
একদিন তারাহীন রাতে
ঘুমহীন চোখে এপাশ-ওপাশ করছি
পৃথিবী উঠলো কেঁপে মুহুর্মুহু
আমি ছিটকে পড়লাম বিছানা থেকে,
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তাকালাম বাইরে
ঘরের দরজা দাঁড়িয়ে নেই আর
মাটিতে শুয়ে আছে বিছানো কার্পেটের মতো,
মিসাইলের আঘাতে লণ্ডভণ্ড, পা ছাড়াই আকাশে
উড়ছে গাবদা চটিজুতো।
কখনোই জানা হতো না আমার প্রতিবেশী এখনো ছোট্ট টিভির সামনে বসে আছে,
দেয়ালে ঝুলছে পুরোনো চিত্রকর্ম,
তাদের বিড়ালের আছে কতগুলো ছানা।
[মোসাব আবু তোহা ১৯৯২ সালে ফিলিস্তিনের আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম কাব্য ‘থিংস ইউ মে ফাইন্ড হিডেন ইন মাই ইয়ার’ (২০২২)-এর জন্য প্যালেস্টাইন বুক অ্যাওয়ার্ড ও আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। তাঁর দ্বিতীয় কাব্য ‘ফরেস্ট অব নয়েজ’ প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালে।]