ম্যালানকোলিক গল্প
বিকেলের গল্পগুলো খুব ম্যালানকোলিক হয়
পেন্ডুলামে ঝুলে থাকে স্মৃতিরা
যাযাবর হয়ে ইতস্তত ঘোরাঘুরির পর
গোলকধাঁধায় আঁটকে থাকে অভিমানগুলো
আর কিছুটা দুশ্চিন্তা ঝুলে আছে জংধরা বিষণ্ন রেলিঙের গায়
ডানাহীন আলোয় অতীত ছলকে ছলকে পড়ে
কাঁচপোকাদের রি-রি সালিশের ভিড়ে
ঘুমহীন ছিপিতে আটকানো শিশি
সোপ অপেরা ম্যাপল পাতার ওপর লেখা হয়
এদিকে সংবাদপত্রে এসেছে নিখোঁজ সংবাদ
ট্রামে চড়ে বসা ক্রমশ ছোট হয়ে যাওয়া
উপন্যাসের শেষ চরিত্রটিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও।
ওর হাতে ছিল নিভে যাওয়া একটি রুমাল।
দস্তখত
গাছের বাকলে লেখা নাম মুছে গেলে
মিথ্যে করে লেখা চিঠিটির জন্য তবে
কেন হয় এত শোক! চোখের ওপর
আরেকটি মৃত দিন খসে গেলে জেনে
গেছি, সীমারেখা ভেঙে ফেলেছে শেখানো
ভণিতা। তবু মাটির সিথানে হেঁটে যেতেই বুঝেছি
হারিয়ে ফেলেছি কবে আমি নিজেরই দস্তখত!
স্বপ্নচারী
জলরাশি ছাড়ালেই সামনে আফ্রিকার বিষণ্ন উপকূল
আন্দালুসিয়ার সোনালি বালুকাবেলা
নীল জামদানি আকাশের ক্যানভাসে নাক্ষত্রিক উপাচার
লাবণ্য ছড়ায়, ধু ধু প্রান্তর
রূপসী পানির ধারা শব্দস্রোতের মতো উজ্জ্বল,
বড় চেনা মনে হয়। যুগ যুগ ধরে পাথর ভেঙে চলে
নেশাতুর এক ধূসর শ্রমিক।
নিরুত্তাপ নদীর বুক চিরে নিবিড় বিচ্ছেদ তুলেছে যে পাহাড়,
তারই গা থেকে খুলে নেয় একটি একটি করে পাথর
অ্যামারাল্ড, অ্যামারাল্ড পেতে হবে তাকে!
ক্যালেন্ডারের শেষের তারিখের মতো নৈঃশব্দ্যে ঢেকে আছে
শেষ পাথরটি, পৃথিবীর সুন্দরতম অ্যামারাল্ড।
বহুবছরের রাগ-ক্ষোভ-ক্ষুধা, মেঘকালো আঁধার জমেছে
শ্রমিকের নিস্তরঙ্গ মনে
দৃষ্টি সীমানার বহুদূরে পাথরটি ছুড়ে মারে সে
হেঁটে যায় অজানার পথে।
জীবনের শুরুতেই মানুষ জেনে যায় তার লক্ষ্য
তবু হাল ছেড়ে দেয় সে।
তুমি কি আমার সঙ্গে দাবা খেলবে
পাথর বাঁধানো পথে
অভরায়ণ্যের সীমানা ছাড়িয়ে বহু দূর চলে গেছে
তুষার ধবল শৃঙ্গ!
এই মাত্র শেষ সিকোয়েন্সে এসে
আটকে গেছে দৃশ্যপট
কী এক ব্যঙ্গের ইঙ্গিত দিলেন
মহাশয় বারগমান!
দশ বছরের ধর্মযুদ্ধ শেষে রনক্লান্ত নাইট ব্লকের মুখোমুখি মৃত্যুদূত
এ কী! তার ফ্যাকাসে মুখের হাসি
উজ্জ্বল লুব্ধক চোখ
যেন দীর্ঘ কৃষ্ণ পোশাকের ধূর্তমূর্তি এক!
অতপর মৃত্যু প্রশ্ন করে নাইটকে
তুমি কি প্রস্তুত?
নাইটের উত্তর, আমার দেহ প্রস্তুত হে,
মাহামান্য মৃত্যুবর! কিন্তু আত্মা নয়!
তুমি কি আমার সঙ্গে দাবা খেলতে প্রস্তুত?–নাইট জানতে চায়
মৃত্যু ব্যঙ্গ হাসে, কিন্তু রাজি হয়
হায়বিধি! দশ বছরের ক্লান্তিকর ধর্মযুদ্ধ শেষে
অগত্যা নাইট চায় কিছুক্ষণ সময় মৃত্যুর কাছে এসে…
জানতে চায়, ঈশ্বর কি সত্যি আছে?
মৃত্যু ভেংচি হাসে, বলে,
ঈশ্বর সম্পর্কে উদাসীন আমি আছি
তবু মেয়েদের খুব ভালোবাসি।
নোটবুক
প্রতিদিন নিয়ম করেই লিখছি নোটবুক
ভাবনাগুলো তবু তন্ময় ঢেউয়ে বাঁধা
কাঁপায় শিল্পের মতো ঘোরগ্রস্ত প্রকৃতিকে
অফসেটে ভুলভাল অভিনয় টুকে রাখি
তবু কোনদিন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন শুনতে শুনতে যদি
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়
বরফের কুচি এনে দেয় কোলাহল
আকাঙ্ক্ষার অতলে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরবো
ভীষণ নার্ভাস তোমাকেই
আর নিমগ্নতা প্রতি পায়ে পায়ে কাছে এসে
বেদনার জলে মিশে হয় নীল আর শাদা
অনুমতি দাও এবার আমায় মরীচিকা
অনাবৃত জীবনে বাজাই তৃষাতুর মদির সানাই
কবিতার গায়ে ঝরে পড়ি ফুল হয়ে।
মৌনতা ভেঙেছে বৃষ্টি
মৌনতা ভেঙেছে বৃষ্টি নেমেছে ঝর্ণায় মৃদুমন্দ
ঈষৎ শিশির ছুঁয়ে দক্ষিণে মেতেছে কলরব
দূর পাহাড়ের উঁচু চূড়ায় জমেছে মেঘমন্দ্র
শূন্য বালিয়াড়ি পেতে রেখেছে না-জানা নদীপথ
ছাতিমের ঘ্রাণে কত মেদুর আকুতি মনে পড়ে
গাছের শাখায় ঝুলে বাবুই পাখির পাশে বসে
আর্দ্রতা লুকিয়ে রেখে শুকনো ফাটলে মাঠ ভরে
শুকিয়ে যাওয়া মন রোদে পোড়া দেহ ভিজে রসে
নদী ও বৃক্ষের চোখে প্লাবনে জেগেছে অবশেষে
মঙ্গলসুধার মতো অজস্রধারায় রাত বৃষ্টি
নতুন ফসলে থাকে বিপন্ন আয়ুর স্বপ্ন মেশে
বিন্দুতে বিন্দুতে মেঘ জলের ছায়ায় হয় সৃষ্টি
জ্বরতপ্ত মানুষেরা জলের বিলাপে তড়পায়
উদাসী মেঘের তরে চাতকের মতো পিপাসায়।
বৃন্দাবনে রাধিকা
টিলার ওপরে তীব্র রোদে ছিল ছায়ার বালিকা
শীতল বাতাস কেটে শ্যাম আসে কুয়াশার মাঝে
হৃদয়ে এখন হিম, মৌনতায়, উদ্বেল রাধিকা
জেগেছে ঘুমন্ত রাধা বৃন্দাবনে হরিণীর সাজে
শ্যামল নিস্বন বনে বিচ্ছুরিত আলো গলে
আনন্দধারার মতো দুর্বিনীত লোহিত নেশায়
দুপাশে চিরহরিৎ গুল্মগুলো পেন্ডুলামে দোলে
রাতে নক্ষত্র পতন মহাশূন্যে, মন্দির চূড়ায়
এঁকেবেঁকে পথ চলে বালুচরি হারানো নদীতে
দূরের আকাশে খোলা পূর্ণিমায় চাঁদের জোনাকি
আকাশগঙ্গার পাড়ে আঁচলের সোনালু বালুতে
উঁচুনিচু সারিসারি মেঘ নাচে আনন্দে একাকী
ঈশানের কোনে দেখা মাতালের তৃষাতুর স্বপ্নে
অরণ্যের স্নেহমাটি মিশে থাকে আদুল জীবনে।
নির্বাসন
প্রতিদিন একটু একটু করে
মৃত্যুর রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে
তৃষ্ণায় শুকিয়ে গেছি
তবু এ অবরোধের কালে
নিজস্ব স্মৃতির হাত থেকে
রক্ষা পেতে
বারবার সেই পথেই হেঁটেছি
যা কোন গন্তব্যে পৌঁছেনি কখনো
কোন পরিচয় ছিল না আমার
ঠিকানা ছিল না কোন
তবু সন্ধ্যে হলে
গলির ভেতর দেখা যায়
সুদীর্ঘ নিবাস
সেখানেই নীরস গ্রীষ্মের জন্য
কেউ হয়তো প্রতীক্ষারত
যতবার ভাবি বৃষ্টি হলে
অন্ধকার ধুয়ে ধুয়ে কিছুটা স্নিদ্ধতা এনে দেবে কেউ
শুধু ভুল, শুধু ভুল মনে হয়
আসলে প্রতিটি অনুভূতি
এখানে লিখছে শুধু
বেদনার স্বরলিপি
প্রতিটি মুকুল ঝরে গেছে ঝড়ে…
প্ল্যানচেট
দীর্ঘ খাটিয়ার নৈঃশব্দ্যে
সময়কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি দ্যাখো
জীবনকে বলেছি অপেক্ষা করো মাটির বাংকারে
তখনো সময় ছিল খুব গতিময়
ঐ দূর সমদ্র থেকে অ্যালবাট্রাসের তীব্র হাতছানি
মানুষের শূন্যতাকে তারা কাছে ডেকে নেয়
আর ফেরার প্রহর শেষ হয়ে গেছে বলে
পাখিগুলো সব আত্মহত্যা করেছে
শিশুগাছের ছায়ায় ওদের শুয়িয়ে রেখে
আমি প্ল্যানচেটে বসেছিলাম,
এদিকে গ্রীষ্মের বাতাস তপ্ত হয়ে
এনেস্থেসিয়ার প্রভাব কেটে যেতেই
অসুখী মানুষগুলো সব ঝিঁঝিপোকা হয়ে গেলো…
রাত
এখানে অনেক রাত বিছানা পেতেছে অন্ধকার
চোখের ভেতর জড়িয়ে যাওয়া রাস্তা
সাদা শালুকের মতো ভেসে
থাকে, সিঁড়িতে ঝুলন্ত ঘুম
দু’চোখের বিস্মৃতিতে ডুবে
গেছে। অস্তিত্ব উপড়ে ফেলে
এতো আলো জ্বেলো না ঈশ্বর
বিস্মৃতি এসে ওষ্ঠ ও অধরে আশ্রয় করে নিলে
ব্যাকুলতা লীন হয়ে যায় জেনেও কী করে তুমি
ললাটের রেখাগুলো মুছে দিতে চাও?