মোমঘর
আমার ভেতর একটি অন্তর্মুখী নদী গান করে।
ছায়াশূন্য একটি নদী
প্রবাহিত হচ্ছে মুখোমুখি স্রোতে;
কয়েকটি নরমমুখী ফুল
ধারালো স্রোতের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে
আমার ভেতর প্রজাপতি উড়ে
মৃত প্রজাপতি ভেবে ফু দিচ্ছে হাওয়াকল
একগুচ্ছ ফুলের ভেতর নুয়ে আছে অনুতাপ
আমার ভেতর একটি অন্ধপাখি গান করে।
পাখির শরীর থেকে ক্রমাগত
খসে যাচ্ছে সোনালি পালক;
কয়েকটি ঘুণপোকা
পালকের শরীর বেয়ে হেঁটে যাচ্ছে
আমার ভেতর মৌমাছিরা ওড়ে
মৌমাছিরা উড়ে যাচ্ছে ছড়ানো সৌরভের দিকে
মাটির বিপরীতে হেঁটে যাচ্ছে তাদের ছায়া
আমার ভেতর একটি বিষণ্ন আকাশ গান করে
প্রায় অন্ধ একখণ্ড আকাশ
ক্রমাগত নুয়ে যাচ্ছে মায়াবী বিষণ্নতায়;
কয়েকটি দুর্গা-টুনটুনি
মহুয়া বনের বিপরীতে হেঁটে যাচ্ছে
আমার ভেতর মেঘ বালিকারা ওড়ে
ছায়াঘুমে ফিরে যাচ্ছে অনুরুদ্ধ মেঘদূত
দুটি অগ্নিমুখী সাপ পাশাপাশি মোমঘরে!
এপিটাফ
নিমগ্ন প্রাচীন বৃক্ষজলে তার ছায়া
কাঁপে, আর বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার আঁধারে
ডুবে চাঁদ কিংবা কুসুমের গাঢ়ঘুমে
স্পর্শে জ্বলে ওঠে। এই বুঝি অকস্মাৎ
নেমে আসে রাত, এই বুঝি জলস্রোত
ছুঁয়ে দেয় রতিবিদ্ধ মাছের শরীর।
নিমগ্ন প্রাচীন বৃক্ষতীব্র তীক্ষ্ণ হিমে
শুয়ে আছে নিরুত্তর জলের মৃন্ময়,
আর তার দেহে, খাঁজে কিংবা উৎকীর্ণ
শস্যের দানায় গ্রন্থিত রয়েছে স্থির;
এই পৃথিবীর আদিমতম কথন।
সংবৃত শ্লোক
পাতা পতনের শব্দে
উড়ে যাচ্ছে
সবুজ ঘাসফড়িঙ,
মৃত
পাখিদের নিয়ে
বসে আছে রাত্রি।
আমি খাম খুলে রঙগুলো
উড়িয়ে দিলাম
রাত্রিকে একাকি
নগ্ন রেখে
চাঁদ চলে গেলে
মৃত নদী হেসে ওঠে
আমি ছায়া বিক্রি করি
জোনাকিদের আলোয়…
নিবিড় আমাকে ডাকে কীর্তিনাশা।
একটি শীর্ণ নদী
ডোবা কিংবা জলে!
তার অন্ধকারে বালির আড়ালে।
একটি যুগল চোখ,
নুয়ে আছে নির্ণীত জমিনে…
শিকারি চতুর।
মানুষের লাশগুলো গুনে গুনে রাখা,
এর বাইরেও কিছু আছে—নিপুণ সার্কাসে।
বিমূর্ত স্বর
জেলের নৌকায় বসে তুমি উড়ন্ত মাছের খেলা দ্যাখো,
আর কাঁকর বিছানো পথে একটি বেড়াল দৌড়ে যাচ্ছে
এই দৃশ্য দুটি আমি পাশাপাশি
এঁকে যাচ্ছি ক্যানভাসে
বারবার বদলে যায় আদল
প্রতিটি প্রাণের ভেতরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে বিনাশ।
অনন্তের নিসর্গ কন্যারা শুয়ে আছে নক্ষত্রের বনে
আর একটি অন্ধকার দীর্ঘায়িত হচ্ছে
সমর্পিত ছায়ার ভেতর।
এসবই নির্ণীত খোলসাবৃত
এবং দৃশ্যমান
ক্রমাগত ক্রিয়াশীল প্রাণে ও উদ্ভিদে…
দ্বিধান্বিত মানুষেরা ভীতু ও সাহসী,
বৃক্ষের শেকড়ে জমা থাকে জলজ আখ্যান।
শাদা মৃত্যুর ভেতর একাকি নিঃসঙ্গতা, অনিশ্চিত রাত্রি
কী নিপুণ ছায়া বিকশিত হচ্ছে একখণ্ড ঘুমে;
আর আস্ত একটি আকাশ শুয়ে আছে সমর্পিত ফ্রাইপেন
শাদা মৃত্যুর ভেতর সমর্পণ,
উড়ন্ত পাখপাখালি।
চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো প্রসন্নতা;
হাওয়ার ভেতর ঘুরছে জলকল,
খণ্ড-খণ্ড নদী ভারী হয় স্নান ঘরে।
শাদা মৃত্যুর ভেতর শঙ্খচূড়, বিষাক্ত ময়াল
ক্রমাগত দৃশ্যমান ছায়া-অন্ধ মানুষের জিভ।
শব্দ
শব্দ কি কেবল অলুপ্ত স্বর, সারিবদ্ধ অক্ষর
শ্বাসমূলে জমে থাকা বিষণ্ন রোদ্দুর
শব্দ কি ভেঙে যাওয়া ঢেউ, টুকরো টুকরো ছল
নগ্নপায়ে হেঁটে যাওয়া এক নিরুত্তাপ দুপুর—
শব্দ কি পাতা ঝরার গান, মৃত শালিকের ডানা
ফাতনার বনে-ঝোপে শুয়ে থাকা নিদ্রালুপ্ত ফাঁদ?
আমার ভেতর অপূর্ণ শব্দরা অবিরাম হাঁটে,
অহর্নিশ ছুঁয়ে দেয় ঈশ্বরের নির্ণীত আকাশ—
অন্ধকারে ফুটে থাকে অলক্ত বাহারি ফুলে।
আমার ভেতর অপূর্ণ শব্দরা দৃশ্যত নির্জনে
কিংবা ছায়া-অন্ধ তীব্র হিমে,
শুয়ে থাকে সংহিতার ঘুমন্ত শহরে।
টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাওয়ার পর
রক্তবীজের মতো গড়িয়ে পড়েছি
ধুলোয়,
বদলে যাচ্ছি শব্দে, সুরে ও বীজে …
ঔষধি লতার মতো নুয়ে আছি ফুলে।
কয়েকটি শাদা মৌমাছি অনতিদূরে
মধু সংগ্রহে ক্রিয়াশীল থেকেও
মৃত চাঁদের গহক্ষরে ডুবে যাচ্ছে অবসাদে।
প্রেম
পুড়ে যাক দু’দশটি ক্ষয়িষ্ণু শিশু,
তাতে আমাদের কী যায় আসে ।
বার-বি-কিউর ঝাঁঝালো গন্ধের মতো
একটি সকাল এসে সামনে দাঁড়ালে
আমাদের প্রতিটি দুপুর
উৎসবমুখর হতে হতে সন্ধ্যা নামে…
বিহারীদের কাবাব সুস্বাদু জেনে ফের
আমরা ক্যাম্পে যাই ।
গীত
রাত্রির শরীর থেকে নেমে এলে ঘুম
মেঘের নিবাসে জমে জলজ বিনাশ
কিছু কথা ফুটে থাকে নিষিদ্ধ উঠোনে
গোলাপের অর্চি থেকে কামের ধনুতে
ভূমির অলিন্দ থেকে নক্ষত্রের বনে
ফুটে আছে আত্মমগ্ন বিষাদ কুসুম
পানের শরীরে আঁকা প্রতিটি চুম্বনে
শুষে নেয় স্বপ্ন-তেজ পতিত জমিন
বৃষ্টির বাহুতে বসে নিদ্রামগ্ন চাঁদ
কিছু ভুলে ঝুলে থাকে কিছু শুদ্ধস্বর
হরিণীর দলছুট তাড়িত কম্পনে
পড়ে থাকে দীক্ষা-কাল বিপরীত স্রোত
পাখীদের জানা নেই ভাষা শিক্ষা জ্ঞান
তবু তো গীত হয় মধুর সঙ্গীত
বেদনা বিলাপ আর আনন্ত্য উচ্ছ্বাসে
পৃথিবী বিভোর হয় শীতল সঙ্গমে
নিমগ্ন কথন
বিনীত মুদ্রার নিচে জ্বলে উঠে ত্রিকালজ্ঞ শিশু,
তার পাশ দিয়ে হেটে যায় স্বপ্নমগ্ন নদী,
জল আর মৎস্যের স্রোত।
জীবন একটি পলাতক ব্যাধি এই বলে
উড়ে যায় পাপবিদ্ধ স্বর ।
তুমি স্বপ্ন দেখো সে সৃজন করেছে গীত…
বিষণ্ণ কান্নায় পৃথিবীর রংগুলো একে একে
ফুটে ওঠে ইস্পাতের ছুরির ফলায়।
ছায়াচিত্র
১.
পাতা ঝরার পর দেখি
একটি অপূর্ণ বৃক্ষ
নিঃসঙ্গতার দিকে ঝুঁকে আছে আর
তার চারদিকে ডুবে যাচ্ছে ঈশ্বর।
মূলত অন্ধকার নেমে আসলে
ঈশ্বর পূর্ণ চাঁদ নিয়ে খেলা করে
তখন
শূন্যতাকে ছুঁয়ে থাকে জন্মান্ধ শূন্যতা
বস্তুত শূন্যতা কেবলই একটি সংখ্যা,
তাকে গুনে যাচ্ছি প্রবাহিত শূন্যতায়।
২.
রাত একটার ট্রেন আসলে আমরা পরস্পর
বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই আর স্টেশনটি
খণ্ডিত নিদ্রার ভেতর নিজেকে উন্মুক্ত করে দেয়।
তার স্তন যুগলে
ক্রিয়াশীল শিল্পের মতো
দ্রুতলয়ে ছড়িয়ে যায় আলো।
বস্তুত আমরা সমুদ্রকে সবুজ দেখতে চাই
এবং মাছকে ভ্রমণরত বৃক্ষ মনে করি।
৩.
বদলে যেতে যেতে খোলসটাই পড়ে আছে
দৃশ্যমান কেউ নেই,
আর আমার ভেতর ক্রমাগত বিবর্তিত হচ্ছে মাটি।
হাওয়া এসে অস্তিত্বের কথা বলে গেল…
প্রাণের অস্তিত্ব দৃশ্যত যূথবদ্ধ,
তার বিপরীতে নিঃসঙ্গতা সর্প স্বভাবের।
আধ ভাঙা জল নদীতে জোড়া দিতে এসে দেখি মরে যাচ্ছে নদী
৪.
শব্দ ঘুরে ঘুরে ফিরে যাচ্ছে
আর হাতের ওপর খেলা করছে রোদ্দুর।
ও আমার বিষ্ণুপ্রিয়া
বহুদিন হয়নি যাওয়া
নদীর ওপারে
নদীর ওপারে
কৃষ্ণ অন্ধকার—পতিত জীবন
ক্ষয়ে যাওয়া জলস্রোতথথ পূর্ণ অন্ধ চাঁদ ।
আমি একটি নগ্ন কবিতায় শুয়ে আছি
আর স্নানঘর থেকে ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে রাধা।
৫.
সড়ক থেকে নেমে এসেছি জলে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে
একটি পরিত্যক্ত আপেলের মতো ভেসে যাচ্ছি শূন্যে।
জড়তা কখনো জ্যোতির্ময় নয়…
আড়মোড়া ভেঙে শালিকের ঠোঁটে ধরা দিচ্ছে মাছ।
মাছরাঙাদের ফাঁকি দেয়ার আনন্দ সাময়িক এবং
পাখিদের ঠোঁটের স্বভাবে কোন ভিন্নতা নেই…
অন্ধকার নেমে এলে অবশিষ্ট কিছুই থাকে না জীবনের।
পুনর্বার আনন্দ বঞ্চিত হলে, অতি তুচ্ছ একটি মাছের
জীবনের যতি চিহ্ন পড়ে থাকে পাখিদের তীক্ষ্ণ ঠোঁটের গভীরে।