মৃত সড়কের মোড়
মানুষ সবসময়ই পথে দাঁড়াতে পারে না।
সব পথই এগিয়ে নিয়ে যায় না মানুষকে—
এমন গল্পকথা আমি অনেক আখ্যানেই পড়েছি;
জেনেছি ‘ডেড অ্যান্ড’ বলতে আসলে
. কোনো পথই জগতে চিহ্নিত নয়।
যে সড়ক বুকের ভেতরে ঢুকে পড়ে,
কিংবা যে হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে
যেতে যেতে তুমি আমাকে নিয়ে নিরুদ্দেশ
হয়ে যাও, তার নাম কী!
এমন কথা আমি কখনো তোমার কাছে
জানতে চাইনি! বরং এটাই চেয়েছি
এমন কোথাও যাই; যেখানে কেউ আমাদের
চিনবে না। জানবে না আমাদের গন্তব্য!
জানবে না কোথায় সাকিন ছিল আমাদের
অথবা এই সময়ে আমরা বাস্তুভিটহীন কি না!
পথ ও পথিকের একটা ভালোবাসা থাকে।
যারা যুদ্ধে যায়,
যারা অহত হয়ে পথে পড়ে থাকে—
তারাও জানে একদা তারা সামাজিক জীব ছিল।
একসময় তাদের জন্য,
খাদ্য বরাদ্দ করতো অগ্রহায়ণ মাস,
শরৎ এসে কাশফুলের পুজো দিতো;
তাদের পায়ে পায়ে—
অথবা বাসন্তিক সুর তুলে তাদের জন্য
গান গাইতো পরিযায়ী কোকিল!
আমি একবার মেঘের অনুবাদ করবো বলে
একটা হাওয়াময় অভিধান খুঁজছিলাম।
সেই খবর পেয়ে তুমি আমার জন্য
খুলে দিলে তোমার দীর্ঘ এলো চুল,
এবং বললে—
. ‘কোন স্টাইল বেছে নিতে চাও তুমি
লেয়ার্ড, কার্লি নাকি আফ্রো টেক্সার্ডের মাঝে
তুমি খুঁজতে চাও নতুন পথের সন্ধান!’
আমি কিছুটা অবাকই হলাম!
রেট্রো কিংবা কর্নরো হেয়ারস্টাইল দেখে
যে আমি অভ্যস্ত ছিলাম এতদিন—
সেই আমারও জানা হয়ে গেলো,
কেশবিন্যাশেরও একটি সংবিধান আছে!
অথচ জগতে অনেক মানুষেরই পথবিহীন
ভ্রমণ; লেখা থাকে বৃক্ষে, পাতায়, পরিচ্ছদে।
কোনো মানুষ তা লিখে রাখে না!
সূর্য যেদিন তার প্রিয়তমাকে ছেড়ে
ভিন্ন পথে হারিয়ে গিয়েছিল,
সেদিনই মানুষ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল
আলো বিতরণের দায়িত্ব!
রনেশ স্যারের ভূগোলের ক্লাশে
এমন পাঠই আমি পেয়েছিলাম সপ্তম শ্রেণীতে!
আর জেনেছিলাম এই যে হলিউড নগরী,
এই যে প্যারিসের আইফেল টাওয়ার
সবই ভূগোলের চর্চিত বিষয়। ক্যালিফোর্নিয়ায়
মাঝে মাঝে যে আগ্নেয়গিরি ফুঁসে ওঠে-
সেটাও পথ না পেয়েই প্রবাহিত হয়
পাতালের ভিন্নকক্ষে—
পোড়ে বন-বাদাড়, পোড়ে পশু-পাখি
মানুষ নতুন পথ খুঁজেই শহর বদলায়।
জানি, বদলের গল্প তোমার প্রিয় পাঠ্যবিষয়।
হাড়ের সংসার পেতে যে রমণী করে জীবন যাপন
বাঁকের বিবর্তন চেয়ে যে পুরুষ নদীমুখী হয়
এরা সকলেই নতুন পথের দিশা চেয়েছিল!
এরা সকলেই মনে করেছিল;
মানুষ ক্লান্তির সন্ন্যাস পেরিয়ে গেলেই সুখি হয়!
কিন্তু তারা জানতো না,
শুধু প্রকৃতিই শোধন করতে পারে
ধুলোময় স্মৃতির সকল সঞ্চিত বিষাদ।
যে পথে লুকিয়ে থাকে প্রাণের আলিঙ্গন
যে জ্যোৎস্না সুদূরের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে তার
সখার অপেক্ষা করে;
আমি সেই পথের বেদনাও পড়েছি
ফেনিল আটলান্টিকের আয়নায়।
ঢেউ দেখতে দেখতে যেদিন আমি তাকে
স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম,
তখন তুমিই তো বলেছিলে—
সকল উষ্ণতা ছুঁয়ে দেখতে নেই;
সকল বিন্যাসকে ভাবতে নেই
. নিজের মতো করে!
প্রতিটি ভাষারও একটা পথ আছে।
প্রতিটি আদিবাসী অন্তর যখন
গভীর রাত্রির ছায়ায় দাঁড়িয়ে অনুধাবন করে
এই পথ দিয়েই গান গাইতে গাইতে
চলে গিয়েছিলেন প্রপিতামহ;
তখন তারও মনে পড়ে বিশ্বে লুপ্তপ্রায়
বর্ণমালার কথা—
মনে পড়ে এই বিশ্বরোডের পাশেই একাত্তরে
কয়েকমাস পড়ে থেকেছিল
বেআব্রু কিশোরীর শবদেহ; আর শকুনও
লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সেই পথ থেকে!
আমি এই পৃথিবীর সকল মৃত সড়কের
মোড়গুলো চিহ্নিত করতে চেয়েছি।
রেখে যেতে চেয়েছি কয়েকটি পথের কোলাজ-
ঈশানবর্ণ ধারণ করে যে পথিক
আমার পদে পদ মিলিয়ে হেঁটেছিল,
আমার নামের অক্ষরের সাথে অক্ষর মিলিয়ে
যে জোনাকি ছেড়েছিল গৃহবাস-
তাকে আমি কোনো প্রতিদানই দিতে পারি’নি।
সকল পথই প্রাণের আশ্রয় হয় না।
মিছিলে হাতে হাত রেখে যারা একসময়
অতিক্রম করেছিল পথ,
দেয়ালে দেয়ালে তাদের নাম লেখা থাকে—
অথচ অনেকেই মাটির আনুগত্যে
নিজের নাম ভুলে যায়, নিজের ভবিষ্যত ভুলে যায়।
আরও পড়ুন: দীর্ঘ কবিতা