বন্দনা
প্রথমে বন্দনা করি গ্রাম নালিহুরী। ছাড়িয়াছি তার মায়া যেন কাটাঘুড়ি॥ পরেতে বন্দনা করি আকাশ পাতাল। পিতামাতা দেশ ছাড়া হয়েছি মাতাল॥ পুবেতে বন্দনা করি নাম তার মনু। এমনি নদীর রূপ উছলে ওঠা তনু॥ উত্তরে বন্দনা করি শ্রীহট্ট নগর। সে তো থাকে মন মাঝে অনন্ত অনড়॥ পশ্চিমে বন্দনা করি লেখাবিল নাম। এ-জীবন তার তরে তুলেছি নিলাম॥ দক্ষিণে বন্দনা করি নাম শ্রীমঙ্গল। দেখিয়াছি টিলারূপ কুহকী জঙ্গল॥
মৌলভীবাজার-কথা কী কহিবো আর। সে তো জানি প্রাণসখা বন্দনা অপার॥ চারদিক বন্দি শেষে মন করি স্থির। ধরিয়াছে এই দেহ দেশের জিকির॥ বন্দনা করিয়া সারা মধ্যে করি ভর। আসো গো কবির সখা বৈদেশ নগর॥ ভিনবাসে ঘুরিফিরি তিষ্ঠ ক্ষণকাল। পয়ারে মজেছে মন বাসনা বেহাল॥ পদ্য বাঁধি গদ্য বাঁধি সুরকানা আমি। ইরম হয়েছে ফানা জানে অন্তর্যামী॥
সাং নালিহুরী
নিজ নামে ডাক দিলে কেঁপে ওঠে অতলান্ত পথের গরিমা। যা কিছু জন্মে পাওয়া…যা কিছু নালিহুরী…যা কিছু নিজনাম…নিজদেশ…নিজস্ব নিয়ম…জেগে ওঠে নিজ কোলাহল।
মানুষ কেবলি হাঁটে সীমাবদ্ধ জলে। যদিও বা কেউ কেউ হেঁটে আসে গ্রিস। আরও দূর ছুঁয়ে আসে মাথুউজেলা গাছের বয়স। আমাজান হ্রদের শরীর। অতপর স্ট্রবেরি ক্ষেতের পাশে একটু জিরিয়ে নিয়ে যদি বা কেউ নিদ্রামগ্ন হয়, ঠিক তখনি তার নিজনামে ডেকে ওঠে কেউ।
মানুষ কেবলি ভুলে নিজ সাং, নিজস্ব আয়াত। তারপর ঘুরেফিরে পঞ্চনদী—নিজের নিকটে এসে ধরা পড়ে যথার্থ নিয়মে। আজ এ-ভোরবেলায় এ বড়ো সত্য বাণী ভাবিলো ইরমে।
আঁতুড়ভয়
জন্মের আগেই জন্ম হলো ভয়। তাবিজ-কবজ দিয়ে সাজানো পুলি। ভাঙা লাঙল আর ছেঁড়া জাল, ধোঁয়ার কুণ্ডলী হাসে দরজার কাছে। কান্নার কাছেই ছিলো পিতার আজান।
ছিলাম পরীর ডানা কেনো পিতা ঝরালে পালক?
ভুলেও থাকিনি একা। শিশু ছিলে—টাকরাটুকরি যদি নেয় তুলে! বটের গভীর কাছে যে শিশুরা প্রেতের দোসর, শীতের হাওর জুড়ে মক্কল আগুন—ছিল সব নিরাপদ দূরে।
রাত হলে বুড়ো সুরে হুতুম! হুতুম!! আগুনে দিয়েছে মা শস্যদানা আর সালন হলুদ। তবু ভয় যদি পায় প্রেতিনীর ছায়া!
পূর্ণিমা উঠানে মধ্যরাতে আলো খুঁড়ে একপাল অশরীরী ভেড়া। পুবের টিনের চালে ঢিল পড়ে, গাবগাছ দোষের প্রাচীর। এই ভয় ছিলো মাগো যদি পায় অশুভ আছর! পিতার বাজার থেকে কালিবাউশ হলো না কিনা। শেওড়া গাছের ভূত যদি সাথে আসে? কাটা হলো তেঁতুলের প্রাচীন ছায়া।
কী করে ফেরাবে মাগো! নই শিশু, ঝরে গেছে পরীদের ডানা। শানেবান্ধা ক্ষত নিয়ে সপ্তডিঙ্গা নগরে ভাসে।
স্বল্প মাত্রার দীর্ঘশ্বাস
শৈশবে ফুটবলে হেড দেবার মতো আলোতে হেড দিলাম পড়ে গেলাম অন্ধকারে। কনি আঙুলে নাচাতে নাচাতে অন্ধকার ফেটে পড়লো নগ্ন ত্বকে। মাতৃ জরায়ুতে হেড দেবার প্রথম হাতেখড়ি।
আমার ব্যারাম হতো—নগ্ন হতাম। বাড়ির মহিলারা আমার নুনুতে খেলা করতে করতে—সোনামণি ঘুম যাও, চাঁদ মামা টিপ দেবে কপালে, জুলেখা বাদশার মেয়ে তার ভারি অহঙ্কার—কোরাস গাইতো। আমার নগ্নতা বড়ো পবিত্র ছিলো। বড়ো অবাধ্য সুন্দর ছিল আমার পুরুষাঙ্গ।
অমোঘ বিশ্বাসে আমার বাড়তি চামড়া যেদিন কর্তন হলো—এখনো অনুভবে হাত রাখি—বুঝি না উৎসবে কী নৃশংস উল্লাস ছিল! সেদিন রক্তকে বড় ভয়, বড় ঘৃণা, বড় ভালো লেগেছিল। কিশোরীরা হাসছিল, রক্ত ঝরছিল আমার শরমিন্দা ত্বকে।
এখনও তো কর্তনমুক্ত রক্ত ঝরে। আমি আলোতে হেড দিতে যেয়ে পড়ে যাই অন্ধকারে। অন্ধকারে বড় ভয়, বড় আনন্দ হয়। আমি নগ্ন হই। একদিন মায়ের কাছে আমার এই নগ্নতা বড়ো পবিত্র ছিল।
শ্রীহট্টকীর্তন
এ নগর জানে—কেন আমি একদিন বাড়িছাড়া হই, ঘরহারা হই!…শ্রীহট্ট নগর হে, তুমি কেন দিয়েছিলে ডাক? আমার কি আর সাধ ছিল তীর্থযাত্রী হবো? তোমার কাছেই আমি শিখিয়াছি কী করে হারাতে হয়, কী করে হতে হয় ভিড়ের মানুষ! আর যারা মিনতি জানায়, পিছু ডাকে—আমি কী রে ফিরিবো না আর বালুচরে, টিলাগড়ে, সুরমস নগরে! বলিও তাদের কাছে—আমি তো প্রাচীন এক কুয়ার ভিতর আটকে আছি স্বর্ণরঙ্গা মাছ, শেওলা ধরা অন্ধকারে দিয়ে যাচ্ছি রঙ্গের ঝিলিক, কেউ কোথাও পাবে না আর, দূরের নগরে আমি নিখোঁজ মানুষ।
ইতিবৃত্ত: পূর্বাংশ
তুমি কোন মুল্লুকের মৌলবি গো? তোমার আলখাল্লায় লেগে আছে সিঁদুরের দাগ, তোমার সফেদ পাঞ্জাবিতে ধূপধুনি আতরের ঘ্রাণ, তোমার গলায় ওঠে কীর্তন জিকির, তুমিও পীরের দেশে পীর হয়ে কাটিয়েছো দিন, তুমিও বৈষ্ণব হয়ে বৈষ্ণবীর খুঁজে গাঁয়ে গাঁয়ে গেয়ে গেছো বেদনার গীত, তুমি দেখি ধরে আছো নানা কিসিমের বেশ, নানা উপাধি, তুমি কি গো এই গাঁয়ে পরদেশি পীর? পরদেশি সন্ন্যাসী ফকির? তোমার দোতারা কার ইবাদত করে গো হজরত? তোমার তসবিদানা কোন মন্ত্র জপে? মন্দির মসজিদে তুমি করো যাতায়াত, আজান ও উলুধ্বনি একই কণ্ঠে ধরো, এ কোন দেশের মুসল্লি গো তুমি? তোমার দেশের নদী ধরে বুঝি আল্লার জিকির, ধরে বুঝি দেবতার স্তুতি?
তোমাকে দেখেই আমি বুঝে গেছি—এ এক এমনি দেশ, এমনি তার রীতি, একই নদী ভরে ওঠে পানি ও জলেতে, এক জলসা রাঙ্গা হয় আদাবে সালামে!
আহাজারি
যে পুকুরে কলমি লতা ভাসে, যে পুকুরে কাঁঠাল ছায়া হাসে, যে পুকুরে পানা ফুলের ঢেউ, যে পুকুরে জোছনা ভাসায় কেউ, যে পুকুরে নাই হয়ে যায় চিতল মাছের ঘাই, আমি তারে লিখতে পারি নাই।
জাম্বুরা ফুল কেমন করে ফোটে, ভাটি ফুল কেমন করে চিত্তমায়া লুটে, কেমন করে শুকনা খালে ফুলের দেখা পাই, আমি তারে লিখতে পারি নাই।
ইরি ক্ষেতে পাকনা ধানের হাসি, মাছ চলাচল করে, নিঝুম সন্ধ্যায় বৃষ্টি জলে ভাসি, জল ফিসফিস করে, রোদ থৈ থৈ রোদ থৈ থৈ ডাক শুনতে পাই, আমি তারে লিখতে পারি নাই।
ও আমার বিল ভাসানো নয়া পানির রূপ, কোড়া ডাকে কোড়া ডাকে দুপুর বেলা চুপ, ও আমার রাস্তা ডুবা হঠাৎ ঢলের স্রোত, কোথায় গেলো কোথায় গেলো, তার দেখা ফের চাই, আমি তারে লিখতে পারি নাই, আমি তারে লিখতে পারি নাই।
দেশি কবিতা
বাড়ির পাশে কাঁঠাল গাছ কাঁঠাল ধরে ডালে, আইসো বাড়ি কেউ বলেনি জ্যৈষ্ঠমাসী কালে। বাড়ির পাশে আমের গাছ বাতাস এলে নড়ে, এই কথাটি লিখতে গিয়ে চোখের জল পড়ে। বাড়ির পাশে জামের গাছ জাম পেকেছে কালো, দেশের ফল দেশের ফুল তোমরা থেকো ভালো।
ঘরের পাশে ডালিম গাছ ডালিম ধরে লাল, বৈদেশেতে আছি কেমন জিগাও না তো হাল। ঘরের পাশে বরই গাছ মিঠা বরই তাতে, তোমার কথা পড়ছে মনে বৈদেশীয়া রাতে। ঘরের পাশে ডুমুর গাছ ডুমুর ধরে আছে, তোমার ডাক না-পাই যদি বৈদেশী মন বাঁচে!
ভালা থাইকো তোমরা সবে আমি খবর লইবো, দুখী ইরম জিতে মইলে কার কী আর অইবো!
কবিবংশ
সেই কবে ভাববশে ভুলিয়াছি ধাম, বিপ্রদাশ পিপিলাই ধরিয়াছি নাম। জয়দেব হয়ে রচি গোবিন্দের গীত, ছিটিয়েছি পুষ্পঢেউ কামের কিরিচ। রচিয়াছি চম্পূকাব্য কোনো এক কালে, বন্দনা করেছি কতো আনে আর বানে। আমিও শ্রীহট্টে জন্মে রাধারূপ ধরি, কবেই ছেড়েছি বাড়ি শব্দ শব্দ জপি। জৈন্তা পাহাড়ে ইরম দেখিয়াছি রূপ, বামেতে বন্ধুবাড়ি ডানেতে অসুখ। তবুও আলোর ডাক তবুও স্বপন, শ্রীহট্টে জন্মিয়া ভ্রমি বিস্তীর্ণ ভুবন। রচিতে প্রেমের শ্লোক তুচ্ছ করি কাম, বলেছি সহস্র বার নারীকে প্রণাম। জমিয়েছি দূরবাসে একজন্ম ঋণ, অকূল পাথারে ভাসি দলহারা মীন। সন্ধ্যাভাষা ভুলি নাই গুহ্য অন্ত্যমিল, আমারও রক্তে ছোটে চর্যার হরিণ।
লীলাসূত্র
শব্দ বড়ো যাদু জানে যাদু জানে গো!
দিবস-রজনী আমি ফানা হয়ে থাকি। আসবে বলে আমার কুঞ্জে কান্না ফেরি করি। নৌকাবিলাসে হঠাৎ মত্ত হয়ে দেখি, বিরহে কেটেছে দিন শব্দ শব্দ জপি! আর কি হবে না নদী জলে টলমল? আর কি হবে না লীলা বন্ধু-সহচর? তাহাকে দেখিতে মন রজনী পোহায়, না-জানি কার কুঞ্জে থেকে আমাকে কাঁদায়!
তোমাকেই নিত্য জপে নির্ধনিয়ার ধন, ইরম করিছে সঙ্গি রজনী-রোদন।