মা
সাকিন জানি না ঠিক কোন দিকে যাব―উত্তরে দক্ষিণে পূর্বে বা পশ্চিমে;
অবোধ শিশুর মতো হামাগুড়ি দিই নীল জোছনার জলে হেমন্তেবসন্তে
কখনো দাঁড়িয়ে থাকি―গ্রীষ্মের দুপুরে পোড়া ট্রাফিক পুলিশ।
সবুজ ঘাসের জমি বসন্ত বাতাসে ছুটে চপল হরিণী―দূরে যেতে থাকি,
ভুলে যেতে থাকি অনায়াশে; নিশীথের নীল নৌকো খুঁজে সোনাদিয়া মাটি,
চকচকে গাড়ি লকলকে জিভে আমাকে তাড়ায়;
নীল মেঘ উড়ে গোধূলির খামে―প্রণয়ে পতন ঘটে।
পিতা হই, মাতা হই―সন্তানের রঙেগন্ধে কখনো তোমাকে খুঁজি
দিকভ্রান্ত নাবিকের মত ডেকে উঠি মা, মা আমার;
ঈশানে বিজলি জ্বলে হিরোশিমা কাঁদে―বিষণ্ন বদ্বীপে নারগিস আসে, মহাসেন কাঁপে;
তোমার যুগল হাত কখনো সরে না, তোমার কোমল বুক কখনো সরে না; মা, মা আমার।
জাল
নারী কি নদীর মতো―পেছনে দেখে না, আর্তি শোনে না, রাখে না অঙ্গীকার;
বলে-চলে এঁকেবেঁকে
কামনার রঙ মেখে
খবর রাখে না আর ঘরের ও আঙিনার।
প্রণয়ের ঢেউ তুলে মোহময় নাভিমূলে পেতেছো যাদুর জাল,
দেখা-অদেখায় তোমার সেবায় আকাশ ছুঁয়েছে দেখো মথুরা রাখাল।
চোখ
সুপুরি দানার মতো দু’চোখ তোমার
আনন্দ আবেশে হাসে,
কূলভাঙা নাফ ছুটে যাই আমি
তোমাকে তোয়াফ করি―ঘুরি বারো মাসে।
যখন তোমাকে পাই―আমার চোখের তারা
জোছনা বাদলে ভাসে,
মুদিত দুচোখে তুমি অচিন মুদ্রায় নাচো
কিষাণী মজেছে বুঝি আমনের চাষে।
তোমার দু’চোখে জ্বলে
হিরোশিমা নাগাসাকি দুঃখ দগ্ধ মানবিক ভুলে,
শ্রাবণ মেঘের ছায়া জলের জোয়ার ডাকে প্রণয়ের ঘাসফুলে।
তোমার চোখের ভাষা বুঝি বা বুঝি না―
তাকিয়ে থাকতে হয়,
একুশ বসন্ত ধরে পড়েছি দু’চোখ এই,
বুঝেছি তা বোঝার নয়।
সন্ন্যাস
কত না ডেকেছো তুমি―বাবুজি বাবুজি ওঠো; কেঁপেছে তোমার সুর লীলা আর লাজে নিঃসঙ্গ ঘুঘুর মত। দেখেছি ভেবেছি আমি―সটান পিঠের পর শুয়ে শুয়ে কত না দিঘল রাত; মোরগ ডেকেছে ভোরে―দুই পাখা পত পত করে―ওই সুরে ওই স্বরে; দুই পায়ে হলুদ আঙুল নখের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কঁকিয়ে। কত না দেখেছি আমি বধির ব্যাকুল―তোমাদের এই ডাকে সবুজ বাতাস কাঁপিয়েছে আল―ধানক্ষেত দিগন্তের টানে;
তোমরা কি ভুলে গেছ―আজন্ম বধির আমি; কানজোড়া যদিও বিশাল ভগবান বুদ্ধের মতন।
সংসার সঙসার―তবুও কিষাণ বধূ শুঁকে যায় মেঘের সুঘ্রাণ ; সোনার নোলক হাসে নাকের উঠোনে,
নীল জলে নীল মেঘে যমুনা তেরসা বহে― কায়া আর মায়া জুড়ে নিপাট সন্ন্যাস।
মাটির মুরুলি
ছায়াহীনতার ছায়া বাড়ে, মায়াহীনতায় মায়া কাঁদে। ছায়ার পেছনে ছুটি বাতাসের ছায়াটুকু টুকরো টুকরো কাঁপে―হ্রস্ব দীর্ঘ সবুজ বাদামি নীল ছায়া ভাঙে রাঙে; নিদাঘ দুপুর জুড়ে অপরাহ্ণের কালো ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।
কায়ার সমুখে ছুটি চপল হরিণ গীতল জোছনা ঘন বরষার বনে; ক্লান্ত স্বচ্ছ স্বেদে নীলকায়া ফোটে; আষাঢ়ে রুবাই রচে কাসিদার পাতা―বাবুই বাসায় ঘিরে পাথুরে পিদিম রাত।
মায়াবতী নদী আনঘরে ভুলে সাহানা সেতার সুর কায়ার কাহিনি জারুল পারুল আমলকি চাঁপা।
কোথায় তোমার ছায়া জানি না―দেখি না। কোথায় তোমার কায়া দেখি না― জানি না ।
ইলিশ উড়াল দিলে মশা আর মাছি চোষে মরা রূপচাঁদা, কাঠের খড়ম―মাটির মুরুলি কাঁদে।
উজালা হাপর
দূরের আকাশে তোমার আঁচল উড়ে―জলের জৌলুসে ছায়াপথে অথবা মায়াবী রোদের ডানায়; লাটিমের মতো ঘুরে ঘুরে আমার সমুখে দাঁড়ায়; বিকেল আবিরে রাঙে রাধাচূড়া পাখি।
তুমি কি জান না হায়―মগ্ন নীরবতা নয়, শ্মশান মাতম নয়, মৃত্যু এক অচেনা অধীর সুখপাখি; আকাশ নক্ষত্র চিনে, জানে তাকে রোদপোড়া দূর দরিয়ার গাঙকবুতর। আমাকে আড়াল করে কেউ কি রেখেছে তবে কয়েক টুকরো ভোর, বিহঙ্গ উড়াল তোমার জানালা পাশে!
শর্ত নয়, স্বার্থ নয়, নয় কোন সোনার মোহর―
জীবন ভোরের নদী, দেউলিয়া চাঁদ―লালনীল উজালা হাপর―এক আগুনের ঘর।
আকাশআগুন
ভালোবাসার সব বাতি নিভে যায় বিয়ের প্রথম রাতে―তুমি কি তা জানো না?
শরীরের কসরত শেষে নুয়ে পড়ে এক জোড়া ক্লান্ত চড়ুই―
ভ্রমে আর ঘামে;
উফ! আবার ভালোবাসাবাসি।
তুমি কেন মদ খাও না―কেয়া কি তা পছন্দ করে না ?
তুমি কেন রাতে ক্লাবে আসো না― না, সে তো তাও পছন্দ করে না।
তুমি কেন আর আমাকে চিঠি লিখো না―ভালবাসো না
তুমি কি ভুলে গেছো―জয়িতার গোপন অসুখ―প্রেম প্রেম জ্বর
তোমার কবিতা এখনো কাঁদায়—
আমাকে রাঙায়;
আঁধার রাতের ভেতর তারা হয়ে জ্বলে―
. তুমি কেন আর কবিতা লেখ না ?
তোমার ‘চোখ’ আমাকে মগ্ন করে―স্বপ্নে সাহসে ভুলে
. ―তুমি কেন আজ এভাবে অন্ধ হয়ে গেলে ?
তুমি আজ মরা ভূত, মাঝরাতের স্মৃতি―আগুন।
আমি কেঁপে উঠি―আমি জেগে উঠি
কবিতাকুসুম আকাশ অপার এক―নীল মেঘে জ্বলে নীলজলে দহে।
ঈশ্বরের চোখ
কেমন অন্ধ তুমি নিজেকে দেখো না―অথচ বারবার আয়নার সামনে দাঁড়াও, চোখ দেখো, ঠোঁট দেখো―কপোলের উঠোনে ভেজা বিমর্ষ দুপুর―মেঘরঙ তোমাকে পেছনে টানে। আকাশকে ভাবো―নিজেই নিজের কাছে অচেনা হয়ে যাও। অকারণে প্রিয় নাকফুলের দিকে চোখ গেলে হঠাৎ আঁতকে ওঠো―কী নিঃসঙ্গ তুমি রাত জাগা কবির মতো!
তুমি তো জানো না―তোমার শরীরে ছায়া হয়ে আছি―কখনো দীর্ঘ হই হাটখোলার তালগাছের মতো, কখনো হ্রস্ব অশ্বত্থের বনসাই, কখনো দূর দিগন্তে ছুটি ভোরের প্রণয়বাতাস; হৃদয় উপকূলে আঘাত হেনে যখন সরে আসি অন্ধ আইলার মতো―তুমি কাঁদো, বারবার অশ্রুর কাছে ক্ষমা চাও। চিৎকার করে বলে ওঠো―আমাকে মেরে ফেলো।
বুকের ডান পাশে হাত দাও―আমার উষ্ণতা লেগে আছে; ওটাই ঠিকানা আমার। আত্মার কাছাকাছি থাকি―মেঘের আলোয় নীল নক্ষত্রের মতো জ্বলি।
তোমার চোখের নিচে জেগে আছি নিঃসঙ্গ নাকফুল;
শৃঙ্গারে সঙ্গমে শূন্যতায় সংসারে কোথায় লুকোবে বলো―হৃদয়ে রেখেছি পুঁতে ঈশ্বরের চোখ।
তুমিও অমরতা পাবে
এমন কোন মেঘ আছে―যাতে অন্ধকার নেই?
এমন কোন বৃষ্টি আছে―যাতে দুঃখ নেই?
এমন কোন প্রেম আছে―যাতে আগুন নেই?
আমি নিরীশ্বর পৃথিবীর হাত ধরে হাওয়ার সাকিন খুঁজি।
মেঘ বৃষ্টি রোদে নাচে উতলা উর্বশী―শব্দ আর সুরের সহচর;
অতৃপ্ত আদমের মতো মাটির গন্ধম খেয়ে মঙ্গলের দিকে যাবো
. ―আরেক পৃথিবী দেখো।
বৃষ্টিরা চুরি করে, খুনও করে;
মেঘকে বিশ্বাস করতে নেই―এই হাসি এই কান্না, শত রূপ শত রং;
বিনয়ের অভিনয়ে আকাশ আর মৃত্তিকার মাঝে সেতু হয়ে নাচে―বিশ্বাসের বাণিজ্য তার।
গালিব বন্ধু আমার―আমার পড়ার টেবিলে বসে―রাত জেগে ঝিমোয়;
খৈয়ামের রুবাইগুলো এখনো বেশ ফ্রেশ
নিরালায় দাঁড়িয়ে আছো―আঁধার নামার আগে পানশালার দিকে যাই, চলো।
তুমি অনঙ্গ প্রেমের কথা বলে অদৃশ্য উদ্যানের দিকে হাঁটো
একটু দাঁড়াও সোনা, তুমিও অমরতা পাবে পুরাণে-প্রণয়ে কথা আর কবিতায়।
শরিক
ভালোবাসা ঈশ্বরের মতো
শরিক মানে না নিয়তি রচনা করে
শরিক সে কুৎসিত আজদাহা
বুকের ভেতর নড়ে
ঘৃণার পাহাড় গড়ে।
পাশে থাকা মানে কাছে থাকা নয়―কাছে নেই,
মিছিমিছি শুধু কেন পাশে থাকা―যদি কাছে নেই;
ভুলে থেকে বেশ মনে রাখা যায়―ভুলে থাকি,
দূরে থেকে খুব কাছে থাকা যায়―দূরে থাকি।
কবি পরিচিতি
মুহাম্মাদ আমানুল্লাহপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ
মায়াবী রোদের ডানা (২০১৪ সাল)
পোড়ামাটির সানাই (২০১৬ সাল)গল্পগ্রন্থ
চড়ুইভাতির লাল টিপ (২০১৪ সাল)
অপরাহ্ণের নীল চোখ (২০১৫ সাল)