[ কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গগুলের একটি ছন্দ। তবে, কোনো কোনো অনুষঙ্গের অনুপস্থিতিতেও একটি রচনা কবিতা হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ছন্দ ছাড়া নৈব নৈব চ’। অর্থাৎ ছন্দহীন রচনা কোনোভাবেই কোনোকালেই কবিতার স্বীকৃতি পেতে পারে না। অতীতে পায়নি, বর্তমানে পাচ্ছে না, ভবিষ্যতেও পাবে না। কবি অমিয় চক্রবর্তী ‘কাব্যের ধারণাশক্তি’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ছন্দোবেগের মধ্যে অভিজ্ঞতার বিবিধ প্রবণতা নিশ্চয়ই থেকে যায়। আঙ্গিকের নবীনতায় বিমিশ্র মাধুরী সৃষ্টি করে। প্রসঙ্গের অপ্রত্যাশিত পরিধি-রচনায় কবিতার দিগন্ত তৈরি হতে থাকে। সুরের ভাবনা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যায় ভিন্ন রাগরাগিণীর দরোজা, যাদের মধ্যে বাহিরের সদ্ভাব নেই; তাল এবং লয়ের বোল-চাল যায় বদলিয়ে।’ আর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তো আরেক ধাপ এগিয়ে একেবারে চূড়ান্ত কঠিন সত্য কথাটিই উচ্চারণ করছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার বিবেচনায় কবি প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য, এবং মূল্য নির্ণয় যেহেতু মহাকালের ইচ্ছাধীন আর অর্থগৌরবের আবিষ্কর্তা অনাগত সমধর্মী, তাই সমসাময়িক কাব্যজিজ্ঞাসার নির্বিকল্প মানদণ্ড ছন্দোবিচার।’ এই দুই কবির সিদ্ধান্ত মান্য করলে একথাও মেনে নিতে হবে, ছন্দহীন রচনা কবিতা নয়। আর যে রচনা কবিতা হয়েই উঠতে পারেনি, সেই রচনা নিয়ে বাক্যব্যয়ও বৃথা। কিন্তু যে রচনায় ছন্দ আছে, সে রচনা কবিতা হয়ে ওঠার পক্ষে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গগুলোর কতটা সুসামঞ্জস্যে সক্ষম হয়ে উঠেছে, সেটা বিচার করাই পাঠক-সমালোচক-তাত্ত্বিকের করণীয়।
গত দুই যুগ ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, কবিযশপ্রার্থীদের সিংহভাগই ছন্দ উচ্ছেদের জিহাদে নেমেছে। তারা ছন্দ মানবেন না, কাব্যিকপ্রলাপকে তারা কবিতা হিসেবে দৈনিক থেকে শুরু করে সাহিত্য পত্রিকা, মাসিক থেকে শুরু করে ছোটকাগজ; সর্বত্রই তাদের সেই রচনারাজি প্রকাশ করে চলেছেন। শুধু তাই নয়, সেই সব রচনারাজি কদিন পর পর বই আকারেও প্রকাশ করছেন। ঘটনার শেষ এখানেই নয়, সেই সব বইকে শ্রেষ্ঠগ্রন্থ তকমা দিয়ে কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠান-দৈনিক পত্রিকা পুরস্কারও দিচ্ছে। ফলে সঠিক পথের সন্ধান পাওয়ার আগে তরুণ কবিযশপ্রার্থীরা ভ্রান্তির অন্ধ গহ্বরে ডুবে যাচ্ছেন। নিজেকে নিজে শ্রেষ্ঠ কবিতার তকমা দিয়ে আত্মশ্লাঘায় ভুগছেন। আর কখনোই কবিতার আঙ্গিক-প্রকরণ সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। অবশ্যই তাদের আগ্রহও নেই। নগদ হাততালিকেই তারা কাব্যসিদ্ধি ধরে আত্মতৃপ্তি ঢেঁকুর তুলছেন।
এসব ‘অনাচার’ ও দম্ভের বিপরীতেও কোনো কোনো নবীন কবিতার প্রকৃত পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। তাদেরই একজন কবি নকিব মুকশি। তিনি ছন্দে সিদ্ধহস্ত। ছন্দকেই কবিতার প্রধান শর্ত মেনে লিখে চলেছেন একের পর এক কবিতা। তার কবিতার স্বকীয় স্বর ও মান নিয়ে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। কিন্তু কবিতার পথেরই একজন অভিযাত্রী বলে তাকে স্বীকার না করে উপায় নেই । কেননা তিনি কবিতার অনিবার্য অনুষঙ্গগুলো মেনেই শিল্পের এই শাখায় সাধনায় নিমগ্ন হয়েছেন। তার সেই নিমগ্ন সাধনার প্রমাণ মিলবে, ‘মাস্তুলের জ্বর’ শীর্ষক কবিতাগুচ্ছে।
‘মাস্তুলের জ্বর’ কবিতাগুচ্ছে অক্ষরবৃত্তের ৮+৬ চালের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন নকিব মুকশি। শব্দ নির্বাচন ও গঠনে পূর্বসূরি জীবনানন্দ দাশ ও আল মাহমুদের দূরাগত ছায়া তাকে আপ্লুত করেছে। তবে, বিষয় নির্বাচনে তিনি সমকালীন দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংকটকে উপজীব্য মেনেছেন। একইসঙ্গে প্রকৃতি-নিসর্গ-প্রেম-মানব-মনঃসমীক্ষণকেও অঙ্গীভূত করেছেন। ফলে তার এই কবিতাগুচ্ছ হয়ে উঠেছে প্রস্তুত-কর্মবীরের কর্মফল। চিত্রকল্প ও উপমা প্রয়োগেও তার নতুনত্ব চোখে পড়ার মতো।—কমল ঠাকুর ]
মাস্তুলের জ্বর । নকিব মুকশি
০১.
দূর স্যাভানায় স্বাতি, জিরাফের রাষ্ট্র…
সমাজ ঝাঁকালে ঝরে হলুদাভ পাতা,
ভৈরবী সংসার, দাঁত, ঋতুর মহল…
তোমার মনের পথে নত—আছি পড়ে
আহত ব্যাটার যেন আধখাওয়া ফল!
সংসার পুড়িয়ে যাবে পালকের খোঁজে
মেট্রোপলিটন ছেড়ে বুনো কবিতায়,
সুন্দরী হাঁসের পালে মিশে যাবো ভেসে
ঝিরির কাকলি ধরে বনের গহিনে—
অ্যাকটিং মুখোশ ঝরে মানব-খরায়…
০২.
বোকো হারামের মতো নিষিদ্ধ উপায়ে
ফুটে যাব প্রতিদিন তোমার বাগানে,
আত্মঘাতী ফুল হয়ে ছেড়ে যাব ঘ্রাণ—
লুকানো ভাষায় হবে ঠোঁটে ঠোঁটে কথা
গ্রামোফোনে বেজে যাবে মরণের তান!
কালোবাজারির মতো আমায় পাচার
করবো তোমার মনে—সাদা টিয়া হাঁকে,
রাষ্ট্রের তোরণ খোলে, আসে বাহুবল—
ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি,
ফারাক্কা ধসিয়ে আসে জল, বৃষ্টি, ফল…
০৩.
মিথ্যার সুন্দর ঝোলে কথার আঁধারে
পরাবৃত্ত পথে চলে ঋণ জালিয়াতি…
সুগন্ধায় এসে দেখি মাছের ভাসান,
সন্ধ্যার সীমান্তঘেঁষে জন্ডিস-জীবন!
তুমুল ফেনার তটে সকালের গান…
ভোট ডাকাতের মঠে অ্যাফিডের মুখ
যেনবা অশোকলিপি, কেঁচোর মড়াল!
সংসার-সংগীত ভুলে অভিশ্রীনগর…
সব পথে আছি পড়ে আল্পনার মতো—
হেঁটে যাও, ছুঁয়ে যাও, সেরে যাক ক্ষত
০৪.
ব্যাকুল মাছের নাচে মিহি সুরে ডাকি
চেরির বাগানে ফুটি ননির সন্ধানে,
সব ভুলে যাই আমি—হৃদয় রাঙিয়ে
রাংপানির তীরে হাঁটি, দেখি সব মেকি—
মেট্রোরেল ধাবমান সাদা টিয়া খেয়ে!
মানুষের অন্ধকারে চাঁদেরা দালাল…
সংসার পুড়িয়ে হই পরিযায়ী পাখি—
বিচিত্র জীবনে ফোটে মান্দারিন হাঁস…
চুলের বেণির মতো যত্ন করে বেঁধো
নয়া সম্পর্কের বাঁধ, ভুলে সব থেকো
০৫.
নগরের চাকা চলে ফ্যাসিস্টের তেলে
পুষ্ট আয়ুর্বেদি দ্বীপ কাবু করে তারা—
পাতাকাছিমের মতো বিপন্ন অরণ্য,
রাতারগুলের বনে সোডিয়াম বাতি—
অনেক পুলিশ ঘোরে, ঘুমায় না বন্য!
চুমুর আড়ালে থাকে দাঁতের বাথান,
হৃদয়ের তলে ওড়ে হাঁস অহর্নিশ—
মদের বোতল খালি হলে থাকে পড়ে
সেভাবে রয়েছি ঝরে তোমার হৃদয়ে
ছোঁয়াচে ব্যারাম যেন কোভিড-উনিশ…
০৬.
বাংকার মাড়িয়ে তবে সবুজ তরণি—
বঙ্গপের পারিজাত, ম্যানগ্রোভ ঢাল…
অথচ সুন্দরী আজ ধোঁয়ায় বিধ্বস্ত,
মানুষ হারিয়ে পাই আর্টিফিশিয়াল—
সিনেটে ফুটেছে অন্ধ মাফিয়ার দোস্ত!
মানুষের কত্ত খিদে জঙ্গল চিবিয়ে
নগর ঝাঁকিয়ে শেষ, তবু মেটে না তো
আশ, খোয়াবের স্বাদ; এখানে গজায়
দূরের চিলের ঠোঁট, ঋণের বাদাম…
মদের দোকান থেকে মেট্রোর-তারায়!
০৭.
নিথর মাছের চোখ নিয়ে বাবা ফেরে—
অঝোর বৃষ্টির গুলি আমাদের ঘরে
মাতম ডেকেছে বান, আমাদের প্রাণ
পেয়েছে হলুদ পাতা—অসুখের জুরি…
মায়ের ধূসর চোখে বিশের আম্পান!
বৃত্তচাপে বসে তুলি আঙুরের টোল
পুবালি হাওয়ার জরি; পোম্পি পাথরের
দূর দুর্গ ডাকে, ডাকে ভেনিসের হ্রদ,
গ্রেইপ ভাইন, পিসা; তবু যেন চাই
পিতার খেতের শাক, আদরের নদ!
০৮.
অধোমুখী আলিফের মুখ চিরে ঝিরি
কচি ব্যাঙাচির ঝাঁক; পাকা শস্য ঝেড়ে
পড়ে থাকে একা মাঠ—ফসলের পেট…
আনত ফলের ডাকে পাড়ার ছেলেরা
ছিপ ফেলে বসে থাকে অদূরের গড়ে…
ম্যাজিকের টানে গলে মোমের শরীর—
সন্ধিতে স্বাক্ষর মেলে, তবু যেন কাছে
ফুটে থাকে অবিশ্বাস, লোভের কুটুম—
হাঁস ভেবে কাছে টানি, দেখি হংসফুল…
আশারা আগুনে পোড়ে, তুমুল জুলুম!
০৯.
ডাকু-ফলনের তোড়, সিঁড়িদের গুম…
ক্যাটফিসের কাঁটা বিঁধে ঘুমের নগরে
মগজ অলস আজ হারিয়ে আমূল—
আঁধারে আমার মুখ—রঙ ওঠা জামা,
কিসের মায়ার ঘোরে করে যাই ভুল?
অন্ধ সুড়ঙ্গের ট্র্যাপে বিশ্বাসী কুসুম—
সুইসাইড ভেস্ট নিয়ে সজ্জিত নিষিদ্ধ!
টানেলের দেশে রটে জান্নাতের ছত্র!
তোমাদের মনে পড়ে, তবু নির্বিকার
ট্যাংকের খামারে নত মানুষের গোত্র!
১০.
আমার ব্যালট শূন্য, সংসদের রাতে
রাস্তার বাগানে ঢুকি, গন্ধমেরা ফোটে—
খুলে যায় ধীরে ধীরে মন্ত্রের ঝাড়ায়
কন্ডম বেরিয়ে পড়ে যেন প্যারাস্যুট…
সূর্যমুখীশিষ কাঁপে সূর্যের তাড়ায়!
সংসদের চিল ছাড়ে বারে মেনোপজ—
জুতাদের দেশে নামে বেশুমার ক্ষুধা…
তিথির বর্ষায় দেখি মেট্রোপলিটন—
পলিটিক্যাল সে চুমু বিনিদ্র ঠোঁটের,
খোলস ছেড়েছে পাখি সাপের মতন!