ইহা গদ্য, পদ্য অথবা আখ্যাননির্ভর কোনো রচনা নহে। ইহা নহে সাধু অথবা চলিত বাকপ্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইহা হয় অক্ষমতাজনিত লিখনকৌশল, যাহা কেবল কবিপ্রাণ অহঙ্কারীগণ পাঠের প্রয়াস রাখেন।
০১.
আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ আমি আর সবার মতো সাধারণ নই। প্রকৃতপ্রস্তাবে এহেন বিশ্বাস প্রতিজন লেখক চেতনে অবচেতনে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে লালন করেন। বিধায় ইহা অহমজাত স্বীকারোক্তি মাত্র। আর আমরা জানি, পক্ষান্তরে স্বীকারোক্তি মাত্রই আমাদিগকে মোহগ্রস্ত করে, ধ্যানমগ্ন করে। আর আমরা ইহাও জানি, স্বীকারোক্তিসমূহ মেডিটেশন অপেক্ষা অধিক; যাহা আমাদিগের বোধ ও প্রজ্ঞা দ্বারা উদ্বেলিত; যাহা যথেচ্ছপ্রসাদ লাভে উপযুক্ত বলিয়া বিবেচিত।
এহেন বচনাদি যাহারা বুঝিয়া থাকিবেন তাহারা হন স্বয়ং বিবেক। কেননা জ্ঞান অর্থ বিবেক। আর বিবেক বস্তুকে দৃষ্ট করাইবার পথ বাতলায়। বস্তু দুই প্রকার। মনছবি বস্তু এবং চক্ষুছবি বস্তু। অতএব, দ্বিবিধ বস্তু বিষয়ে সম্যক চক্ষুলাভ কর্তব্য।
০২.
বচন ক্রমশ আপনাকে অর্থাৎ বস্তুকে নির্দিষ্ট করে। দৃষ্ট করে। অবশেষে সজ্ঞায়িত করে। আদতে আপনি কিছুই নহেন; বচননির্দিষ্ট সজ্ঞায়ন মাত্র। বচন অর্থ আপনি। আপনি হইলেন বস্তু। আর বস্তু হইতেই অস্তি; যাহাকে বলা হয় ‘অহম্’।
অহম হইতেই সজ্ঞার সূচনা। আমরা সজ্ঞাচালিত বস্তু বৈ অতিরিক্ত কিছু নই; যাহাকে মহাগ্রন্থে ধাবমান বীর্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এহেন বচনসমূহ পরিমাপের নিমিত্তে অর্থাৎ ‘অহম’ পরিমাপের নিমিত্তে নির্দিষ্ট কোনো ওজনশলাকা নেই। এরূপ অবস্থা আমাদিগের স্বাধীনতার কারণ বটে। ‘ওহম’ হইল নাক উঁচু স্বভাবজাত। ‘ওহম’ স্বাধীন থাকিতে যাচনা করে। আর এহেন প্রকার স্বাধীনচিত্ত হইতে সুখের সূচনা।
০৩.
ইহা হয় অনিদ্রাজনিত মস্তিষ্কতাপ; জৈবিক মস্তিষ্কবিদ্যুৎ; যাহা মুক্তজৈবনিক বটে। আমার আপনার সবার অথবা কাহারও নহে এমন বস্তুজৈবনিক বচনসমূহ ‘মুক্তজৈবনিক’ অভিধায় নির্দিষ্টকরণ প্রয়াস হইবার পারে। আর ইহাও জানা আবশ্যক, ‘প্রয়াস’ অর্থ বীর্য। ধাবমান বীর্য বটে। বটবৃক্ষ যেমন ধাবমান পত্র বৈ আর কিছুই নহে; যাহাতে পক্ষীকুল বিশ্রাম পায় বটে। বেহেশতের বাগানে স্বর্গের রমণীসকল যেরূপ আমাদের পায়ের পাতায় নুরের পাখনা বিছাইয়া দেয় সেইরূপ খশবু মিশ্রিত গতি বটে।
হাদিস শরিফ বলিতেছে আসক্তি বশত বীর্যস্খলনে যে সকল আঙুল ব্যবহার করিবে কেয়ামতের দিন সেই আঙুলসমূহ হইতে বাচ্চা বাহির হইবে। প্রকৃত প্রস্তাবে এই সকল বাচ্চাকাচ্চা হইতেই যাবতীয় বচনের উৎপত্তি। বচন হইল ডাহা কুকুর। নাপাক। বচনের খাদ্য হইল চামড়াখসা কুকুরের দেহের ন্যায় হাড়হাড্ডি আশ্রিত শতকোটি ব্যাধি। অথচ বচনের সাহায্যেই সমুদ্রের মাছেরা আপনার জন্য দোয়া করে। বচনের গুণেই আপনি আজ বেহশত বুঝিতে শিখিয়াছেন।
বচনসকল বীর্যদায়ক গতিময় দৃশ্যকল্প বটে। যাহা হতে মেঘের সঞ্চার। আর বৃক্ষকুলের শ্বাসগ্রহণ ও শ্বাসত্যাগেই ভাসমান মেঘগণের জীবন বটে। আর উহা অবলোকনে আমরা মনুষ্যকুল বুঝিতে পারি, আমরা বাঁচিয়া আছি। আমরা শয়তান হইলেও আমরা মেঘেদের মতো ফেরেশতা হইতে ইচ্ছুক। এইরূপ কল্পনায় আমরা মহাগ্রন্থে দেবকুলবংশজাত বীরগণের চরিত্র নির্মাণ করিয়া থাকি। যদিও ওইসকল নির্মাণকৃত চরিত্রসকল শেষাবধি ভ্রষ্ট মানব বৈ আর কিছুই নহে।
০৪.
ইহা চেতন অবচেতন এলোমেলো বচন বৈ অতিরিক্ত কিছুই নহে; যাহা আপনাকে কিঞ্চিৎ ভাবিত করিলেও করিতে পারে। কেননা সত্য অপেক্ষা মুখোশপ্রিয়তা অধিক প্রিয়। অতএব, শেষাবধি বচনসমূহ মহাগ্রন্থ অর্থাৎ প্রত্যাদেশ হইবার অভিলাষে গতিপ্রাপ্ত হইলে জানিয়া রাখুন, ‘ইহাই তো আপনি’। আপনি যাহা যাহা যাচনা করেন যেইরূপ যেইরূপ চাক্ষুস করেন; যাহা মনছবিতে চাক্ষুস করেন; আর যেহেতু বস্তু দুই প্রকারহেতু মনছবি-বস্তু এবং চক্ষুছবি-বস্তু উভয়কেই বচন দ্বারা সৃজন করা চলে; আর যেহেতু একমাত্র মানুষই বচনের মালিক ও নিয়ন্তা পক্ষান্তরে যাহাকে ঈশ্বর বলা হয়; আর যেহেতু মানুষই ইহার নিয়ন্ত্রক; সেহেতু হে বচনসমূহ তোমরা মানবকুলকে কোন কোন অভিধায় পুরস্কৃত করিবে?
০৫.
তোমরা আমাদিগের বচনকাঠামো নির্দিষ্ট করিয়া দিতেছ কেন? ভাষাকে নির্দিষ্টকরণক্ষমতা রাষ্ট্রের হয় নাই কোনো কালে। এই হেন চিরায়ত কথা পণ্ডিতগণ না বুঝিলেও তাহারা ভাষাপাঠ বিলিবণ্টন করিবার রাষ্ট্রীয় ইজারা পাইয়া থাকেন। মানভাষা যদিবা কাগুজে বাঘ বটে, শ্রুতিগ্রাহ্য নয়; শ্রুতিতে নেই; থাকে না। অথচ প্রতিজন মূর্খ মাত্রই জানি, শ্রুতিতেই প্রেম বটে, কণ্ঠসুরধ্বনি বটে, প্রেম পাগলিনী রাধার আধসেদ্ধ চাউল আউলাইয়া যায় কানাইয়ের বাঁশরির বচন শ্রবণে।
সেই সময় মাইকেল জ্যাকসন মিটিমিটি হাসিতেছিলেন। কামুক কৃষ্ণের চোখের ভেতর দিয়া আপনার চোখ তাকাইয়া রহিয়াছে। তাইতে তোমার রমণী স্বাধীন বটে; তবু কখনো কি অবহেলায় দেয়নি আসন; আসঙ্গসীমায়?
ওস্তাদ ফতেহ আলী খান; যাহার জন্ম হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের জন্মেরও অধিক আগে যখন টাইটানিক জাহাজের ডেকে তুমি দাঁড়িয়ে দেখছিলে কী অসম্ভব দম্ভে বিজয়িনীর বেশে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে গতিশীল জলজ-সমাজ। উহাও বচন ছিল। প্রেম ও বচন তখন পাশাপাশি বসবাস করিত বটে। সেই থেকে লালন সাঁই গাইছেন বচন। অন্ধ হোমার। অন্ধ লালন। অন্ধ লালন মনছবিতে গাইছেন বচন। বচনে কয় নিরীশ্বর আমি। কায়াহীন অপরূপ। হইলাম আমি চক্ষুকানা। তুমি অধম মনকানা। এসব দেখি কানার হাটবাজার।
০৬.
বচনমাত্রই অভিজ্ঞান। অভিজ্ঞান দুই প্রকার। মনছবি অভিজ্ঞান। বস্তুছবি অভিজ্ঞান। তুমি স্বয়ং মন ও বস্তুর বিস্ময়কর উপস্থিতি। যাহা অভিজ্ঞা অভিধায় নির্দিষ্ট। যাহা কেবল ভাষ্য দ্বারাই ব্যাখ্যাযোগ্য। নতুবা তুমি মৃত। কখনও ছিলে না তুমি।
যদিও মৃতেরও অস্তিত্ব থাকে। উপস্থিতি থাকে। অতীতকাল থাকে। অতীতকাল অর্থ, তুমি ছিলে। এখন নেই। নঞবচন। জরায়ু, উহাও নঞবচন। আমি উহাকে ডাকিব যখন মা বলিয়া তখন উহা হ্যাঁ-বচন। মা অর্থ মাতা। আর মাতা অর্থ, টিনের চালে শুকিয়ে ওঠা পাকা কুমড়ো। যে কুমড়োর শুকনো খোলের ভেতর কাঁপছি আমি বচনদোষে।
০৭.
বচনদোষই হয় জন্মদোষ আমার। এ ছাড়া আর কোনো জন্মদোষ ছিল না আমার। জরায়ু থেকে নিয়ে এসেছি আমি বচনদোষ, ভাগ্যরেখা। বচনদোষে দোল খাই আমি পাতাদের শিরায়, উহাদের হুলওঠা লোমে। বৃক্ষদের পাতায় পাতায় দোল খায় মায়েদের জরায়ু। পাতাদের সবুজে জন্ম নিচ্ছে বচনপুত্র। বৃক্ষদের মায়েরা মেঘেদের হৃদপি- থেকে সংগ্রহ করছে দুধ। শিশুখাদ্য। ডিপলোমা গুঁড়োদুধ। গাছেদের বাবা নেই। নেই কোনো ঐশীনির্দেশ। অথচ বচনভাষ্য তাহাদেরও আছে।
আমি স্বয়ং অহম। ফ্যাসিস্ট। প্রতিফোঁটা বেঁচে থাকা জীবন। বচন-ইশারায় জাদু-আক্রান্ত। আমি ছুটছি এইহেন জাদুর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে। পূর্বপুরুষ গ্রাম্য-কবিরাজ ঝাড়ফুক লতাপাতা কবজতাবিজ মন্ত্রবচন রক্তে ও অভ্যাসে, ক্যাঙ্কা করি কথা কও তুই মোর ময়নাপঙ্খী; মুই চাঁদযমুনায় ভাসি যাও, দিন নাই আত নাই, নিদ নাই, সগায় পাত্থর, সগায় পাত্থর। বোবামুখ শুয়োরের পুত, গুখোর গোবরমুখী, বারোভাতারি মাগির শাড়ির আঁচলে লুকায়া থাকি হাঁটি যাও তুই আমাগের পাড়াগেঁয়ে গেঁয়োভূত নাড়িপোতা বচনপুত্র।
০৮.
ইনসানের ভেতর এমন কিছু লোক আছে যারা বলে, ‘আমরা মাবুদ এবং শেষ দিবসে বিশ্বাস করি।’ অথচ তারা প্রকৃতবাস্তবতায় তা বিশ্বাস করে না। ঈশ্বর এবং বিশ্বাসীদের তারা প্রতারিত করতে চায়; কিন্তু পক্ষান্তরে তারা শুধু নিজেদেরই প্রতারিত করে অথচ তারা তা বুঝতে অক্ষম। তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি; এবং ঈশ্বর তাদের ব্যাধি ক্রমশ বৃদ্ধি করছেন; তারা ভোগ করবে নিদারুণ যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। কারণ, তারা মিথ্যাবাদী। যখন তাদের বলা হয়, ‘পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না’; তারা বলে, ‘কেন, আমরা তো কেবল শান্তি স্থাপন করতে চাচ্ছি।’
আমরা জানি বচনদোষে শেষাবধি এহেন অভিশাপ; যাহার একমাত্র পরিণতি, দোজখের আজাব। তা সত্ত্বেও, ডালিমকুমার বোরাকপৃষ্ঠে ধাবমান। ডালিমকুমার সাত আসমান মেঘপুঞ্জে বোরাকপৃষ্ঠে ভাসমান। বোরাকের দিগন্তব্যাপী পাখা পরম মমতায় সরিয়ে দিচ্ছে জমাট কুয়াশা। দিগন্তব্যাপী ছড়িয়ে ছড়িয়ে উঠছে শুভ্রনীল ঘনধূসর অন্তর শুশ্রূষাকারী মেঘপুঞ্জ কুয়াশার সামিয়ানা। কঙ্কাবতি চেপে ধরে আছে ডালিমকুমারের আস্তিন। সেই আস্তিনের ঝালরপ্রান্ত হতে ছিটকে পড়ছে জ্যোতি।
কুমার, প্রশান্তি পাচ্ছি তোমার স্পর্শে। এমন স্পর্শের অভিজ্ঞতা পাইনি আমি, আমার চিরন্তন জীবনে। স্বর্গীয় জীবনের অনন্ত জৌলসের বাগানে তোমাকে আলিঙ্গন করেছি বহুবার। সহস্র হুরের সেবানৈপুণ্য থেকে পৃথক করে তোমাকে যখন ছুঁয়ে দিয়ে তৃপ্তির অভিজ্ঞায় ডুবেছি তখন তো এমন পিপাসা জেগে ওঠেনি। কুমার, সাপের চোখের মতো আমার ভেতরের কলিজাটা জেগে উঠেছে। ডালিমকুমার, আমার ভেতরের কলিজাটা কাঁপছে। তোমাকে বোঝাতে পারছি না। আমার পিপাসা পাচ্ছে। এমন অনুভূতি ইতোপূর্বে আমার জীবনে আসেনি। বলো কুমার, আমার ভেতরে এমনতর রূপান্তরের কারণ কী? তুমি কি বুঝতে পারছ না, কেন তোমাকে চিরন্তন সময়ব্যাপী প্ররোচিত করেছি স্বর্গ থেকে পালিয়ে গিয়ে নতুন কোনো গ্রহের সন্ধানে বেশামাল হতে? অনন্ত শান্তির বাগান যে বেহেশত, যেখানে ক্ষুৎ-পিপাসা অভিজ্ঞতার অতীত; কুমার আমি ক্ষুধার অভিজ্ঞতা পেতে শুরু করেছি; আমার জিহবামূলে লোভের স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করেছে; হরমোন স্রোতে জেগে উঠতে শুরু করেছে লোভ ও আনন্দ। বলো কুমার, পালিয়ে আসার পর তুমি কি আবারো ফিরে যেতে ইচ্ছুক বেহেশতের অনন্ত জীবনে? তুমি কি সহ¯্র হুরের বিরামহীম খেদমত পিছে ফেলে এসে বিষণ্ন বোধ করছ?
আর তখন ডালিমকুমার স্বর্গ থেকে অবিরাম দূরত্বে গতিশীল। দূরে সরে গিয়েছে সাত আসমান। আর তখন দিগন্তহীন সীমাহীন মহাশূন্যে ষষ্ঠ আসমান থেকে ছুটে আসছেন দেবদূত জিবরাইল। ডালিমকুমার পিপাসাকাতর অথচ নতুন গ্রহের সন্ধানে ক্রমশ উদ্দীপ্ত। এবং তখন, বেহশত থেকে পলায়নমুখর এক জোড়া নারী-পুরুষের দেহে ক্রমশ জেগে উঠতে শুরু করেছে মানবসত্তা, তাড়না, লোভ ও পিপাসা; জেদ ও প্রভুহীন শরীরী অধিকার, বিজয়ের অহম। স্বাধীনসত্তা। গতিচঞ্চল।
মহাশূন্যের সীমানাহীন প্রতিভাস থেকে ভেসে আসছেন দেবপুরুষ জিবরাইল। আর এইভাবে শোনা গিয়েছিল জলদকণ্ঠে দেবপুরুষের বচন, হে সৃষ্টির বিস্ময়, সৃষ্টির সেরা জীব আপনারা কেনই বা অনন্তের আশ্রয় পরিত্যাগ করে, বিরামহীন বেহেশতের জৌলসকে অস্বীকার করে, অযথাই ছুটে চলেছেন বিরামহীন? আপনারা কি বুঝতে পারছেন না, প্রভুর নেয়ামতকে অস্বীকার করার পরিণাম? আপনারা নির্বোধের মতো অমরতাকে অস্বীকার করে ধাবিত হয়েছেন নশ্বরতার দিকে।
এইভাবে বিরামহীন দেবপুরুষের আহ্বান চলতেই থাকে আর সেই আহ্বানের ভেতরই ডালিমকুমার শুধু একবারের জন্য উচ্চারণ করলো, আমরাই সেই সৃষ্টির সেরা, আর ওহে নির্বোধ জেনে রাখো ‘সেরা’ শব্দের অর্থ সীমালঙ্ঘনকারী; একমাত্র সৃষ্টির সেরা জীবই সীমা লঙ্ঘন করতে সক্ষম।
মুহূর্তেই মহাশূন্যতার দেয়ালে আলোকরশ্মির প্রতিফলনে চিরায়ত বচনসমূহ উদ্ভাসিত হলো, ‘নিশ্চয় প্রভু সীমালঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না’।
ডালিমকুমার যতবার আলোকখঁচিত বচনরশ্মি পাঠ করলো ততধিকবার তার অন্তরে ক্রোধ উজ্জবীত; দেহ ক্রমশ কম্পমান; আর তখন স্কন্ধদেশে লেপটে থাকা কঙ্কাবতি খামচে ধরলো ডালিমকুমারের আলোকোজ্জ্বল আস্তিন; যে আস্তিন থেকে তখনও শূন্যতায় ছড়িয়ে পড়ছিল স্বর্গীয় খশবু।
০৯.
আপনি স্বয়ং মহাজাগতিক রশ্মি। সীমাহীন। সময়হীন। অনন্ত। নীরব। আর বচন হলো এহেন নীরবতার ভেতর বাঘের চোখের কাজলে লুকিয়ে থাকা এক ঝলক প্রশান্তি; যা মনছবি দ্বারা মুক্ত। ডানাওয়ালা মুক্ত পাখি যে কিনা আকাশকে স্বাধীন করেছে নক্ষত্র ও মেঘের সীমানায়। অনন্ত। সময়হীন। নীরব ও প্রশান্ত বচনসমূহ, যারা ঈশ্বরের অলটারনেটিভ; অস্তিত্বময়; ধনু থেকে মুক্তি পাওয়া তির; পক্ষান্তরে যে তির নিজেকেই বিদ্ধ করে। আমরা সেই বচন নামক জ্ঞানবিদ্ধ তিরের দিকেই ছুটছি।
প্রকৃত প্রস্তাবে আমরা বচনসমূহ উলঙ্গ করার জেদে কথা বলছি, কথাগুলোকে লিখে রাখছি, যা পক্ষান্তরে তোমাকে মুক্ত করবে প্রাণ নামক নির্যাস থেকে। বচনকে হতে হবে সেই নির্যাস যা দেহ নামক রক্তমাংস সমেত কঙ্কাল থেকে মুক্তি পেয়ে প্রাণবিন্দুকে উন্মোচন করবে। আর আমি, এ কারণেই জিভের ডগায় রেখেছি লবণদানা; পক্ষান্তরে রেখেছি, সমুদ্র ও কান্না।
অথচ। কেউ বচনের জন্য অপেক্ষা না করেই, নিজ নিজ স্বভাব অনুসারে ফিরে গেলো। পিছে রেখে গেলো, প্রেম ও সন্দেহ। অথচ প্রেম ও সন্দেহ, তাহারা জমজ ভাই। মানুষই একমাত্র দেবদূত, যারা একাকিত্ব ত্যাগ করতে চায়। পারে না। কারণ, বচন কখনও মানুষের পিছু ছাড়ে না।
বচনসংকেত থেকে শুষে নাও আয়ু, মাটি ও সুগন্ধী চাউল; বাতাসের স্বেদ; শিশিরকণা। যেখানে লুকিয়ে থাকে প্রেম; যেন বা স্তন্যদানে নিমগ্ন নারীর কাছে শিশু ও স্বামীর আয়ুরেখা রাখা আছে বন্ধক। তাহলে বিনিময় হোক জীবন। বিনিময় মুদ্রার নাম, বচন। কবরের অন্ধকারে সাওয়াল জবাব; যাহা বচনসংকেত মারফত বিনিময়যোগ্য। মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে বচন; যাহাদের রয়েছে অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ। যাহারা যুগপৎ এহেন ত্রিবিধ সময়সীমানায় বিনিময়কর্ম সম্পন্ন করে। চেতনা-আক্রান্ত পাঠক, মানবজন্ম হইল যথার্থ পণ্য, যাহা বচনসংকেত মারফত কেনাবেচা হয়।