মানুষের করোটিতে
যা-কিছু নরম সুবাসিত
রাত ঘন হয়ে এলে পৃথিবী নরম হয়ে যায়।
ক্রমে আমাদের চোখ ভরে আসে মৌসুমি উত্তাপে—
যদিও বা নক্ষত্রেরা চাঁদের আলোর চারপাশে
নকশাদার বুটিকাঁথার বিশ্বাসে জ্বলছে যেন।
আঠালো কুয়াশা সারা মাঠে হাওয়াহীন শরীরে
ফর্সা হয়ে ডুবে আছে। আজ আকাশের কাছে যাত্রা—
সমুদ্রের ভাষা কিংবা রৌদ্রের স্মৃতির কথা ভেবে
কেউ কেউ ঘ্রাণের তরঙ্গে একবার শ্বাস নিচ্ছে।
তারা জানে সবকিছু—দ্বিতীয়বারের মতো কারো
আসা হবে না এখানে—কিংবা টের পাবে না হয়তো।
এখানে দাঁড়িয়ে যতদূর অন্ধকারে দ্যাখা যায়,
নির্জন কুয়াশা পার হয়ে তার থেকে শত বেশি
তামাশা আটকে আছে আলোময় নীল পৃথিবীতে।
সন্ধ্যার লাবণ্য পান করে বলকানো রাত শুধু
হেমন্তের শব্দে বাড়ে, আর দিগন্তের শূন্যতায়
মহত্তর অভিজ্ঞতা অতি ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে।
সকল উজ্জ্বল রোদে শহর মলিন হয়ে যায়—
প্রবল বর্ষায় কখনো বা বাদামি নগর ভাসে—
বুকের ভেতর হাত রেখে তবু প্রেম বিনিময়
কেউ কখনো ভোলে-না। ভেবে দ্যাখো সকল নিয়ম—
স্নিগ্ধ পাখির জীবন ফোয়ারার মতো মিহি
জলপাই বনে কিংবা পাহাড়ের শরীরে শরীরে
তারা নিজের মতোই নড়ে—আর ঘন নীল নদী
ছোট পাখির মতন বাতাসে শিশির বুনে রাখে।
আকাশের প্রসারিত বুকের ভেতরে থেকে তবু
প্রিয়াকে দ্যাখার মতো সবকিছু ভুলে গিয়ে তুমি
নিজের বিষয় ভেবে অবিরাম লাল হয়ে গেছ।
সেই আদিকাল থেকে এই গোলাকার পৃথিবীতে
আফ্রিকার উপল বিছানো ঘ্রাণ থেকে তাইগ্রিসে,
ইন্দুস হোয়াংহো থেকে দানিয়ুব কিংবা আমাজনে
অনেক মানুষ এসে গেছে—এগিয়েছে প্রলোভনে—
আজো সবকিছুর ভেতর তবু রক্ত রয়ে গেছে
এখনো মানুষ ভুলে আছে শব্দহীন বরফের
গাড় নীল আওয়াজ, কিংবা তাদের পায়ের নিচে
শহরের পথে পথে মুছে যাওয়া ঘাসের আলো।
তাদের মাথার ‘পরে এখনো আকাশগঙ্গা আর
সূর্য যেন ফুটে আছে বহুকাল আগের মতোই।
মানুষ চেয়েছে তবু কেবল মাটির চারপাশে
বাঁধনের ভেতর জড়িয়ে—নতুন বাবলা ফুলে
হলুদ-মতন বারবার অপব্যয় ফাঁকি দিয়ে
রাত্রি ফাটার অপেক্ষা। এসময়ে মাথার ওপরে
শরতের সন্ধ্যাবেলা তারা সূর্য ডুবে যেতে দ্যাখে,
মশালের আয়নায় দ্যাখে নিজেদের অবিশ্বাস—
তারা দ্যাখে লোহা থেকে সোনা, তেলখনি বা মশলা—
আর রমণীকে চেয়ে চেয়ে তিব্বতের পবিত্রতা
কৃত্তিকার মতো করে বহুবার পিছলে গিয়েছে।
তবু তারা বেঁচে আছে অন্ধকার আর সিংহাসনে।
তবু তারা ভুলে আছে রৌরবের তাব্রিজ শহর।
চোখের আলোয় আজ ভোরের নদীর আর্দ্রতায়
যতটা গভীরে চলে যাই—চেয়ে দেখি তারপর
ধূসর গাংচিল উড়ে উড়ে পানিতে ফেলছে ছায়া।
আরো দূরে চোখ নিয়ে দেখি দূরাগত জাহাজের
জলময় পায়চারি, আর সাদা জলের ভেতর
বেঁকে গেছে বিম্বিত মাছের স্বচ্ছ-মোলায়েম দৃশ্য।
যেসব প্রাসাদ বহু আগে আয়ুহীন হয়ে গেছে
তারা যেন জলের ঢেউয়ে সীমাহীন নড়ে যাচ্ছে।
এ-সকল দৃশ্য মানুষেরা তাদের বানানো সব
জাদুঘরের শরীরে ভুলে থাকা চিন্তার রেখায়
গেঁথে রাখে সারাকাল। কেবল চোখের চারপাশে
দীর্ঘতম আলেয়ায় সারাদিন সূর্য খেলা করে।
একটি সন্ধ্যাকে নিয়ে চিরকাল হিম বসে থাকি—
শত শত শতাব্দীতে কখনো মগজে এসবের
ধীর স্বর রয়ে যায়। কখনো মানুষ চিনে ফ্যালে
পুরাতন আলোর মতন মাঝবয়সী হৃদয়।
বহুদিন ধরে এই পুরাতন গ্রহে মানুষেরা
হয়ে গেছে ইতিহাস। তাদের কখনো মৃত্যু নেই
কিংবা বাতাসের শব্দে অবিকল মানুষের মতো
একদিন বেঁকে যাবে নিজেদের ঘড়ির ভেতর।
যা-কিছু হয়েছে কিংবা ইতিহাসে লিখে রাখা হবে
সেসবের চেয়ে বেশি আর কোনো কিছু সুবাসিত
নীল গোলাকার পৃথিবীর মানুষের কাছে নেই।