কালু-গাজীর গল্প
মা কালু-গাজীর দরগায় মান্নত করেছিলেন—ছেলে হলে সিন্নি দেবেন। জানি না, মা ফিরনি কিংবা পায়েসে সিন্নি দিয়েছিলেন কি-না। কিন্তু বড় হতে হতে জেনে গেছি—কালু-গাজীর গল্প, গাজীর দরগায় তার মাটি ফুঁড়ে আছে ঢিপি—বৈশাখে জেগে ওঠেন তিনি। বাড়ির বউ-ঝি মন-বাসনায় মান্নত করেন, সদগা দেন বড় মোরগ কিংবা খাশি। দুধ-কলায় ভিজিয়ে আসেন অদৃশ্য পুরুষের গলা—যার বীর্যদানে জন্মায় কাঙ্ক্ষিত শিশু।
আমি তার এমন কোনো দানপুত্র কি-না অথবা কীই-বা আমাদের সম্পর্ক, এইসব সম্পর্কের জট খুঁজে পৌঁছাই গাজীর ভিটায়—হাসতে থাকে লালসালু, সমূহ রহস্যে ঘুরতে থাকে বাদকের দল-সাতপাকে উড়ে যায় ধূপ আর ধুনা…
চাঁদের বুড়ি
দাওয়ায় বসে দাদি চড়কা কাটেন—ঘোরঘোর শব্দে গুছিয়ে যায় সুতো, সুতোর গুটি দাদির মুখ হয়ে ওঠে। দাদিকে আমার চাঁদের বুড়ি মনে হয়, শাদা শাড়িতে উড়ে যান তুলোর মতো—রাতের আকাশে ঝুলে থাকেন চাঁদের ভেতর। ভাত খাইয়ে দিতে দিতে মা বলেন—তোর দাদি ওই আসমানো থাহে, রাজকুমারির লাই কাপড় বোনে, তোর লাইগা বোনে পাঞ্জাবি। মা’র গল্প শুনে নিজেকে রাজকুমার মনে হয়—ডালিম কুমারের ভাব নিয়ে ছুটি ঘোড়ার পিঠে, ঘোড়া দৌড়ায়, মাথার ওপর চাঁদ দৌড়ায়, শুধু দাদি আর কথা কয় না…
মালঞ্চমালা
সাভারের বুক চিরে ঢাকার চিপাগলি ঢুকে গেলে—দেশ ট্রাভেলস, হারিয়ে যায় সমস্ত সবুজ গ্রাম, তীব্র জানজোটে জ্বলতে থাকে লালবাল্ব—তখন, স্মৃতির ক্যানভাসে সাইরেন বাজায় মালঞ্চমালার গান। পিছু ফিরে দেখি—চিতায় পোড়ে চন্দ্রমানিক্যের হাত, ভস্ম হতে থাকে মাথা ও পা। ক্রমাগত কেঁদে চলে কোনো সতী নারী, দেবতারা ফিরিয়ে দেন তার দান। বিজয়ের নিশান ওড়ে, তবু—সময়ের মাপকাঠি ভুলে—শেকড়হীনে চলে বঙ্গজ প্রাণ।
নাইওরি
গাঙ ধরে এগোয় নাইওর নৌকো, উঁকি মারে ভোদৌড় মন, বিছিয়ে পরে আঁচল তার, ছায়া ভাসে জলে। মুঠোভরা হাতে তোলে শাপলা-শালুক, খোঁপায় বাঁধে পদ্ম-গেলাপফুল। ভাটের সংসারে পিঁ-পিঁ ডাকে জলপিপি। জল কেটে চিলের ছবি—শূন্যতার সিম্ফনিতে শোনায় চিঁ-চিঁ ধ্বনি। একটা গাঙশালিক উড়ে যেতেই জোয়ার আসে চোখে—পোড়ামনে রোদ করে ঝিলমিল…
মাছ-ভাতের দিন
কাঁঠালবাগান মোড়ে ক’জন মাছ বিক্রেতাকে দেখে বাবার কথা মনে হয়—পোনা মাছগুলোর চোখে বাবার মুখ দেখি—ওই তো অমপুরে আব্বার বাড়ি—বিয়ান ব্যালাই জাল ধরি বিলোত যাউছে—পেছনোত খালোই হাতোত মুই—মোর চোখোত মাছুয়া মাশানের দূত, গাওত আষ্টে গন্ধ, তাও কী ফুর্তি! মাছ মারিবার যাউছি।
মাইঝ বিলোত শাপলা ফুল—পাতার তলোত পোনার ভাইস—মুই যখন পোনার পিছনোত দৌড়্যাঙ- আব্বা কয়—চ্যাঙরা, মধ্যখানোত যাসনে, মাশান আছে, মাশান! মাশানের ভয় যে কোনটে যায়—বোঝঙ না। তয় জানোঙ, দ্যাওয়ের দ্যাশোত অ্যালা মানসেই মাশান—হামার মাছ-ভাতের দিনগুল্যা নিয়্যা আসমানোত তোলছে।