ব্রাত্যগীতিকা
শোনো শোনো শবরপা শোনো চন্দ্রাবতী
তোমাদেরই নামে আমি জানাই প্রণতি
তোমাদেরই নামে করি আকুলি-বিকুলি
সুরে গান বান্ধি খাতা পদ্যে ভরে ভুলি
তোমাদেরই খোঁজে আমি হাঁটি নিরন্তর
তোমাদেরই পুত্র আমি মাটি-বংশধর
পৃথিবীর শত কবি সহস্র ধীবর
সকলই আমার ভাই শব্দ-সহোদর
যাহারা আসিয়াছিল আসে নাই যারা
সকলই আমার মতো শব্দে দিশাহারা।
জীবনেরে পড়ি আর জীবনেরে লিখি
বাকি সবই কানাকড়ি অচলিয়া সিকি
শিখি নাই অন্য কিছু সকলে যা পারে।
পারি শুধু সত্তাধিক ভালোবাসিবারে
ভালোবাসি মানুষেরে সে মানুষ কই
বুঝিবে সে ভালোবাসা অতল অথই
প্রাচীন আকাশ-মাটি-নদী-বৃক্ষ ছাড়া
আর কেহ নাই দেবে কবিকে পাহারা
কেহ নাই কিছু নাই নিকটে অদূরে
যা কিছু মহার্ঘ সবই আদিগন্তপুরে ।
নাচিছে সভ্যতা দেখো মত্ত কাপালিক
গ্রাফিক আকাশে ওড়ে ডটের শালিক
হার্ডডিক্স মনিটরে নিসর্গ-পাহাড়
ঘরেতে বসিয়া দেখো রঙের বাহার
যত মন্ত্র গণতন্ত্র যত অর্থনীতি
যত ফ্যাক্স-ফোন যত কাগুজে পিরিতি
যত মুনি-ঋষি যত কুলমহাজন
যত স্বপ্নজাগানিয়া সুনীতিবচন
যত যুক্তিতর্ক যত কূটতত্ত্বকথা
নিপাতনে সিদ্ধ যত পরাসার্থকতা
যত রাজনীতি যত নাচন-কুদন
যত যুদ্ধ-হানাহানি যত অঘটন
যত ভাই-বেরাদরি আদর-খাতির
যত পায়েসান্ন যত ননিমাখা ক্ষীর
সবই উহাদের লাগি যাহারা কৃপণ
কেবলই লুটিয়া খায় অবুঝের ধন।
ওরা কতিপয় তবু যারা সংখ্যাধিক
তাহারাও জানে ওরা পারমাণবিক॥
কত বিদ্যাবুদ্ধি কত জ্ঞান-বিজ্ঞানিয়া
তাবিজে-তাগায় বাঁধা পড়েছে দুনিয়া
কত না ইশকুলে কত বিশ্ববিদ্যালয়ে
কত না মোল্লার দৌড় বর্ণপরিচয়ে
কত না পণ্ডিত কত বিদ্যার বহর
কত না বন্দর কত সাঁজোয়া শহর
কত না বক্তৃতা কত সভা-সেমিনার
কত না সভ্যতা কত রঙের বাহার
কত না আমোদ-ফুর্তি কত অপচয়
কত রঙ্গলীলা কত আনন্দনিচয়
সবই উহাদের লাগি যাহারা কৃপণ
কেবলই লুটিয়া খায় অবুঝের ধন॥
অবুঝের ঘরে জন্ম আমি অবুঝিয়া
অর্থ-বিত্ত নাই আছে বোধের দরিয়া
হাজারো নদীর হাতে জোয়ারে ভাটায়
সে-দরিয়া শত প্রেমপত্র পাঠায়
সে চিঠি যাদের লেখা তাহাদের কেউ
পড়ে নাই, জানে নাই পরানের ঢেউ
কত অজানার ডালে না-জানার ফুল
ফুটিয়া ঝরিয়া যায় কে দেবে মাশুল
কত গুহাচিত্র কত ছবির টোটেমে
আদিচিত্রকরগণ মগ্ন ছিল প্রেমে
তাহাদের কিবা নাম কিবা পরিচয়
কেহ না-জানুক তারা কৃত্যে কথা কয়।
আমিও তাদের ভাই, কালের ধীবর
সমকালে থাকি আর ঘুরি কালান্তর।
শোনো ভাই জলদস্যু, শোনো সওদাগর
শোনো হে সভ্যতা আমি মাটিবংশধর
শবরপা চন্দ্রাবতী দাও পদধূলি
কেহ না পড়ুক খাতা, পদ্যে ভরে তুলি।