এক.
এমন দিনও আসে—আসে কখনো এমন বিরল লগ্ন, উদ্যানে কাটে প্রভাত দুপুর, মিল্কউইডের পত্রপল্লবে জড়ানো শুয়াপোকা বেরিয়ে আসে কাকুন ছেড়ে, বাগিচায় বেজে ওঠে পুষ্পপল্লবের সপ্তসুর, ভাবি—বোধ করি হৃদয় হবে না আজ ভগ্ন; চোখের সামনে রূপান্তরে হয় প্রজাপতি, ব্যাকুল বাতাসে বিষ্ফোরিত হয় সামবাক জেসমিনের সৌরভ, আধফোটা কলিতে আলো-জলে ঘটে বিপুল অগ্রগতি, প্রার্থনা করি খার্তুম কিংবা দারফুরে আজ যেন কেউ না হয় শব।
দুই.
সাঁজ-গোধূলিতে কাছে আসে আমাদের চেনা উপগ্রহ, মেঘের শুভ্র মসলিনে সোনার ব্রোচ হয়ে ফুটে, ভাবি—একদিন না হয় নাই বা হলো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যুদ্ধ-বিগ্রহ; তাকাই ফের আকাশে, ক্রিসেন্ট ফ্রেমে সন্ধ্যাতারাটিও হয়েছে ঈদের আইকোনিক চিত্র, ঘর পালানো তোতা ফিরে আসে আঙিনায়, নিরিবিলি দানা খুঁটে—ম্যাসেঞ্জারে উঁকি দেয় সুদানের মেয়ে নাহিদ, হালফিল ফেসবুকে যে হয়েছে আমার মিত্র।
তিন.
আজকের দিনটি তো —বলা চলে—কাটলো সুশোভন.. সুন্দর, ঘটেনি সম্পর্কে টানাপোড়েন তুমুল, দৃষ্টি হয়নি মাকড়শার জালে আচ্ছন্ন, রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ঝরেনি ধূসর চুল, চেনাজানা কোন দম্পতিরও ভাঙ্গেনি ঘর, পুরো দিবস জুড়ে শিরোপীড়া কিংবা কর্কটাঙ্কেও হইনি মতিচ্ছন্ন।
চার.
আমাদের মফস্বল শহরে অভিবাসী হতে না পেরে সুদানের শরণার্থী নাহিদ, ফিরে গেছে তার সাকিন দারফুরে, জুটেনি এখানে নিরাপদ আশ্রয়, তাতে টুটে যায়নি কারও নিদ; ভাবি নাচের নারী—এখনো মেতে আছে কী সে স্বপ্ন-সুরের নৃত্যনুপুরে? কেন জানি প্রত্যাশা করি—বার্তায় ফুটে উঠবে নিরুদ্বেগ বাণী এক বিশুদ্ধ, ম্যাসেঞ্জারের অক্ষর..শব্দ ও বাক্যবিন্যাসে প্রত্যক্ষ করি—ফের সুদানে বেঁধেছে গৃহযুদ্ধ!
পাঁচ.
মার্কিন মুলুকের মফস্বলে—আণবিক ছত্রছায়ায় ঋদ্ধ জনপদে, মেয়েটি ছিলো সপ্তা দুয়েক, শুশ্রূসায় সেরে ছিলো গৃহদাহের দগ্ধ জখম, ছিলো সামান্য সময় নিরাপদে, বসে ছিলো নৃত্যগীতের মাইফেল এক অনুপম; লিখেছে সে ব্রাইড অব নাইল শিরোনামে অতীব সুপাঠ্য এক নৃত্যনাট্য, শরীরের ছন্দঋদ্ধ মুদ্রায় সহজিয়া অনুরাগে যুক্ত করেছিল সে গল্পের কথকতা—শব্দছন্দে সমিল, চিত্রায়িত হয়ে উঠেছিল—সুদানের বালুকা চিরে মিসরের দিকে বয়ে চলা জলধি সুনীল।
ছয়.
বার্তায় ফের লেখে নীলনদের দুহিতা, ছেড়েছে ঘর, চার দিন জোটেনি দানাপানি—হাঁটছে মরুপথে —সঙ্গে দিদিমা প্রবীন, অগ্নির লেলিহান শিখায় হয়েছে চিতা —পূর্বপুরুষের সাকিন, পথে-প্রান্তরে খূঁজছে জল—সামান্য আহার, ফোস্কা পড়েছে পায়ে, ব্যাকপ্যাকে যথাসর্বস্ব নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে অপার? হাঁটতে পারছে না তবুও কায়ক্লেশে পথ চলছে নাহিদ, সামনের ধূসর মরু করবে সে অতিক্রম, বিরুদ্ধবাদী সৈনিকরা তার শরীরে কেটেছে সিঁদ, দিদিমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে—মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়ে আসছে দম।
সাত.
জানতে পারি আশ্রয় নিয়েছিল ঝালিংগেই শহরে, আংগুলের আঁকে গুনি দিন—কেটে যায় সপ্তাহ, শরণার্থীদের শিবির পুড়েছে, দগ্ধ হয়েছে দিদিমার শরীর ফের, শুনে অন্তরের অন্তস্থলে প্রবল হয় প্রদাহ; এটাচমেন্টে পাঠাতে চেয়েছিল নৃত্যনাট্যের স্ক্রিপ্ট ব্রাইড অব নাইল, কিন্তু কমজোর ওয়াইফাই, ট্রান্সফার হচ্ছে না ডাটা, উদ্বেগে উপদ্রুত হই—পাঠাতে পারবে কী ফাইল?
আট.
পত্র লিখি পত্রিকায়, অ্যাক্টিভিস্ট অভিবাসীদের সঙ্গে শামিল হয়ে দাঁড়াই রাজপথে, উড়াই যুদ্ধবন্ধের ব্যানার, বৈঠক বসে নিরাপত্তা পরিষদে, তবে হয় না কোন প্রতিকার; সংগ্রহ করি ত্রাণ, অভিবাসনের প্রক্রিয়া নিয়েও ভাবি, কিছুই হয় না মনপুত, কাটে আরো দিন কয়েক দারুণ উদ্বেগে উপদ্রুত, শুনি দিদিমার মৃত্যুসংবাদ, বোধ করি ভালোই হলো—মানুষটি ছিলেন বেজায় প্রবীণ, শরীরেও ছড়িয়ে ছিলো গ্র্যাংগ্রিন..।
নয়.
জানতে পারি, আবার পথ চলছে নাহিদ, তবে জানে না মরু-পথরেখা কতোটা বন্ধুর, কিংবা কতদূর, গন্তব্যের অনেক কিছুই তার অজানা, নৌকায় হয়তো ভেসে যেতে পারবে মিসর সিমান্তের দিকে যদি-বা পৌঁছতে পারে জোড়া নীলনদের মোহনা। না, কারো কাছে সে পাতেনি সাহায্যের জন্য হাত, ছবিতে দেখি —খার্তুমে জাতিসংঘের দফতরে ফের সক্রিয় হয়েছে কৃত্রিম প্রপাত।
দশ.
কাটে প্রতীক্ষার প্রহর, ম্যাসেঞ্জারে হালফিল আসে না বার্তা, আসে না কোন খবর। ফের রাজপথে উড়াই শান্তির পতাকা শুভ্রবর্ণা, তবে কী আমাদের তাবৎ প্রতিবাদ, জাতিসংঘের দুয়ারে ধর্না, কিছু করতে না পারার ক্লীব বিষাদ, ত্রাণ পাঠতে চেয়েও আমরা ব্যর্থ হই, পথে লুঠ হয় যৎসামান্য জল.. ওষুধ-বিসুদ.. তন্দুল, তবে কী আমাদের এ্যডভোকেসি, যুদ্ধবিরোধী তৎপরতা—সব মিথ্যা—সব ভুল?
এগারো.
যায় দিন, পাই না নির্দ্দষ্ট কোন সংবাদ, পুড়ে খার্তুম—দগ্ধ হয় দারফুর—থামে না যুদ্ধবিগ্রহ, মিইয়ে আসে প্রতিবাদ, যুদ্ধবিরোধীরা হারায় আগ্রহ; নীলনদের প্রণালীতে জলের গতিবিধি হয়ে আসে স্বাভাবিক, আমরা কেউ কেউ এখনো বোতামে ধারণ করি পায়রা চিহ্ণিত প্রতীক, মাঝেমধ্যে ভাবি, নাহিদ অতিক্রম করতে পেরেছে কী প্রতিবেশী দেশের সীমান্ত, বদলায় ঋতু, বাগিচার বাসন্তী প্রসূনে হই উদভ্রান্ত।