আকাশের কোলঘেঁষে চলে গেছে যে মেঘের পাখি
আমি তার ডানাভাঙা যন্ত্রণার পাণ্ডুলিপি পড়ে
নিজেরে বোঝাতে চাই—যে নদীর তীর ভাঙে ভোরে,
আমি তার ঢেউ গুনে পার হবো দরিয়া-জীবন!
আমাকে শেখাও যদি ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা, আমি যাবো
কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের আগে, হবো চির অভিমন্যু।
এই বুকে ঝাঁক-ঝাঁক তীরে এসে বিঁধে গেলে যাক
তবু প্রপিতামহের আশীর্বাদ থাক মাথার ওপর।
একটি সকাল তবু নামুক আন্ধার চিরে আজ
একটি গোলাপ তবু ফুটুক বেদনা ভুলে আজ
একটি চতুর পাখি উড়ে যাক আকাশে আকাশে
একটি বিষণ্ন সন্ধ্যা ডুবে যাক বাতাসে বাতাসে
পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষ মরছে আগ্নেয়াস্ত্রে
সেই মৃত্যুর খবরে হাসে আজ হায়েনারা সব
পৃথিবীতে বৃষ্টি নামে, মেঘে মেঘে রক্ত
মাঠে মাঠে রক্তের প্লাবন
যেন তুমুল আন্ধারে নামে লাল বৃষ্টির শ্রাবণ
আমাদের করোটিতে কেঁপে ওঠে বেদনার নদী।
নির্ঘুম রাত্রির কোলে কারা যেন উড়ে-উড়ে যায়
মেঘের হৃদয় চিরে হাওয়া কেটে কেটে
প্রবল ঈর্ষায় কারা যেন পুড়ে-পুড়ে যায়—ধীরে
আমাদের শিল্পকলা, আমাদের বিজ্ঞানের গতি
সব কিছু থেমে যায় অক্রম আক্রোশে।
আমরাও সুখী সুখী ভাব নিয়ে থাকি
নিজেরে বোঝাই শুধু—
বেঁচে আছি, তবু কেন অহেতুক বিষণ্ন বিকাল?
বাতাসে হেলান দিয়ে যারা বেঁচে থাকে চিরকাল
আকাশকে সাক্ষী রেখে যারা গায় জীবনের গান
তাদের সঙ্গে জীবন কেন করে এত প্রতারণা?
তবু জীবনেরে কেন তারা চিরকাল—
ভালোবেসে যায়?
কেন তারা ভালোবেসে আজীবন প্রতারিত হয়?
এমন প্রশ্নের ভয়ে কত কাল পালিয়ে বেড়াই—
কতকাল চাঁদে-চাঁদে অভিমান হলে—
আমরা গেঁথে চলেছি জীবনের সুতোহীন মালা
আমি তার রাখিনি হিসাব।
ডালিম দানার মতো লাল চোখ দূরের আকাশে
মেলে ধরে যারা হাঁটে গঞ্জের প্রান্তরে
কুঁজো হয়ে যারা যায় জীবনের ভার বয়ে বয়ে
তবু কেন তারা চায় মৃত্যুঞ্জয় হতে
জীবনেরে কেন তারা এত ভালোবাসে?
মধ্যরাতে উঠোনের পরে যারা বসে
চাঁদের আলোয়, তারা জানে
ভূতের আছর হলে বাঁশঝাড় কেন কেঁপে ওঠে
কেন হায় জমিদার বাড়ির সুন্দরী
হঠাৎ নিখোঁজ হলে বাড়িতে আসেন প্রাজ্ঞ ওঝা
কেন নাকি সুরে কথা বলে মধ্যরাতে জিনের বাদশা
কেন তবে পথে পথে ঘোরে সব অচেনা যুবক।
তারাই-বা কেন কথা বলে নাকি সুরে—
অচেনা ভাষায়?
তোমাদের ঘুম পায় নেশাচোখে ভোরের কিনারে
আলোর উত্থানে ভয় পাও বিত্তশালী
আন্ধারে করো শিকার চিরকাল গোপনে গোপনে
দুপুর রোদের কাছে তবু করো আলোর প্রত্যাশা!
হাজার চাতুর্যে ভরা তোমাদের সকাল-বিকাল
বর্বরতায় আকীর্ণ জীবনের যত অলিগলি
আমরা তবুও পেতে চাই, সহৃদয় আচরণ!
আমাদের ঘুম পায় দিন শেষে ক্লান্তিতে ভিষণ
ক্ষুধায়-ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ি মৃত লতার মতন
আঘাতে আঘাতে মরি, তবু বাঁচি সাহসে সাহসে
আমাদের জীবনেরে লোকে বলে কৈ মাছের প্রাণ
তোমরাও করে যাও চরম কৌতুক
একবার ডুব যদি দেই, তবে বারবার ভাসি
ভেসে উঠি বেদনার নীল দরিয়ায়।
বটবৃক্ষে জিন কাঁদে, বাঁশঝাড়ে বেদনার বাঁশি
পুরনো পুকুর ঘাটে রাশি রাশি স্মৃতির মাছেরা
মুখ তুলে আকাশের পানে চাহে কোন বৃষ্টিধারা?
পুকুরে শ্যাওলা ভাসে, জল কাঁপে ঢিলের আঘাতে
আমাদের কান্না তবু অতীতের স্মৃতিমাখা জলে
ধুয়ে ধুয়ে যায়।
একবার হৃদয়ের ডাকে যদি সাড়া দিয়ে মরি
চিরকাল মিথ হই, সুন্দরের পায়ে পায়ে পড়ি।