বিশাখা-বিভ্রমপুর
বিশাখা-বিভ্রমপুর থেকে ফিরে যায় না কেউ
নীলিমার স্পর্শহীন গ্রামটিতে নীরবে হয় অভিবাসী
বাস করে চিরকাল,
এখানে বাতাবরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন
জন্মহয়-তলিয়ে যায় বিস্মরণের অতলে
রেখে যায় না জীবাষ্মের কোনো চিহ্ন,
স্ফটিকের স্বচ্ছ পত্রালি নিয়ে বেড়ে ওঠে শিরিষ তমাল।
এখানে তফাত নেই দিবারাত্রির
দিব্যরথ ঘুরে-ফেরে
গন্তব্য নেই-প্রয়োজন নেই যাত্রীর।
চরাচরের ডিগবাজি খায় উল্কা-বর্ণের অজস্র বিচ্ছুরণ,
খামার বাড়ির বাস্তুহারা প্যাঁচাদের মতো
উড়ে বেড়ায় সাতটি চাঁদ
গাছের খোড়লে জমায় প্রিয় তন্দুল-যখের ধন,
জোৎস্না তিথি ছড়িয়ে ঝিমোয় ডুমুরের ডালে,
রুপালি বালুকা উড়ে-উড়ে সারাক্ষণ
ঘন বাষ্পময় বাতাসের পালে।
এখানে অসীম নিস্তব্ধতা-অনন্ত গোধূলি
পাহাড়ে জমে শিশির-স্নেহ-বিস্ময়,
উপত্যকায় ঝলমল করে লাপিস লাজুলি।
বিশাখা-বিভ্রমপুরে বাস করে মানুষ
তবে গৃহীহ য় না,
গড়ে তোলে না বাস্তুভিটা-নয় তারা ভ্রামণিক,
এখানে দিনযাপন অন্তঃসারশূন্য
দিঘিতে জল নেই, মাছ নেই-নেই পাপপুণ্য
আছে শুধু জীবনের শালুক ফোটা প্রতীক।
সপ্তর্ষি মঞ্জিল
সপ্তর্ষি মঞ্জিলের শতাব্দীপ্রাচীন কাঠামোটি আগের মতো অবিকল
তবে খিলানে চিন্নি টিকরির কারুকাজের কিছু আর অবশিষ্ট নেই,
কক্ষের পর কক্ষ-আঙিনার ফোয়ারায় জমেছে বৃষ্টিজল,
রকমারি কুঠুরির গোলকধাঁধায় ঘুরে-ফিরে পাই না খেই।
বিরাণ অট্টালিকায় বাস করে বিগত হয়েছেন যে অসুখি আমত্য
জানি-সমস্ত কিছু হয়েছে ইতিহাস প্রকল্পের বিষয়,
কিতাবখানার গ্রন্থগুলো হয়েছে উঁইপোকার পথ্য,
জলসার নৃত্যছন্দে বহুকাল হয়নি সারেঙ্গির পরিণয়।
অলিন্দের দেয়ালে সরিয়ে ফেলা তৈলচিত্রের ভারী ফ্রেমের দাগ,
ফরাসি জানালার ভাঙাচোরা কাঁচে আলো আঁকে রশ্মির বর্ণালি ফাগ।
আঙিনায় প্রোথিত জংধরা বাজুকাটির নল মুখে ঘাসপাখি বেঁধেছে নীড়,
এ পরিসরে শতাব্দীকাল উচ্চারিত হয়নি বন্দিশ-তারানা কিংবা মীড়।
কাছ থেকে নিরিখ করে দেখি,
ব্রোঞ্জের সিংহটির চোখে গাঁথা যমজ পাথর-মেকি!
তবে বেদির মোজেক থেকে মুছে যায়নি ইবাদতের স্মৃতিময় ইন্দ্রনীল,
তসবিরের ছাপ আছে—চিত্র নেই—স্বাক্ষরে লেখা ছিল অমৃতা শেরগিল।
চাঁদ-সরোজে বাড়ে অব্যক্ত কথার মনস্তাপ
একটি বিষয় তোমাকে হয়নি বলা
ঘানার বাজার থেকে কেনা যে মুখোশগুলো ঝুলিয়েছি দেয়ালে
তাদের অক্ষিগোলকে রাত নিশীথে জমে ওঠে জল
যখন গুলবাগিচা হয় নিষ্ফলা
তাকিয়ে থাকে তারা কী যেন এক খেয়ালে…
তিবলিসির পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা
প্রকাণ্ড সে আকর কেতাবটি থেকে বেরিয়ে আসে চিত্ররাজি
কিছু ফিগারিন নৃত্য করে ফ্লোরে-ঢিমেতালে দেয় ডিগবাজি
ক্লদ মোনের পুকুরটি কাঁচের টেবিল-টবে ফোটায় গোলাপি শালুক
কাউচে কম্বল টেনে মুড়ি দেয় আলাস্কার তুলতুলে গ্রিজলি ভালুক…
ক্রুসেডি জামানার একটি কেল্লা
ফায়ার প্লেসের শিথানে উঠেবসে-যেন শোপিস এক অবিকল
আঙিনায় ফুটে ওঠে পূর্ণিমার মন্ত্রমুগ্ধ ছল
ঔক বৃক্ষরাজির খোড়লগুলোর কার্নিশে বসে
নয়টি কাঠঠোকরা মশগুল হয়ে জোৎস্না দেখে
জাদু বলে যেন থেমে গেছে তাদের ঠুকঠুকানো সংলাপ
এ বিষয়টিও বলা হয়নি তোমাকে
তাই চাঁদ-সরোজে বাড়ে অব্যক্ত কথার মনস্তাপ।
আতরের ছোট্ট শিশি
বুঝতে পারছি তোমার সময় কম
কফি করার প্রয়োজন নাই,
রজনীগন্ধার সন্মোহনে এ সন্ধ্যা অনুপম
আতরের ছোট্ট শিশিটা রেখে যাই;
স্বীকার করি আমার পদাবলিতে ফুটছে তোমার স্তব
তলানীতে আছে সুগন্ধী তরল সামান্য,
আর কিছু নয়-ছড়াতে চেয়েছি সকাল-সন্ধ্যাসৌরভ
ওমান ভ্রমণের প্রাক্কালে কিনেছিলাম এ পণ্য;
হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাবে অকস্মাৎ
ছড়িয়ে পড়বে ফুলের নির্যাস,
কাছে আসার প্রেষণা-অভিমান অথবা আঘাত;
পেয়েও হারানোর সন্ত্রাস
থাকে না কিছুই দীর্ঘদিন,
দেখো চেয়ে-ভাঙা কাচের টুকরোগুলো
আমার স্বপ্নের মতো রঙিন।
ভুলে যাওয়া গানের কলি
ভুলে যাওয়া গানের কলিটির কথা ভাবলেই
চোখে ভাসে সাঁতারকাটা জোড়াহাঁস-পানাপুকুর,
মুথাঘাস ছড়িয়ে খড়ের গাদার ওপাশে ধানগোলা
বাতাবি লেবুর গাছতলায় বসে হাই তুলে খেঁকি কুকুর,
ভাঁপা পিঠার চীনে মাটির বর্তনে খুদকুড়া খুঁটে আরশোলা।
মাঝে-মাঝে অহেতুক খানা তল্লাশিতে মাতি
নিজের ভেতর পাললিক মৃত্তিকা খুঁড়ে
খুঁজতে খুঁজতে চলে আসি অবশেষে
জায়জরং বিলের পাশে লোহার লাল পুলে,
শুভ্র ঘাসফড়িংয়ের ঝাঁক বাতাসের তোড়ে
আশ্রয় খোঁজে সর্ষের সোনালি গোকুলে।
ক্যানভাসে কেন জানি ফুটে ওঠে
জেলে নৌকার গলুই ছুঁয়ে হৃদয়নীল গোধূলি
খুঁজেছি অনেক-মনে হয় পাবো না
যাকে বলা যায় মুখ ফোটে
কতটা নীলাভ আমার নিজস্ব লাপিজ লাজুলি।