বিপরীত ছায়া
আমি তোমাদের মত হতে চাই না
এই যে তোমাদের মসৃণ ত্বক আর অহং নিয়ে দৌড়ঝাঁপ
বিড়ালের মত খুঁটে খুঁটে ছিড়ে ফেলো নকশি কাঁথার
সুক্ষ্ম সুতো
আবার ভীত হতে হতে ইঁদুরের মতো লুকিয়ে পড়ো গর্তে
ঠিক এমনটা আমি হতে চাই না।
প্রাণী, পোলিনেটর-প্রতিবেশী জীবাশ্ম জীবনকে বাঁচাতে
হতে চাই পুরনো বৃক্ষ
উদ্ভিদের দেহকে আচ্ছাদিত করে রাখা বাকল হতে চাই
আঁধারকে আলোকিত করা সূর্যরশ্মী কিংবা পূর্ণচাঁদ
উচ্চে উঠতে চাই না
হতে চাই উঁচু পাহাড় কিংবা গির্জার স্তম্ভ-যেখান থেকে
দুর্বিন চোখে দেখা যাবে অনাহারি মানুষ;
মানুষের হাহাকার।
আমি হতে চাই তোমাদের বিপরীত ছায়া
যেখানে জীবনের গল্পরা উড়ে বেড়ায় ধুলিকণায়
বেলকনিতে বসে ধোঁয়া উঠা পুরনো চায়ের কাপে
ভেসে বেড়ায় বৃদ্ধার পুরনো স্মৃতি
হতে চাই প্রথম শিক্ষার উপকরণ কাঠের খড়ি
বিদ্রোহী কবির কবিতার অক্ষর
উপলদ্ধিতে বুঝতে চাই, মানুষে মানুষে সমতা ভুলে;
মানুষ-কুকুর কেন এক কাতারে ঘুমায়।
আমি তোমাদের মতো হতে চাই না।
নির্বাসন
অন্ধ সেজে থাকি, অনিচ্ছায় নয়-ইচ্ছায়
দূরত্ব টেনে রাখি, আলো থেকে নয়-আভায়
নীলে নীলে পিচ্ছিল পথ, পেরিয়েছি তার সবটা
আরো কতদূর যেতে হবে মঞ্চ কাঁপাতে হলে
কতদূর বাকি কথ্যক নাচের…
তাই বোবা সেজে থাকি, অকারণে নয় প্রয়োজনে
স্থানান্তরে জিহ্বাকে ধরে রাখি-উচ্চারণে
জানি তো কতটা বেরিয়ে গেলে বুক ভেঙে চুরচুর হয়
কতটা উগরে দিলে শেষে অস্তিত্বের সংকট প্রকাশ হয়…
বধির সেজে থাকি, শখে নয় নিরুপায়
প্রসবকালীন জটিলতা নয়, শব্দদূষণের তীব্রতায়
ফিসফিস গুঞ্জন, কোকিলের সুরে তিক্ততা বাড়াতেই
সাম্যের গান পথবিচ্যুত হয়
ধসে পড়ে ছাদ কারও ঘরের মেঝে ছেড়ে উঠোনে
সর্বহারা মানুষ ফুঁপিয়ে কাঁদে নগ্ন সভ্যতার দোরগোড়ায়…
সবশেষে জরাগ্রস্ত হয়ে যাই
ক্ষুধা কিংবা অভাবে নয়, চারপাশে দেয়াল টেনে;
নিজেকে পৃথিবীর জটিলতা থেকে উন্মুক্ত করে রাখতে।
আটক
প্রসারিত ডানায় পাখিটি ওড়ছে-অন্তহীন নীলে
পুড়ে যাওয়া সোনার মতো জ্বলছে পালক
নিউটনের তৃতীয় সূত্র ধরে ওড়ছে সে;
বাতাসকে ধাক্কা দিয়ে
উড়তে উড়তে উড়ে যায় তার উজ্জ্বল পালক
গাঢ় রঙ আর ঘ্রাণ ছড়ায় আকাশ জুড়ে
গাছের চূড়া থেকে উঁচু উপত্যকা
ঘন বন বা ক্ষেতে
আকাশের বুকে প্রশস্ত অরণ্যে
ভোরের প্রথম আলো থেকে গোধূলি
পাখিটি গল্প বুনে স্বাধীনতা নিয়ে জোয়ার-ভাটার
এই ডানায় আমি স্বপ্ন দেখেছি অফুরন্ত সম্ভাবনার
নিছক আনন্দে মেঘের সাথে তার নৃত্য আর
সীমাহীন উড়ানকে তাই; খুব হিংসা করি।
গোলযোগ
অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, অনেকটা
আদিম বনের হৃদয়ে রহস্যে ঘেরা ডেভিলস কেটলের মতোই
মনকে বাঁচিয়ে রাখে মুগ্ধতায়, মিথ্যাচারে
মরে গিয়ে কেউ পুনরুত্থিত হয়নি
সাত থাই-তবু মন্দির প্রাঙ্গণে জ্বালায় লাল মোমবাতি
সুগন্ধি ধূপকাঠি
বিমূর্ত ভাবনারা গভীর, অন্ধকার অতলে
অদৃশ্য হয়ে যায় কোনো সাক্ষ্য ছাড়াই,
অনুত্তরিত প্রশ্ন পেছনে রেখে।
জানি তো, ভূতাত্ত্বিক কৌশলে ক্ষয় হয় জলের শক্তি
অশুচি ছায়া-খেয়ে যায় ভেতর, ভেতরের চেতন
অভ্যন্তরীণ গোলযোগ-এক চরম হতাশা।
দাঁড়িয়ে আছি অন্ধকারের বিরুদ্ধে
দাঁড়িয়ে আছি পাহাড়ে
দাঁড়িয়ে আছি উপত্যকায়
দাঁড়িয়ে আছি অনিশ্চিত সময়ে
মোহাজালে আবদ্ধ পথ ঝুঁকিতে পূর্ণ
অনিশ্চিত যাত্রায় প্রতিটি ধাপ-একটি জুয়া
খোলা আকাশের নিচে ভীষণ সংঘর্ষ
মেঘে মেঘে দ্বন্দ্ব
ঝড়-বৃষ্টিতে দ্বন্দ্ব
তুমি-আমিতে প্লাবন শেষে
সিঁড়িঘরে মাকড়সার জালে পতঙ্গের
আটকে পড়ার ভীষণ আতঙ্ক
দাঁড়িয়ে আছি পুরনো মোটা গাছটিতে
প্রাচীন শাখার ছায়ায় লুকানো কিছু আত্মা
জুতোর ফিতেবাঁধা চাপে ভুলে গেছে পাহাড়-অরণ্য
ভালোবাসার কথা
দাঁড়িয়ে আছি সময়ের পিঠে
সময়ের স্রোতে হেঁটে যাচ্ছি
অদৃশ্য প্রহরের মুখোমুখি হতে অতীতের ছবি
ঘষেমেজে স্পষ্ট করছি
স্মৃতির জলে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে
পাহাড় তার অবস্থান ছেড়ে কুঁজো হচ্ছে
আমি সত্যে দাঁড়িয়ে আছি, অন্ধকারের বিরুদ্ধে
এর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে?