বাংলাদেশ–১
বাংলাদেশ মুখস্থ করেছি শৈশবতলায়
এরপর এক ধাক্কায় বিদ্যালয়কে দিয়েছি নামিয়ে বৃষ্টিতে
ভিজতে ভিজতে দেয়াল-ছাদ, উত্তল মেঝে, সব ভেসে গেছে
ছেঁড়া দপ্তরির হাতে ঝুলে আছে কাটা-রেলপাতঘণ্টি, মুহুর্মুহু বজ্রপাত
ক্লাসরুমগুলো বজ্রাতঙ্ক প্রাণীদের চারপায়ের স্বাধীনতা
ক্যাটারপিলারের মতো শুয়ে আছে বেঞ্চগুলো দুই রকম উচ্চতায়।
ব্লাকবোর্ডে যারা চোখ মেলেছিল, সেইসব নাবালক স্বপ্নেরা গলে যাচ্ছে,
গলে গলে পড়ছে মিথ্যের প্লাটফর্মে।
মদন মোহন তর্কালঙ্কারকে রঙিন ইরেজার দিয়ে মুছে দিচ্ছে নর্থ-সাউথ জেনারেশন
বৃষ্টি হচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে বাংলা একাডেমি
ডুবে যাচ্ছে বড়ু চণ্ডীদাস
কুসুমকুমারী দাশের চিতায় সহাস্যে আগুন দেয় মেধাবী ছাত্র রাজনীতিক
টিভি স্ক্রিনগুলো থেকে ফিনিক্স পাখিরা বেরিয়ে এসে খেয়ে ফেলছে অসহায় দোয়েলগুলোকে
আসাদের রক্তাক্ত শার্টকে পতাকা বানিয়ে মন্ত্রীরা গাইছেন, ‘জনগণমন অধিনায়ক হে’
‘বাংলা ভাসাকে লিয়ে জান দেঙ্গে’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন
কেউ কেউ সিংহাসনের নড়বড়ে পায়ে।
নদীগুলো অজগর সাপ হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে শহরের দিকে
রাস্তাগুলো লোভের ভারে দেবে যাচ্ছে খানা-খন্দে
বাজারগুলো, মলগুলো, বারবনিতার মতো কাপড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে
সিনেমা হলগুলো থেকে ধোঁয়া উঠছে অশ্রাব্য ভাষার…
বাংলাদেশ-২
কাল রাতে আমার আবারও মৃত্যু হলো
ঘটনাটি এবার খুব নীরবেই ঘটে গেল, টের পায়নি কেউ
এবং তা ঘটলো খুব বৈধভাবেই
কোনো কান্নার শব্দ নেই, আহাজারি নেই,
দুঃখ-দুঃখ মুখ করে নিজেদের বিকৃত চেহারা টিভি ক্যামেরার সামনে
তুলে ধরতো যেসব ক্রন্দনজীবী, ওদেরও কাউকে দেখা যাচ্ছে না আশে-পাশে,
এমন কি সৎকারেরও কোনো আয়োজনও দেখছি না।
সাংবাদিকদের নড়া-চড়া দেখে মনে হচ্ছে মৃত্যু নয়, বরং ওরা অন্য কিছু নিয়েই অধিক ব্যস্ত
কোরান, গীতা, বাইবেলের দখলদারেরাও মৌন এবং ধ্যানস্ত নিজস্ব ধর্মশালায়
দেবে যাওয়া রাস্তা, শুকিয়ে যাওয়া নদী এবং পুড়ে যাওয়া বন পেরিয়ে
ওই দূরে যে লর্ড ক্লাইভের বাগান, ওখানে মঞ্চ সাজানো হয়েছে
ধোপদুরস্ত নিভাজ ধুতি-কোর্তার মতোই পরিপাটি ফুলের বুকে সারি সারি রাখা আছে মঞ্চে,
সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন এক মহামানবের।
তিনি এলেই কিছু একটা হবে…
আমার বুঝতে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল যে প্রকৃতপক্ষে মৃত্যু নয়,
বরং আমার পুনর্জন্মেরই আয়োজন চলছে।
বাংলাদেশ-৩
লোকটির পাহাড়ের মতো দু’পা টলছে
শহরের প্রধান স্কয়ারে এনে দাঁড় করানো হয়েছে ওকে
কোর্তার পকেট থেকে দুটি ঈগলশিশু বেরিয়ে গেল
দেহের চেয়ে স্ফীত একটি মাথা কোনো রকমে বসে আছে ওর স্কন্ধদেশে
তার চেয়েও বড় মুখ, ঠোঁট দুটো সমুদ্রের বিস্তৃত তটরেখা।
সমবেত জনতার মধ্য থেকে একজন, সম্ভবত নারী,
চিৎকার করে কিছু একটা বলল
দু’জন সামরিক-দর্জি মই বেয়ে উঠে এলো লোকটির দুই কাঁধে
এরপর বড় বড় দুটি সুঁই দিয়ে
সুবৃহৎ দানবীয় লোকটির ঠোঁট দুটো সেলাই করতে লাগলো
ওর দু’চোখের অশ্রুধারায় দুটি নদী হলো
একটি গঙ্গা এবং অন্যটি ব্রহ্মপুত্র।
বাংলাদেশ-৪
সড়ক দুর্ঘটনায় অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর
বন্ধুরা ভাবছে, আমি আর চোখে দেখতে পাই না।
ওরা প্রায়শই আমার হাতে অচল মুদ্রা তুলে দেয়,
অথচ ওরা জানে না যে আমি এখন
আগের চেয়ে দেখতে পাই অনেক বেশি।
সৈকতে দাঁড়িয়ে ওরা মেয়েদের নগ্ন শরীর দেখে,
আমি দেখি পুড়ে যাচ্ছে নগর,
ওরা দেখে মেয়েটির নীল চোখ,
আমি দেখি দুটি দেশলাই-কাঠির মাথায় বারুদপিণ্ড, বিস্ফোরোনোন্মুখ।
ওরা সমুদ্রের ঢেউ দেখে, আমি দেখি আগ্রাসন
ওরা আকাশ দেখে, আমি দেখি শরনার্থি শিবির, লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু
ওরা দেখে বাগান, গোলাপের গুচ্ছ…
অথচ ওরা জানে না, এটা বাগান নয়, সংখ্যালঘুদের মিছিল…
ওরা মেঘের ভরাট দেহ দেখে কালিদাসের সাথে
কফির পেয়ালা নিয়ে বসে যায় হাওয়ার বারান্দায়
অথচ ওরা বুঝতেই পারে না ওগুলো গোলাবারুদের একেকটি ওয়াগন।
ওরা কুচকাওয়াজ দেখে, আততায়ী দেখে না
ওরা জামদানি-রাঙা উৎসব দেখে, জল্লাদের আলখেল্লা দেখে না।
ওরা একটুও বুঝতে পারে না, আমি, এই অন্ধ,
এখন দেখতে পাই ওদের চেয়ে ঢের বেশি।