এক.
কোথাও যেতে হয় না আমাকে আজকাল। ভোরবিহানে চেস্টনাট উডের দেরাজ দেওয়া টেবিলটিতে বসলেই হামেহাল, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফিল্মের মতো আবছাভাবে জানালায় এসে দাঁড়ায় ফ্রিটাউন। চোখ বন্ধ করে আমি হিসাব কষি—যোগ-বিয়োগ-গুণ; যে ভদ্রাসনের চাকাওয়ালা কুরছিতে এ মুহূর্তে বসে আছি, তার সাথে ফ্রিটাউনের অজস্র ক্রোশ দূরত্বের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবি। হাতে যেন চলে আসে আপাত অদৃশ্য এক দেউড়ির চাবি। মনে হয়, শরীর ও মন সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাচ্ছে তিনতলার ঝুলবারান্দায়। দিগন্ত ছুঁয়ে দরিয়ায়—ঊর্মিনন্দন জলরাশিতে বাসরের লাজনম্র আলোর মতো ছড়াচ্ছে ক্রিমসন আভা, ঔপনিবেশিক জামানায় যা ছিল রীতিমতো স্থাপত্যের গৌরব, স্পষ্ট হয়ে ওঠে হিলস্টেশনে কাঠের ভিলাগুলোর অবয়ব।
দুই.
শ্বেতাঙ্গ সাহেবরা বিলেতে ফিরে গেছে কতকাল। ঘরগুলো ঝুরঝুরে হয়েছে বটে, হয়েছে বেহাল, তবে ভেঙেচুরে যায়নি একেবারে। নোনাধরা সিঁড়িতে লিম্বা গোত্রের কৃষ্ণাঙ্গ দুই নারী ব্রেইড করে দিচ্ছে পরস্পরের চুলে। সম্ভাবনার দুয়ার খুলে—উঠেছে রোদ, ঝলসে উঠেছে হাত আয়নায় ছায়ার প্রতিশোধ। ক্লাবঘরের আঙিনায় টেনিসকোর্ট, তাতে শুকাতে দেওয়া হয়েছে ডগমগে লাল মরিচ—বেশুমার। আমি লংকাদীপ্ত লাল গালিচাটির দিকে তাকিয়ে থাকি, ঝলসে উঠে স্তনাঞ্চলে বীডের মণিহার। ফ্রিটাউনের দৃশ্যপটজুড়ে ছড়ায় মেঘমদির কুয়াশা, আবছা হয়ে ভেসে ওঠে পাহাড় ছড়ানো একটি বহুতল ভবন, তার ছাদে হেলিকপ্টার—অবহেলায় মরে পড়ে থাকা নেতানো ডানা গঙ্গাফড়িংয়ের মতো। ভাবনা আপাতত, এ ইমারতে আজ বাস করছে যারা, প্রতিবেশী হবে কী তারা—ভিন্ন কোন লোকে? বেঁচে থাকবে দালানটি কিন্তু দুঃখ-সুখে…বহুকাল, আসবাবপত্র হবে প্রাঙ্গণের তাল ও তমাল, আর হেলিপ্যাডে হয়তো গড়ে উঠবে শাকসব্জির অর্গানিক খামার।
তিন.
ভোরবিহানে নিশি পাওয়ার ব্যাপারটি ঘটে, বেরিয়ে আসি আঙিনায়—মৃদুসৌরভে খোয়াবগাহের সংবাদ রটে। চতুর্দিকে ছড়াচ্ছে ঝরা শিউলির মহিমা অপার, ড্রাইভওয়ের দিকে যেতে যেতে দেখি, ছাপড়াঘরের দাওয়ায় চুল্লিঘিরে জমেছে সংসার। কোয়াড বাইকের হাতলটি ছুঁই, হুটহুটিয়ে পাখা ঝাপটায় ধূসর জামেয়ার পরা এক লক্ষ্মীপ্যাঁচা, দৃষ্টিভ্রম নয়, বরং বলা চলে ব্যতিক্রম, দিনযাপনের হরেক জাঁতাকলে হামেশা পিষ্ট, বলা মুশকিল হে—খেচরদর্শনে প্রসন্ন হবে কি অদৃষ্ট?
চার.
চলছে স্বপ্নের নিদান মৌসুমজুড়ে, পাচ্ছি না খুঁজে নিরাময়ের নির্দিষ্ট শেকড় মাটি খুঁড়ে। এ ক্লান্তি অশেষ, কোনার্কের চিত্রপ্রতিম কাম ও পাপোষের মতো কর্কশ ক্লেশ—শরীরে ধারণ করে স্টার্ট দেই কোয়াড বাইক। বাঁকে দাঁড়াতে হয় একটু। পাঁয়জোরের প্রবল নিক্বনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাই, হেঁটে যায় জাফরানি রঙের চুড়িদার পরা পা, সেলফোনে ছায়ানিবিড় হয়ে বাজে ‘সিতারা উমিদ সোবে কা…’। পাশ কাটি, ফুটপাতে জংধরা হিলম্যানের চেসিসে শুকোতে দেওয়া হয়েছে বাটিকের বৃত্তাকার স্কার্ট, নোনাহাওয়ায় পতপতিয়ে ছড়ায় অবদমনের খেদ। ভাবি—স্মৃতিময় স্বদেশের কথা, বিদেশের সাথে নিমিশে ঘুছে যায় দূরত্বের প্রভেদ।
পাঁচ.
পাহাড় প্যাঁচিয়ে নেমে আসি চার চাকায়। নিচে—হিলস্টেশন, সাহেবী জামানার রেলওয়ে ঠেক, বসেছে কাঁচাবাজার, ভিড়ভাট্টা পরিহার করে একটু আগাতে চাই। খুলে ফেলে নিম্নাঙ্গের পোষাকি ভেক, চিলচিৎকারে মাতে বোধ করি উন্মাদ। কী নিয়ে হাটে যেন বাঁধে কোন্দল, শোর ওঠে, শোনা যায় বাদ প্রতিবাদ। হিজাবপরা মেয়েটি মডেলকন্যার মতো ক্যাটওয়াকে এগিয়ে আসে, তার নিঃশ্বাসে স্ফুরিত হয় ভাঁজ। কাঁকালে আঁকড়ে ধরা জোড়া কালাবাস। হাঁটু গেড়ে বসে বাড়িয়ে দেয় কামরাঙা—তারাফল, চোখেও যেন ফুটে খানিক ছল। নরোম পায়ে বাতাবিলেবুর ওপর দিয়ে টুকটুকিয়ে হাঁটে দুটি পাখির ছানা, দেখায় তাদের গোলাপি জিভ, এই মুহূর্তে নির্লিপ্ত থাকা, লেনদেন না সারাটা মনে হয় নিতান্ত ক্লীব।
ছয়.
চাকা চারটি সচল হতেই চোখেমুখে লাগে নোনা হাওয়ার কবোষ্ণছোঁয়া। ইচ্ছা হয় সংগীতের মতো নির্ভার হই, কর্পূর হয়ে উবে গিয়ে ভেসে থাকি সৌরভ-নীলিমায়। বিব্রত হৃদয় তো নয় যক্ষের ধন, কী হবে তাকে আঁকড়ে ধরে, চাপ বাড়াই, ইচ্ছা হয়…ছড়াই অনুরণন। বাড়ে গতিবেগ, বোবাছেলেটি ছুটে আসছে, তার নির্বাক আবেগ, তৈরি করে দৈহিক রেখাচিত্রের দরখাস্ত, ঝুঁকে পাখা ঝাপটানোর মতো ইশারা করে। ছেলেটি চেনা, ঘুরে বেড়ায় ফুটপাতে উদয়াস্ত। চিলতে অপেনিং দিয়ে দেখি—লেগুনে ভাসছে শৌখিন নৌকা…পালে পরিপাটি। ভাবি, না হয় রাখি ছেলেটির অনুরোধ, মুলতবি হোক সামান্য সময় আমার আকুল অ্যাংজাইটি।
সাত.
ব্যাকুল বাহনটিকে পার্ক করতে হয় অবশেষে। বোবা ছেলে স্যালুটে পারঙ্গম, হাসিতেও তথৈবচ। দোকানটি লেবানিজ, আঙিনায় দাঁড়িয়ে আড়কাঠিরা আড়ে আড়ে ফেরি করছে রকমারি খনিজ। ক্যাশবাক্সের ওপর চিত্রিত প্রভুর নাম সংকীর্তণ, দেয়ালজোড়া কাসকেটে খেলনা রিভলভার, নিচে অলিভের সতেজ বন, বাঁকানো ক্যালিওগ্রাফে ছড়াচ্ছে বিমূর্ত উন্মাদনা, এসে যখন পড়েছি, পণ্যের সাথে গড়ে তুলতে হয় হে কিছুক্ষণের বনিবনা। চলে আসি জয়তুনজারিত নির্যাসের আইলে। ওপাশে—শরাবের শিশি হাতে গাছের আবডালে হরিণীর মতো সরে যায়, চকিতে দেখি তার দ্রাক্ষা-সবুজ চোখ…কুহক সর্বনাশা, আমার কৌতূহলের লেবুজলে মুহূর্তে মেশে মিছরির মৃদু ভালোবাসা। দুহাত কাটা কৃষ্ণাঙ্গ ডোরম্যান এগিয়ে আসেন, তার চোখমুখ-পাঁজরে আলিঙ্গনের ভঙ্গি, হঠাৎ করে পেয়ে যাই যেন কবোষ্ণ সান্নিধ্যের খোঁজ, আইপ্যাডে বেজে ওঠে বৈরুতের বিদুষী ফাইরোজ।
আট.
আমাদের নিজস্ব নক্ষত্রটি নেমে এসে ছুঁয়ে যায় শরীর। দিব্য আভায় ফুটেছে রোদের চন্দ্রমল্লিকা—আশ্চর্য অধীর, এমন মক্ষিকা-মুগ্ধ জেল্লা ছড়ায় না তো অহর্নিশ, ভাবি, কাছে এসেছি যখন পাহাড়টিকে না হয় করে যাই কুর্নিশ। সর্পিল সড়ক ধরে মেঘ নিশানা করে ঘোরে চাকা। গাইতি-শাবল চালিয়ে মেহনতীজন খুঁড়ে বের করছে বিপুল পাথর। সড়কে—চূড়োর দিকে আগুয়ান—পিঁপড়ের রেলগাড়িটি চারকোলে আঁকা। পাহাড়-গায়ের গর্তগুলোকে দেখায়—অপারেশন থিয়েটারে অন্ত্রতন্ত্র খুলে ফেলা শরীরের মতো জখমে নিরুপায়—নিথর। দেখি, বৃক্ষ কিডন্যাপারের হাত থেকে কপালজোরে বেঁচে যাওয়া একটি তরুবর, তার শাখায় বসে ঝিমোয় বুড়ো হনুমান। কাণ্ডে আঁকা যুগল হৃৎপিণ্ডের তসবির, দাঁড়াই মহূর্তে কয়েক, ভাবি—অজানা জুটি পেয়েছিল কি ভালোবাসায় পরিত্রাণ?
নয়.
বাউলা বাহনটিকে বিশ্রাম দিয়ে একটু হাঁটি। চূড়ার দিককার রিজে ফুটেছে প্রতিমার চালচিত্র, খেলছে রকমারি রোদ। বুকডনের ভঙ্গিতে প্রফুল্ল হয় জোড়া-গিরগিটি, আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সব্জিসতেজ বোধ। না হয় মুলতবি হোক পিঁপড়ার তন্দুলপ্রয়াসী কাজ, নিরলে তৈরি হয় নিবিড় কদরদানি, অপঘাতে উজাড় এই বনানীতে বেজে ওঠে মেঘমিথুনের ওয়ালজ। কোথা থেকে উড়ে আসে বিপুল কুয়াশা, তার মীড় ও মূর্চ্ছনায় জমে উঠে শ্বেতশুভ্র সরোজের বাগিচা, কুণ্ডুলায়িত ধূসর এক আজদাহা ঘুরে ফেরে, শিকড় উপড়ানো গহ্বরে শিশিরের জিভ দিয়ে ছুঁয়ে যেন খুঁজে অপঘাতে হারানো দোসর, জানতে চায়—প্রয়াত হয়েছে যে তরুরাজি, কুরছি-কেদারায় তারা উজালা করেছে কার ঘর?
দশ.
ভরদুপুরে ধুমকেতুর পুচ্ছের মতো মেঘনিবিড় কুয়াশা কেটে নেমে আসি পাহাড়তলীর সড়কে। নিত্যদিনের নিদান উপেক্ষা করে নিভৃত নির্জনে বেজে ওঠে সপ্তসুর, আবেগকে সামলানোর প্রয়োজন কী-বা, ইচ্ছা হয় জোরে হাঁকাই যন্ত্রচক্র, ছাড়িয়ে প্রপাত—জাহাজঘাটার পাশঘেঁষে খুঁজে নেই নগরীর অন্তপুর। পাঁচশত বৎসরের পুরনো ক্যাপোক বৃক্ষটি তৈরি করেছে নিটোল ছায়া। ফিরে আসা ক্রিতদাসরা এ তরুবরের গোড়ায় দাঁড়িয়ে নিয়েছিল আত্মনিয়ন্ত্রণের শপথ, তাদের অধস্তনরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র, ভাবি—ছিন্ন হয়েছে কি দাসখত? আমিও পেয়ে যাই আজ—পত্রালীর সহিষ্ণু ছায়া—সুশীতল, তবে কাটাতে পারি না এ জনপদের মায়া, বাতচিত করি মুখোশবিক্রেতা মানুষের সাথে, সঠিক পণ্যটি পাই না খুঁজে, রিক্ততায় ভরে ওঠে অধীনের অন্তঃস্থল।
এগারো.
বিকালের রোদজল নেমে যায় ভাটিতে। ইচ্ছা হয় না ভদ্রাসনে ফিরতে। গড়িয়ে চলে আসি কাঠের সেতুটির ওপর। গোধূলিপ্রিয় কাদাখোঁচারা টুকটুকে পায়ে বালুকা ছুঁয়ে পাড়ি দিচ্ছে নোনজলের নহর। কিংবদন্তীর মহিরূহ থেকে বেরিয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড়, স্বপ্ন দেখে কি তারা, বিক্ষত হবে যে আজ রাতে কদলীর কুচবরণ থোড়? দেখতে দেখতে নেমে আসে সন্ধ্যা, নিচের খাড়িতে পড়েছে পলিমারের প্রলেপ, হয়েছে অনাব্য বন্ধ্যা। ওপারের গির্জাঘরে জ্বলে ওঠে পিলসুজ, বাজে ঘণ্টা। মুক্তি পাওয়া ক্রীতদাস নিয়ে এসেছিল যে পালতোলা জাহাজ, তার কড়িবরগা ও হালে তৈরি হয়েছিল এ গির্জাঘর, থেমে পড়ে গুনি পল…অনুপল…মুহূর্তে বিগত প্রহর। হাওয়া লাগা শ্বাসমূলের স্বরলিপিতে বাজে পিয়ানো। শরীরের সর্বত্র একাধিক মুখোশ লাগিয়ে ঘুরছে যে দুটি মানুষ, দেখে মনে হয়, জেগে উঠেছে জোড়া দৈত্যদানো। রাত গাঢ় হয়, ক্রমাগত নিরিখ করি নৃত্যপ্রবণ রঙ্গমঞ্চ, পিপাসার দৌড়ানো জলে তৈরি হয় মসলিন, দেখছি যা, তা কিন্তু নয়, মনে হয়—সব প্রপঞ্চ।