ফকির ইলিয়াস
কামার অথবা ঘোড়সওয়ার
দীর্ঘতম পথ পেরিয়ে যারা রাজপথে আসে, আমরা
তাদের বলি ভ্রাম্যমাণ পথিক। প্রতিদিন ফুঁ দিতে দিতে
কাঠকয়লার আগুনে যারা ইস্পাতকে পোড়ায়- আমরা
তাদের বলি কামার।
পথিক এবং কামার
কামার এবং পথিক
দু’জনের প্রশ্বাসের ভেতর জমে থাকে যে নীল,
তা দিয়ে আমরা কোনো ছবি আঁকতে পারি না।
যে চিত্র আমরা আঁকতে পারি, তার ছায়া স্থাপিত
থাকে বিরহের মেঘমঙ্গলে। আমাদের উনুন
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যে জল বাষ্প হয়ে উড়ে, অথবা রেসে
প্রথম হবে বলে জীবন বাজী রাখে যে ঘোড়সওয়ার-
পৃথিবীর সকল আনন্দ ডুবে থাকে তাদের নেপথ্য বেদনায়।
আমরা পর্দার রঙ দেখি। পর্দা সরাতে পারি না।
কেউ কেউ মনে রাখবে
কোথাও আলোহীন রেখা ছুঁয়ে ছুঁয়ে তুমি কাটিয়ে দিয়েছ পঁচিশ বছর।
কোনও পাতা স্পর্শ না করেই তুমি বৃক্ষের শরীরে জমাট করে রেখে
দিয়েছো, তোমার ছায়া।আমি সেই ছায়ায় খুঁজেছি প্রণীত দেবীদের মুখ।
আমি বৃষ্টির ঘনায়ন দেখেছি- তুমি দেখোনি
আমি লতার বনায়ন দেখেছি- তুমি দেখোনি
আমি রাতের গ্রহায়ন দেখেছি- তুমি দেখোনি
প্রকৃতপক্ষে দেখার জন্য কোনো চোখের দরকার পড়ে না।
কেউ কেউ নাম মনে রাখতে পারে- কেউ মনে রাখে নামের বেদনা।
কাঠের ক্যাটালগ
সেগুন,পাইন কিংবা কদমের শরীরে আঁকা অক্ষর নয়-
মুক্ত নদী অথবা নীলাক্রান্ত আকাশের গহীনে
ডুবে আছে যে শব্দের সংসার
. তার দিকে আরেকবার তাকাও।
দেখবে সেখানেও রক্ষিত আছে আমার নাম,
আমার বর্ণের ছটা,আমার পঙ্ক্তির দ্যুতি-আমার প্রেম।
.
আমি কোনোদিনই প্রেমগল্পের কোনও ভোরের কাছে
সমর্পিত হইনি। কোনো অগ্রহায়ণের কাছে-
ভিক্ষে চাইনি ধানের ধ্বনি।
কিংবা ফসলের জন্য নতুন মাটি দিয়ে
উঠোন লেপে রাখে যে কিষাণী-হতে চাইনি
. তারও ঘরপুরুষ।
বনের অন্তরালে প্রশাখাগুলো লিখে রাখে
যে কাঠের জীবনী,
. হতে চেয়েছি তার জীবনীকার।
খোদাই করা বৃক্ষের ক্যাটালগে, লিখে রাখতে চেয়েছি
গ্রামপোড়া বাউলদের একতারার আর্তনাদ।
ফারহানা ইলিয়াস তুলি
রৌদ্রসমিতি
টুকরো মেঘকে সাজিয়ে রাখবো ভোরের আড্ডায়,
যে সূর্য নিজে সেতার হয়ে বাজে-
. কিংবা যে শিশির পৌষের জন্য
সাজায় তার মমতার আকাশ,
তার জন্য আমি এঁকে রাখবো আমার বালিকাবেলা।
যে রৌদ্রসমিতির তালিকা আমার নাম
কাগজে লিখে উড়িয়ে দিত হাওয়ায়-
ফিরে যেতে চাইব তার কাছেই।
জীবন, সন্ধ্যার ভেতরে ভোর জমা রাখে,
ভোরের ভেতরে মানুষ জমা রাখে নিজের ছবি
ছবিগুলো অনেক দিন থেকে যায়,
মানুষ ঠিক ততদিন রৌদ্র কুড়োবার জন্য তৈরি থাকে না।
শতাব্দীর আয়ুচক্র
কত স্রোত ম্লান হয়ে যায় জোয়ারের আগেই
কত সুতো, ঘুড়ি বুকে নিয়েই মিলিয়ে যায়
আকাশের গহীনে।
যেখানে শূন্য- শান্তি সেখানেই
যেখানে পূর্ণিমা- সেখানেই রাত
এমন যোগ বিয়োগের মাঝেই
মিশে যায় প্রবীণ শতাব্দী।
কতকিছু বাকি থেকে যায় স্বপ্নের সিন্দুকে
অবশিষ্ট অনেক দেনা—
কেউ শোধ করার জন্য সময় পায়,
কেউ পায় না,
জীবনকে শুধুই ঘিরে রাখে আরেকটি
আয়ুচক্রের ভ্রূণ।
মুদ্রার নিদ্রা দেখে
শক্তিরা ঘুমিয়ে থাকে, বিষাদেরা জাগে
কেউ কেউ পাহারা দেয় না যদিও,
একটি রাত যতনে নিবন্ধন করে মুদ্রার নিদ্রাপর্ব।
তা দেখে, একটি কাজল পরা মেয়ে তার
দু’চোখের স্বপ্নগুলোকে
পৃথিবী ভ্রমণ করতে পাঠায়
একটি বাঁশি সারা সকাল লিখে
বেদনার নৃত্যনাট্য।