আমাদের বাড়ির উঠোনে
একটা পেয়ারা গাছ নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিল।
আজ নেই।
তার এই না-থাকা সম্পূর্ণ স্মৃতিসান্ত্বনার মতো
ফলপ্রতিভার নিঝুম প্রয়াস
আলোকজঠরে ফেলে গেছে।
তুমি তাই ফলবতী—নিদ্রামোহময়;
ঘুমের অন্তিমে টোকা দিলে সাড়া দাও
স্বপ্নসহযোগী আমার প্রথম।
তুমি আছো, তবু তোমার না-থাকার
অস্তিত্বসংকট পেয়ারার লুপ্ত পাতার নিঃশ্বাসে
বৃক্ষবেদনার মতো জেগে থাকে নিজের ভেতর।
এই মর্মসংসারের অমূর্ত গল্পের ছাদে বসে
আমি তবে কোন পাখি? শালিকের ডিমের ওপর
আকাশরঙের নীল মাতোয়ারা দেখতে দেখতে
হারানো গানের জন্য কাঁদি?
দীপ্যমান হাসির দরজা খোলা রেখে
অশ্রুসঙ্গীতের এই পিচ্ছিল সংসারে
তোমাকে সবুজ হতে দেখি।
আর দেখি শ্যাওলাসেঁতার হাতে নিয়ে
আমাকে শোনাও গান: স্নেহসুষমার
স্বর্ণমন্দিরায় মূর্ত আগুনের মতো
তাইতো তোমার সুর আমাকে পোড়ায়।
আমি জলমুকুরের ঘুমন্ত আত্মায়
শুধু এক নীরব ঝিনুক
প্রদাহপ্রতিমা নিয়ে মুক্তোমায়াবন ফেলে রাখি।
তোমার পাশেই।
সত্যশৃঙ্খলের ফুল্ল কাঁটায় নিজেকে বেঁধে
একদিন তুমিই বলেছ: ভালোবাসা মানে
অন্ধের আকাশে রঙধনু হয়ে থাকা।
বধিরের শ্রবণসন্ধ্যায় রাতভর ঘুঙুরের
অনন্য প্রস্বর; আর
বোবার জীবনে স্বপ্নব্যাকুল কথার ফুলঝুরি।
রংতুলি শব্দ আর ভাষার অতলে বসে
এই-যে মায়াবি হও স্নেহদরবেশ
ঘোড়ার খুড়ের শব্দ রূপায়নে যে আসে প্রবল
কেড়ে নিতে আমাদের আজন্ম নশ্বর
তার আগে দেখো, ভাতবাগানের লোলোপ ধোঁয়ায়
ক্ষুধার নিতম্ব দোলে যেন এক বাঘিনীকরাত।
সবজিশকট ভেঙে একদিন পাতে আসে মাছেরা মলিন।
তবু শঙ্খবেদনার মতো রাত্রি পোহালেই
চিরুণিবিন্যাসে রমণীয় প্রসাধন
গন্ধরাজ তেলের সৌরভে যত মোহ দিক
জীবন এখানে রোজ মুধ ও কণ্টক
নিয়ে থাকে; পাতা ঝরে; ফুলসখীদের বাড়ি ছেড়ে
মাটির ডেরায় নেমে ভেঙে যায় পাপড়ির রঙিন কুহক।
এই গৃহে, অরণ্যমুঠোয়
যতটা কুড়াতে পারো শস্যসঙ্গীদের
তারো বেশি কণ্ঠনিরামর
চেয়ো না, চেয়ো না কবি।
দুঃখ পাবে।
চাইনি; বলেছি: শুধু এক রাত্রিগহিন তমসা বুকে নিয়ে
জন্মান্ধ যেভাবে দেখে একাঙ্গ দৃশ্যকে—পরিণত, ঝুরঝুর
পতনে পতনে শুধু চিরদিন ব্যথিত শ্রদ্ধায়—
আয়ুশূন্যতার মেঘমালায় আমাকে
সেইমতো ঝরে যেতে দাও।
মুহূর্তরঙিন এক ইন্দ্রীয়পৃষ্ঠায়
তোমার নিবিষ্ট করতলে গুম হয়ে থাকি।
ময়ুরের নাচ হয়ে পরাজিত ভাষার পেখম
যৌবন গড়িয়ে দিই বোবার আগুনে পোড়া কথার শয্যায়।
যদি চাও সপ্রনীরবতা, পেয়ারার ডালে ডালে বধিরের
শ্বাপদ নির্জন, আমি তবে ছোবলসন্ন্যাসী; বিষমাধুরির
প্রথম অন্যায় ভালোবেসে একরতি প্রেম
কেবল তপস্যা করি সারারাত।
মণি হয়ে বসে থাকি মন্ত্রপরাধীন
ঘন কালো তোমার ফণায়।
নে চুলবসন্তের কাশফুলে কোনো এক অদ্বৈত সন্ধ্যায়
স্বপ্নফিতা দিয়ে প্রেম বেঁধে
আমরা পেয়েছি চন্দ্রদ্বীপ
চাঁদের কাজলপড়া রাতের প্রহর।
খোঁপাকলঙ্কের দাগ নিয়ে
তারপর যাপিত জীবন হলো বিনুনি সহায়।
পিকসিক্ত ঠোঁটের দিগন্তে লাল সূর্যাস্তসময়
আমি নিজে হয়েছি বিস্তর।
আজ খোলা তৈজসে, রান্নার ব্যঞ্জনায়
আগুনপ্রতিভা হয়ে তুমিই আমাকে রাঁধো।
যেন তুমি সন্তান সঞ্চালনের খেয়াঘাট।
রক্তপূর্ণিমার মতো সময় নোঙরে বেঁধে
আমাকেই শুধু বলো, ভালোবাসি।